নেশা কে না বলুন

নেশা কে না বলুন

মীনু আস্তে আস্তে রান্না ঘরের দিকে গেল।সেখান থেকে ঝট করে ধারালো বটিটা নিল।বটি নিয়েই সোজা শোবার ঘরে চলে গেল যেখানে মরার মত ঘুমাচ্ছে তার স্বামী রাতুল।বটিটা মাথার উপরে ওঠাল মিনু।ইচ্ছে রাতুলের প্রথমে হাত দুটো কাটার তারপর মাথাটা।হঠাৎ তার চোখ দুটো বেয়ে জল নেমে এল রাতুলের মায়াভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে।

গত দুই বছর ধরে এই ঘুমন্ত মুখটা তার উপর চালাচ্ছে অমানুষীক অত্যাচার।প্রতিদিন রাতে মাতাল হয়ে এসেই মারধর করে বেপরোয়াভাবে।অথচ দিনের বেলায় তার কিছুই মনে থাকে না।সে পুরোই সাধারন মানুষের মত আচরন করে। ভালবাসে,মায়া করে,যত্ন করে।আর এ সব কারণেই মিনু নিরবে সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করছে।কিন্তু গত রাতে রাতুল তার অত্যাচারের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল।মাথার চুলগুলো টেনে প্রায় অর্ধেক ছিঁড়ে ফেলেছে,চোখের নিচে তার মারের চিহ্ন নীল হয়ে ফুলে আছে।হাতে,পিঠেও রয়েছে রক্ত জমে থাকা লাল লাল ছোপ।মনটা ভেঙে গেছে মীনুর।শরীরের কষ্টগুলোর চেয়ে মনের কষ্টটা হাজারগুন বেশি।কি অন্যায় করেছিল গতরাতে সে?তার আয়ের কিছু টাকা লুকিয়ে রেখেছিল।রাতুল কে সেই টাকা নিতে দেয়নি সে।এই ছিল তার অপরাধ।তাই মারধর করে তার বিয়ের একমাত্র উপহার কানের দুলটা নিয়ে গেছে রাতুল।সেটা বিক্রি করেই গতরাতে নেশা করেছে সে।সকালে তার কিছু মনে থাকবে না জানতো মিনু। তাই সকালের চায়ের সাথে কড়া ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছে এই যন্ত্রনার চির অবসান করার।

অনেক ভেবে চিন্তে মিনু বটিটা আবার রান্না ঘরে রেখে আসল।না, আজ সে খুন করবে না।আজ তার বেতন পাবার কথা আছে।সে যে বাসায় কাজ করে সে বাসার মালিক তিন মাস হল বেতন দেয় না।আজ দেবার কথা আছে।মালিকের স্ত্রী সায়লা আপা নিজে কথা দিয়েছেন।টাকাটা হাতে পেলে রাতুল কে মেরে সে অন্য কোথাও চলে যাবে।

রাতুল কে বাসায় ঘুমন্ত রেখেই সে কাজে চলে গেল।সে যে বাসায় কাজ করে সেটা তার বাসার পাশেই।খুব সুন্দর বাসা এটা।ছোট পরিবার সায়লা আপার।সায়লা আপা মানুষটা খুব অমায়িক তবে তার স্বামীটা ঠিক উল্টা।ভীষণ বদরাগী লোকটা তবু সায়লা আপা তাকে মানিয়ে চলেন।বাসায় ঢুকতেই তার সায়লা আপার সাথে দেখা হল।

:কি রে আবার তোর স্বামীটা তোকে মেরেছে?
:হু আপা।
:এবারো কি নেশার টাকার জন্য?
:(মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো শায়লা)
:যা তোর আজ কাজ করতে হবে না।বাসায় গিয়ে রেস্ট নে।আর কিছু ভাত, তরকারী নিয়ে যা।বাসায় আর রান্না করতে হবে না।স্বামী কে যখন ছাড়বিই না তখন আর কি করার।তোকে টাকা দিলে যে ও নিয়ে যাবে তা আমি জানতাম।তাই তোর বেতন দেইনি এ তিন মাস।

:আপা আমার টাকাটা খুব দরকার আজ।
:আচ্ছা আজই নিস।তবে আজ সন্ধ্যার পর তোর ভায়ের কিছু গেস্ট আসবে কিন্তু ঐ সময় আমি বাপ্পি কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব আগেই ডাক্তারের এপোয়েন্টমেন্ট দেয়া ছিল। তারপর মা কে একটু দেখে তবে ফিরব।আমি সব গুছিয়ে যাব বিকালে।তুই এসে রান্নাটা করে,ঘরগুলো পরিস্কার করে টেবিলে খাবারটা দিয়ে যাবি।আর তোর টাকা ড্রেসিং টেবিলের ডয়ারে রেখে দিলাম।এখন নিস না।পরে এসে নিয়ে যাস।না হলে এতগুলো টাকা দেখলে রাতুল তোর থেকে সব নিয়ে যাবে বুঝলি?

:আচ্ছা আপা,এখন যাই?
:যা

মীনু চলে এল।বাসায় ঢুকে দেখে রাতুল ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।মীনু সেদিকে না তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল।ভাবল রাতুল এখন মাফ চাইবে কিন্তু দেখল রাতুল আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।ঘুমের ওষুধের ডোস বেশি থাকায় সারাদিন রাতুল ঘুমাল।সন্ধ্যায় যখন সে জেগে উঠল তখন মীনু সায়লাদের বাসায় চলে এসেছে।কাজ সব শেষ করার পর দেখল সাহেব তার গেস্ট নিয়ে এসেছে।গেস্ট বলতে একজন মেয়ে।খুব সুন্দর দেখতে। মীনু রান্না ঘর থেকে দেখছিল তাদের।তারা দুজন ড্রয়িং রুমে বসল।সাহেব তার ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করল তারপর নিজে দুটো গ্লাস হাতে ওই বোতল থেকে কিছু ঢাললো।দুজনে চুপচাপ কিছুক্ষন সেগুলো খেল।তারপর কথা বলা শুরু করল।

:আমি জানতাম আজ সায়লা থাকবে না তাই তোমায় বাসায় নিয়ে আসলাম।আমাদের হাতে দু তিন ঘন্টা সময় আছে এর মাঝেই সব শেষ করতে হবে বুঝেছ?
:হ্যাঁ ডিয়ার বুঝেছি।হোটেল থেকে তোমার বাসাটা বেশি সুন্দর।চল বেড রুমে চল।
:আর কয়েগ পেগ নিয়ে নেই।বোতলটা খালি হলে এটা লুকাতে হবে।সায়লাটা কে এত রাগারাগি করি,অপমান করি, মাঝে মাঝে মারিও তবু ও আমায় ছেড়ে যায় না।বাঙালি মেয়ে মানুষ একটা!!

মীনু তার দু কান কে বিশ্বাস করতে পারলো না।একি শুনল সে?সায়লা আপার এত কষ্ট তবু সে তা কখনো বুঝতে দেয়নি।রাতুল তো কেবল নেশা করে তবে কোন মেয়ের সাথে তার কিছু নেই।যদি তা থাকত তবে মীনু অনেক আগেই ওর থেকে পালাত।ভাবনার অবসান ঘটিয়ে মীনু তারাতারি ড্রয়ার থেকে তার বেতনটা নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে এল।সাহেবের এত নোংরামি সে দু চোখে দেখতে চায় না।

রাত বেড়ে যাচ্ছে তবু মীনু ফিরছে না দেখে রাতুল খুবই চিন্তায় পড়ে গেল।মীনু তো আগে কখনো রাতে বাইরে যেত না।কোথায় গেল মীনু সে ভেবে পাচ্ছে না।মীনু কে ছাড়া তার একটি দিনও চলবে না।সে ভাবতেই পারেনা মীনুকে ছাড়া কোন কিছু।গত কাল মীনু কে মেরে তার দুল বেঁচে যখন নেশা করছিল হঠাৎ তখন তাঁর বিয়ের প্রথম বছরটার স্মৃতি মনে পড়ে গেল।কত সুখে ছিল তারা।রাতুলের তখন ছোটখাট একটা চাকুরী ছিল।বেতন মাসে বারো হাজার টাকা।অফিস বয় হিসেবে কাজ করত সে।এই টাকায় খুব আনন্দে কেটে যাচ্ছিল তাদের।কিন্তু এলাকার কিছু খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সে নেশা করা শুরু করে।এই নেশা তার চাকুরী,সুখ সব কেড়ে নিয়েছে।এখন কি মীনু কে ও কেড়ে নিল?না না এটা হতে পারে না।মীনু কে ছাড়া রাতুল নামের অস্তিত্ব বৃথা।রাতুল মনে মনে শপথ করে মীনু কে ফিরে পেলে সে এই জীবনে আর নেশা করবে না যত কষ্টই হোক।

রাত পেরিয়ে সকাল হল তবু মীনু কে পাওয়া গেল না।রাতুল সব জায়গায় খোঁজ করেছে।সায়লাদের বাসায়ো।কিন্তু মীনু কোথাও নেই।রাতুল চিৎকার করে গলা ছেড়ে কাঁদছে মীনু মীনু করে।এমন সময় দরজায় কে যেন এসে দাঁড়াল।রাতুল কাঁদতে কাঁদতে সেদিকে তাকিয়ে দেখে মীনু।মীনুর সাথে আরো কিছু লোক আছে।সে ভাবল মীনু মনে হয় তাকে মারার প্রতিশোধ নেবে।রাতুল খুশি হল।নেক প্রতিশোধ নেক।মারুক আমাকে তবু আমি খুশি আমার মীনু ফিরে এসেছে।সে দৌড়ে গিয়ে মীনু কে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইল।

:মীনু তুমি আমাকে মেরে ফেল তবু আমাকে ছেড়ে চলে যেও না।
:তোমাকে চিরদিনের মত ধরে রাখার জন্যই আমি ফিরে এসেছি।
:ওদের কেন এনেছ?আমাকে মারতে?
:না,ওরা রিহ্যাভের লোক।
:এটা কি?
:এটা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র।এখানে নেশাগ্রস্তদের চিকিৎসা করা হয়।আমি সারারাত ধরে দেখেছি এদের কাজ।নেশা করে তোমায় আর পশু হতে দেব না রাতুল।তাই তোমায় এদের সাথে যেতে হবে।
:কিন্তু টাকা ছাড়া এরা আমার চিকিৎসা করবেন?

:টাকা আমি জোগার করবো।তুমি চিন্তা করোনা।তোমাকে মেয়ে ফেলার চেয়ে ভাল করে তোলাই আমার কাছে ভাল মনে হয়েছে।কারণ তুমি শুধু শরীরে আঘাত করেছ আমার এই নেশার জন্য কিন্তু সুস্থ্য থাকতে কখনো আমায় ভুল করেও কষ্ট দাওনি।ভালবেসেছো সত্যিকারভাবে।অন্য আর কোন মেয়েকে খোঁজনি আমায় ছাড়া।পৃথিবীতে এমন আরো অনেক লোক আছে যাদের অসুখ ধরা যায় না।তারা গোপনে প্রতিনিয়ত নিজের স্ত্রীর চোখের আড়ালে অন্য নেশায় ডুবে থাকে। তোমার অসুখ তো ধরা যায় কিন্তু তাদের ধরা যায় না।তাই তোমাকে ভাল করতে আমি যত কষ্ট করা লাগে করবো রাতুল।

:আমি তোমার আগের রাতুল হয়ে ফিরে আসবো মীনু।এই তোমায় ছুঁয়ে কথা দিলাম।নেশাকে চির বিদায় জানিয়ে ফিরে আসবো দেখ।সেই ভাল রাতুলের অপেক্ষায় থেক।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত