সুবিধাবাদী

সুবিধাবাদী

___বউ, চলো তোমার আব্বার বাড়ি যাব!
___১১ দিন আগেই না ঘুরে এলাম ৪ দিন থেকে, আবার কেন?
___বউ, আব্বাজানকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে, প্লিজ চলো যাই!
___আমি যেতে পারবনা ৷ গেলে তুমি যাও ৷ ঘণঘণ বাপের বাড়ি গেলে পাড়া প্রতিবেশীরা বলবে যে ঘর জামাই থাকতে আসছে ৷ স্বামী বেকার, কাজ করেনা! ৷ এসব কথা আমি শুনতেও পারবনা, যাবওনা!

___বলছি চলো!
___যাব, কিন্তু খবরদার! আমাকে ঐ বাড়িতে ছুঁতে আসবা না! এটা শুনে আমার স্বামী মুখটা এতটুকু বানিয়ে রইলো৷ তারপর চুল চুলকাতে চুলকাতে বিড়বিড় করে কি যেন বলল? এরপর আমাকে শান্ত গলায় জবাব দিল,

___আচ্ছা রাজি, চলো! তবুও আব্বাজানের ঐ পবিত্র মুখটা না দেখে থাকতে পারছিনা! খুব ভাল করে বুঝতে পারছি সে কেন এভাবে ফুলানো মার্কা কথা বলছে? আব্বাকে দেখতে তো যাবেনা, যাবে হচ্ছে জামাই আদর খেতে ৷ সে প্রতিবার তার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে গরুর আর খাসির মাংস ছাড়া ভাত খায়নি ৷ শেষবার ভাল মন্দ খাবার পর আম্মা বলেছিল, “জামাই পরেরবার এলে ইলিশ মাছের ঝোল খাওয়াব, এসো শীঘ্রই!” নিশ্চয়ই সে এবারইলিশ মাছ খাওয়ার আশায় আমার বাপের বাড়ি যেতে চাচ্ছে ৷

তাছাড়া সে যেই মাপের কিপ্টা ও হিসেবি শ্বশুর বাড়ি গেলে তার কয়েকদিনের খরচের টাকাও বাঁচবে, এই কারণেই শ্বশুর বাড়ি যাবার জন্য উঠে পড়ে লাগছে! আমিও বাধ্য হলাম বাপের বাড়ি যাবার জন্য৷ কিপ্টা জামাই ৭ দিনের মধ্যে একটা দিন শুধু মাছ এনেছিল তাও পাঙ্গাস মাছ ৷ বাকি ৬দিনই ডাউল আর আলু ভর্তা দিয়ে চালিয়েছি ৷ তাই ইচ্ছা হলো বাপের বাড়ি গিয়ে কয়েকদিন ভাল মন্দ খেয়ে আসি ৷ সেই সাথে কয়েকটা দিন উপভোগ করা যাবে মা, বোনের সাথে কাটিয়ে! গেলাম বাপের বাড়ি ৷ গিয়ে দেখি আমার বাকি তিন বোন আর তাদের স্বামীরা এসে হাজির! আমার চোখ কপালে উঠে গেল ৷ ভাবলাম বাপের বারোটা বেজে যাবে এবার ৷ খুব রাগ হচ্ছিল বাকি তিন বোনের উপর! বাবা সন্ধ্যা পর বাসায় ফিরল শূন্য হাতে! রাতে খেতে দেওয়া হলো কচুর শাক ভাজি আর আলু ভর্তা ৷ আমার স্বামী বাদে বাকি তিন বোনের স্বামীই দু-এক মুঠ খেয়ে উঠে গেল ৷ কিন্তু আমার স্বামীই শুধু খাবার টেবিলে রয়ে গেল ৷ খাচ্ছিলও মন ভরে ৷ তার খাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল এজন্মে এত মজার খাবার খায়নি ৷ একটা কাঁচা মরিচে কামড় দিতে দিতে সে জড়তাপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠল,

___আম্মাজান, আপনার রান্নার সত্যিই তুলনা হয়না ৷ কচুর শাক ভাজি করছেন এত সুন্দর করে যে মনে হচ্ছে গোশত ভাজি খাচ্ছি ৷ ভাববেন না মিথ্যা বলছি ৷ একদম মনের কথা বলছি, আম্মাজান আপনার কচুর শাক ভাজি এত স্বাদের হয়েছে যে মনে হচ্ছে ফাইভ স্টার হোটেলের রান্নাও হার মানবে ৷ আলু ভর্তাটা বাংলাদেশের বিশ্ববিখ্যাত রাঁধুনী কেকা ফেরদৌসির আলু ভর্তার চেয়ে মজার হয়েছে ৷ এক কথায় সেরাম আম্মাজান! দেন আরেক প্লেট ভাত দেন, একটু মজা করে খাই! আম্মা তার মেয়ের জামাইয়ের বিখ্যাত চাপাবাজি কথা শুনে খুশির ঠ্যালায় গদগদ হয়ে লাজুকতার সহীত লাজরঙ্গা হয়ে মিষ্টি করে হাসলো ৷

তারপর আমার স্বামীর প্লেটপূর্ণ করে ভাত ঢেলে দিল ৷ সাথে কচুর শাক ভাজি ও আলু ভর্তাও দিল! রাফাত খেতে খেতে চার প্লেট ভাত সাবাড় করে টেবিল থেকে উঠল ৷ ওর খাওয়া দেখে আমি বেহুশ না হলেও অজ্ঞান হয়ে গেলাম ৷ রাফাতেরআরো বেহুশের রুপ নিয়ে খাওয়ার দৃশ্য দেখার লোভে জ্ঞান ফিরে পেলাম! পরদিন সকালে দেখি আমার তিন বোনই যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছে তাদের স্বামীকে নিয়ে ৷ রাফাত তাদের যাওয়া দেখে আমাকে ফিসফিস করে বলল,

___যাচ্ছে যাক, আমার জন্য ভাল হলো ৷ ওদের জন্য তোমার বাপ ভাল মন্দ বাজার করেনি ৷ আর এতজনের জন্য বাজার করা সম্ভবও না ৷ হয়তো পরের ওয়াক্তে ভাল মন্দ বাজার করতো কিন্তু তারা তো চলে গেল! আমি সে ভুল করব না ৷ শ্বশুর বাড়ি আসিইনা তেমন ৷ সপ্তাহে তিনদিন আসতে পারলে ভাল হতো! একথা শুনে হাসব নাকি কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না! ওদিকে আম্মা আব্বাকে বলছে,

___শোন মেজো মেয়ের জামাই কত ভদ্র আর কত ভাল আচার-আচরণ, দেখছো? কচুর শাক দিয়ে ভাত খেয়ে রান্নার কত প্রশংসা করল! আর তোমার বাকি তিন বেটির জামাই আমার রান্নাকে পা মাড়িয়ে গেল ৷ আবার মুখ ফুলিয়ে বাড়ি থেকে চলেও গেল! কতবড় বেয়াদব তারা ৷ মেয়েগুলোও হয়েছে দেখো জামাইগুলো চলে যেতে চাইলো বলে তারাও তাদের সাথে সাথে গেল ৷ যাকগে তাতে আমার কি? শোনো নুসরাতের বাপ, বাজারে যাবা ৷ বাজারে গিয়ে তিন কেজি গরুর গোশত আর এক কেজি মাপের একটা ইলিশ আনবা! আম্মার কথাগুলো রাফাত আড়ি পেতে শুনছিল ৷ কথাগুলো শুনে সে খুব খুশি যে হয়েছে মুখ দেখে বুঝতে পারলাম! ওদিকে আম্মার কথা শুনে আব্বা বলল,

___আরে এত বাজার করতে হবে কেন?
___যা বলছি তাই করো! রাফাত আমাকে বলে উঠল,
___দেখছো কত ভাল আমার শ্বাশুরি আম্মা? কত ভালবাসে আমাকে! একটু পর আব্বা আসলো রাফাতের কাছে ৷ এসে বলল,
___জামাই যাও বাজারে যাও ৷ তিন কেজি মাংস আর ১কেজি মাপের ইলিশ আনবা! রাফাত মিনমিন করে বলল,
___টাকা দেন!
___তুমি বাজার করবা, টাকা কেন চাও? রাফাতের মুখটা নিমিষে কালো হয়ে গেল ৷ বুঝলাম সে বড়সর বাঁশের বারি খেয়েছে! সে আব্বাকে ছোট্ট করে বলল,

___আব্বা, সত্যি বলছি আমার কাছে গাড়ি ভাড়ার টাকা ছাড়া একটা টাকাও নাই ৷ যে টাকা আছে সে টাকা দিয়ে শ্বাশুরি আম্মার জন্য একটা শাড়ি কিনব!
__ঠিক আছে, লাগবেনা তোমার টাকা ৷ আমিই বাজার করে আনছি! রাফাতকে বললাম,
___সত্যি আম্মার জন্য শাড়ি কিনবা? রাফাতের জবাব,
__আরে না, বরং তুমি শ্বশুর আব্বাকে এখনই বলবা, “আমাকে শাড়ি কিনে দেন আব্বা, আজকেই লাগবে৷ ছেঁড়া শাড়ি পড়ে আসছি!” এটা বললেই টাকা দিয়ে দিবে!
___পারব না বলতে!
___পারতেই হবে!

আব্বাকে বলে শাড়ি কেনার টাকা নিলাম ৷ ওদিকে আব্বাজান দুপুরের আগেই বাজার করে বাড়ি এলো গোশত আর ইলিশ মাছ নিয়ে! দুপুরের আগে আমার স্বামী মার্কেট গেল শপিং করতে ৷ দুপুর পর নিয়ে এলো ৭০০ টাকা দামের শাড়ি কিনে অথচ টাকা দিয়েছি তাকে ৩হাজার ৷ শাড়ি কিনে এনে বলছে ৩ হাজার টাকা দাম এটার! খুব রাগ হলো ওর উপর!

দুপুরে রান্না করা হয়েছে৷ কয়েক পদের ৷ গোশত, ইলিশ আর কচুর শাক ভাজি! রাফাত বাড়ি এসে খাবার চাইলো ৷ আমি আম্মাকে বললাম বিষয়টা, আম্মা বলল, “বাসায় মেহমান আসবে, তাদের সাথে জামাইকে খেতে দেব!” আম্মাকে বললাম, “কারা আসবে?” আম্মা বলল, “নীলাকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ”! রাফাত ধৈর্য্য ধরে রইলো! মেহমানদের সাথে আমার স্বামীকে খেতে দেওয়া হলো ৷ আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ৷ আম্মা পাত্র ও পাত্রের লোকদের প্লেটে গরুর গোশত আর ইলিশ মাছের চাকা তুলে দিচ্ছিল ৷ আর রাফাতের প্লেটে শুধু কচুর শাক ভাজি! আমার স্বামীর মুখটা পোড়া ভাতের মত হয়ে গেল৷ হাত উঠছিলনা তার ৷ তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে সে মুখে এক বা দু মুঠ ভাত মুখে নিলো! ওদিকে পাত্রপক্ষ খায়েশ মিটিয়ে খাচ্ছে ৷ রাফাত লোভাতুর চোখে শুধু গোশতের প্লেট ও ইলিশ মাছের প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখছিল বারবার ৷ আমার স্বামীর জন্য মায়া লাগছিল খুব ৷ হঠাৎ আম্মা বলে উঠল,

___জামাই খাচ্ছনা কেন? আজ কি কচুরি শাক ভাজা কেকা ফেরদৌসির রান্নার মত হয়নি? রাফাত হতভম্ব হয়ে গেল আম্মার কথা শুনে ৷ হতবুদ্ধি রাফাত চেঁচিয়ে উঠে আমাকে বলল,
___নুসরাত, তোমাকে না বলেছিলাম কচুর শাক ভাজি খেলে আমার আমাশয় হয়!।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত