বারান্দার হাসনাহেনা গাছটার পাশে প্লাষ্টিকের চেয়ারে বসে সমানে সিগারেট ফুঁকে চলেছে ইভান। মা সরকারী স্কুলের শিক্ষিকা। তাই সরকারী কোয়ার্টারটা পেয়েছে। সামনে বড় আমগাছের মোটা একটা ডালে ফাঁসির রশি ইভান ঝুলিয়ে রেখেছে সে কৈশোর থেকে। বারবার রশিটা দেখছে। রাত প্রায় ১:০০ টা বাজে। মা পেছনে এসে পিঠে হাত রাখলো।
– আজো সেই পুরোনো কষ্ট মনে পড়ছে?
– হুম
– তুমি কি চাও তার পরিচয় তোমায় বলি?
– না মা! যে কেবল আমার বায়োলজিক্যাল ফাদার মাত্র স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি তার পরিচয় জানলে আমার ক্ষোভ আরো বেড়ে যাবে।
– শুধু কি ক্ষোভ না অভিমান?
– অভিমানতো কেবল প্রিয় মানুষের সাথে হয়। তবে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।
– অপরাধীতো আমরা। তুমি তো নিজের ইচ্ছেতে এ পৃথিবীতে আসোনি। আমাদের আনন্দের ফসল হলে তুমি।
– তুমি তো পারতে মা আমাকে জন্মের পর কোন ডাষ্টবিনে ফেলে আসতে। তুমি তা করোনি। পরিবার ও সমাজের সাথে যুদ্ধ করে আমাকে এতটা পথ এনেছো
– তুমিও তো কম যুদ্ধ করছোনা।
– থাক না আজ ওসব!
– আচ্ছা ঠিক আছে। ঘুমোবে চলো।
– না মা! ঘুম আসবে না। আগামীকাল আবারও সেই একই প্রশ্ন- বাবার নাম লিখেননি কেন?
– আগামীকাল তোমার চাকুরীর ইন্টারভিউ আছে তা বললে না যে?
– তুমি আমায় বই নিয়ে বসতে বলবে তাই।
– বয়স্ক হয়ে যাচ্ছি বলে ভেবো না মস্তিষ্কটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি কিন্তু বুঝি।
– কি বোঝ?
– চাকুরীটা পেলে রিমার সাথে কথা বলার জন্য নিশ্চয়ই মোবাইলে ফ্লেক্সিলোড এর জন্য আমার কাছে টাকা চাইতে আসবে না?
– মা ছেড়ে দাওনা!
-২৫ বছরে আমারও প্রেম ছিল কিন্তু এরপর মা আর কথা না বলে চুপ হয়ে যায়। ছেলে বোঝে মায়ের কষ্টটা।
– মা চলো ঘুমাবে।
– তুমি দেখছি ফাঁসির রশিটা এখনো খোলনি।
– মা তুমি ওই লোকটাকে এখনো ভালবাসতে পারো তবে আমি নই।
ওই লোকে ফাঁসি তো অনেক কম যে কিনা তোমাকে আমাকে অস্বীকার করেছিল। কিছু কিছু পাপ যে শাস্তির কাছেও লজ্জা পায় আমার যদি ক্ষমতা থাকতো আমি ওকে এই ফাঁসিতে ঝোলাতাম। নানা বাড়ির লোকেরা আজও তোমাকে স্বীকার করেনা। নিজের বাবা-মাকে একটিবারের জন্যও দেখতে পারো না, কষ্ট হয়না মা?
– ইভান প্লিজ থামো!
– বড্ড অদ্ভুত এই সমাজ! যে নারী এতটা পথ যুদ্ধ করেছে পরিবারের সাথে সমাজের সাথে তাকে কেবল পাপী ভেবেছে। আর আমি?
– প্লিজ ঘুমাতে চলো
– আজ না হয় ঘুমালাম সকালটা কি পাল্টে দেবে সব? মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
– মা সরি! আমি তোমাকে কাঁদাতে চাইনি।
– তুমি যাও আর আমাকে একা থাকতে দাও।
ইভান চলে যায়। ভাবে মা কাঁদুক। কাঁদলে যদি মন কিছুটা হাল্কা হয় তবে তাই ভাল। মায়ের মনে পড়ে যাচ্ছে সেই সংগ্রামের দিনগুলো। সমাজ তাকে বেশ্যা বলেছিল। বাচ্চা নষ্ট করবেনা বলে ভাইয়েরা বৃষ্টির রাতে তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল। আরো কত! স্মৃতিগুলো এখনো জ্বলজ্বলে। সে সয়ে গিয়েছে কিন্তু ইভান? পারবে তো? তার ভেতরে যেমন ইস্পাতের মন সে দেখেছে তেমনি কুসুমের মত মনও তার আছে। ভাবতে ভাবতে কখন যে সকাল হয়ে গেল সে টেরই পেল না। ঘরের ভেতর গিয়ে দেখে ইভান সমানে কেঁদে চলেছে।
– ইভান তুমি ঘুমোওনি কেন বাবা?
– ঘুম আসেনি। যে তার পিতার স্বীকৃতির অভাবে সমাজের কাছে বেশ্যার সন্তান হিসেবে গাল খায় কি করে সে ক্ষত মিলিয়ে যাবে বলতে পারো? মা চুপ হয়ে রয়। কান্না চেপে রাখে
– জন্ম নয় কর্মই মূখ্য। কর্মই তোমাকে এ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবে।
– মা তোমাকে বলা হয়নি আজ আমার জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের ভাইভা।
– কি বলো? তুমি এতদূর এগিয়েছো? তুমি পারবে, শুধু সাহস রেখো।
ইন্টারভিউয়ে ইভানের ডাক পড়লো তার সামনে গম্ভীর চেহারার বসে থাকা সব লোক। সব প্রশ্নের উত্তর ইভান দিলো। শুধু একটাই পারলোনা। বাবা নাম। ইন্টারভিউ থেকে বের হয়ে সেই দৃশ্য তার চোখে ভাসছে।
– ইউ আর সো ব্রিলিয়ান্ট কিন্তু বাবার নাম লেখেননি কেন? ইভান চুপ হয়ে থাকে।
– স্যার! আমি আামার বায়োলজিক্যাল ফাদারের নাম জানি না।
– যে কোন একটা নাম বসালে পারতেন।
– স্যার মিথ্যা বলি না। ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন তাকে বললো, মা কিছু বলেন নি?
– স্যার আমি এ ব্যাপারে বলতে ইচ্ছুক নই।
– আপনি আসুন।
চাকরীটা যে তার হচ্ছে না সে বুঝে গেল। বাসায় ঢুকতেই মা অস্থির হয়ে জানতে চাইলো কেমন হয়েছে? সে চুপ থাকে। ইভানের মোবাইলে রিমার নামটা সেভ আছে তাই মোবাইল বেজে ওঠার সাথে সাথেই ইভান তুলে ধরলো।
– ইন্টারভিউ কেমন হলো?
– সেই পুরোনো কাসুন্দি
– মানে?
– চাকরীটা হচ্ছে না তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেল।
– পাগল হলে নাকি?
– না
– মন খারাপ করো না শেষটা দেখে নাও।
– আচ্ছা এখন রাখো।
কোন চাকরীতে গেলে সে একই প্রশ্ন। ইভান নিজের প্রতি চরম হতাশ গিয়েছে। আজ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের গেজেট প্রকাশ হওয়ার তারিখ। সমানে রিমা কল দিয়ে যাচ্ছে। ইভান বিরক্ত হয়ে মোবাইলটা তুললো।
– কি হয়েছে? সকাল বেলা এত বিরক্ত করছো কেন?
– ইভান তুমি জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের পরীক্ষায় ফার্ষ্ট হয়েছো। তোমার রোল নাম্বারটা আমার কাছে আছে। বিশ্বাস না
হলে আমি তোমাকে মেসেঞ্জারে স্ক্রিনশট দিচ্ছি আর তুমিও চেক করো। ইভান সাথে সাথে কম্পিউটারে বসে গেল। সত্যিই যেন সে স্বর্গ হাতে পেল। মা তখন ছুটির দিন হওয়াতে বাসায় ছিল। সে চিৎকার দিল, ‘মা’।
– কি হয়েছে ইভান? কিছু হয়নিতো বাবা? ইভান কান্না করে দিলো
– আমাকে আর কেউ বেশ্যার ছেলে বলার সাহস পাবে না। আমি জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটে ফার্ষ্ট হয়েছি।
মা কেঁদে তাকে জড়িয়ে ধরলো। এতটা কাঁটার পথ পেরুতে যে রক্ত ঝরেছে তার কষ্ট বুঝি আজ কমলো।
সে চাকুরীতে নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু প্রথমেই এক জটিল মামলার সম্মুখীন হয়। এক বোরখা পরা মহিলা আর অপর প্রান্তে ষাট কিংবা একটু বেশি বয়সের লোক। মহিলাটি বোরখা না খুলেই বলে, এই লোক আমাকে ভালবাসার প্রতারণায় ফেলে আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে। পরবর্তীতে আমাকে ও আমার সন্তানকে সে অস্বীকার করে। দীর্ঘ ২৬ টা বছর আমি পরিবার আর সমাজের উপেক্ষা, অপমান, লাঞ্চনা সহ্য করে আমার সন্তানকে বড় করেছি। আমার সন্তানও কম কষ্ট পায়নি। লজ্জা আর অপমান তাকে এই সমাজ শকুনের মত ছিড়ে খেয়েছে। অপরপ্রান্তে আসামী তার দোষ স্বীকার করলো। বিচারপ্রার্থী বিচারককে বললো, জজ সাহেব আমি তার ফাঁসি চাই এই বলে সে ভেতর থেকে একটা রশি বের করলো। এই রশি দিয়ে যেন তার ফাঁসি হয়। দড়িটা চিনতে তার বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলো না। এটাতে সেই রশি যা সে ঝুলিয়ে রাখতো। বিচারক তাকে মুখ খোলার নির্দেশ দিলো। তার চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি ঝরতে চাইলো, সে মৃদু স্বরে বলল- মা! তবুও সে নিজেকে এই বলে সংযত করলো যে এখন সে বিচারক তার কাছে এখন মা নয় আইন বড়। আইনের দৃষ্টিতেই সে সবাইকে দেখবে। তবুও সে খানিকটা আবেগে কিছু কথা বললো।
– ভালবাসাকে আবেগ ও বায়বীয় মনে করা যাবে না। কারণ ভালবাসাও রক্ত মাংসের সৃষ্টি করে। সেই আদলই হলো যুগ যুগান্তের মানব সন্তান। কেবল আবেগ দিয়েই ভালবাসা হয় না। ভালবাসার বাস্তবতা জীবন নির্ণয়ের উন্নয়ন কর্মশালা। একে যেমন মিথ্যে দিয়ে ঢাকা যায় না। কাঁদায় ফেলেও ঢাকা যায় না সে অংকুর দিবেই দিবে। এবং সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবে। অস্বীকার করে চুরিকে ঢাকা যায় তবু তা মহাপাপ। সমাজে কলংক আনায়ন করে। মানব সত্তা এই কলংকের বোঝা বহন করতে চায়না উৎপাটন করতে চায়। এদিকে ঘড়িটা ঢং ঢং করে বেজে উঠে জানিয়ে দিল আজকের বিচারকার্য এখানেই শেষ করতে হবে।