নিয়মের বেড়াজালে

নিয়মের বেড়াজালে

রাস্তা ঘাটে বুড়ো মানুষকে দেখলেও খুবই বিরক্ত লাগতো সায়লা’র।

ঘুরে ফিরে ওর সামনেই যেন বেশি পড়ে এই বিদেশ বাড়িতে। শপিং মলের টাকা দেয়ার কাউন্টার দখল করে রাখে তারা অনেকক্ষণ, টাকা গুনছে তো গুনছেই। ভাংতি পয়সা দেয় বেশি, তাও পঞ্চাশ বার গুনে দেখে। তারপর জিনিষ ভরছে তো ভরছেই। শেষ হয়না তাদের ধীর গতির কাজ।

তারপর ছোট কোনো পথ দিয়ে হাঁটতে যাবে, তাও আগে বুড়োবুড়ি কেউ থাকবে। তাদের আস্তে ধীরে হাঁটা শেষ হতে অনেক সময় নেয়, সায়লা আর এগুতে পারেনা তাড়াতাড়ি, অসহ্য!
ভাবে সে।

কিরে, তাদের খেয়ে দেয়ে কি কাজ নেয় আর! রাস্তা ঘাট, দোকান পাট সব দখল করে রাখে কেনো? ঘরে বসে তোমাদের ঈশ্বরের নাম জপ করো, তা না, বিরক্ত করে মারে, আশ্চর্য!

এসব ভাবতে ভাবতেই লিফটে চড়ে, বাসায় ঢুকবে, ফোন বাজতেই আছে।

কিরে বাবা, একবার যখন রিসিভ করেনি, দুই মিনিট অপেক্ষা তো করো। তা না, নন স্টপ করতেই আছে।

ধরবোনা ফোন আজকে।
রাগ উঠে যায় তার।

ধরবেনা বললেও, হাত থেকে বাজার আর ব্যাগ রেখে, ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। দেখে মায়ের কল।

সে কল ব্যাক করে,

মা, তোমাকে কত্তো বার করে বললাম, মিস কল দিতে। আর তুমি কল করতেই আছো……  না দেখে ধরে ফেললে তোমার টাকা শেষ হয়ে যেতো না?

মারে, আমি এসব বুঝিনা, আর রিং পড়ে তাও তো ভালো শুনতে পাইনা, কি করবো।

তা কেমন আছো? ভাইয়া ভাবি সবাই ভালো তো?

আমি এখন গ্রামে!

কেনো? রমজান মাস ওখানে থাকার কথা না?

হ্যাঁ, কিন্তু, একটা রুমে সারাদিন চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগেনারে মা। ওরা তো সবাই ব্যস্ত। ছেলে ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে। বউ ছেলে মেয়ের কোচিং, নাচ গানের ক্লাস নিয়ে। 
আমি কি করবো, কতক্ষণ একা থাকা যায়!

এখানে কিভাবে রাতে উঠে সেহেরি খাবে, কে তোমার ইফতার বানাবে?

ইফতার কে বানাবে আর। বেশিরভাগ খিচুড়ি ভাত রান্না করে নিই, দুই বার করে খেয়ে নিই। ঘড়িতে  এলার্ম দিয়ে রাখছি।

এরপরও মা, তোমার বয়স হয়েছে। একা থাকাটা কি ঠিক? ক’দিন আগে না, অসুখ থেকে উঠলে!  তাই তো ভাইয়ার বাসায় থাকার কথা উঠলো।

এখন একটা কাজের মেয়ে পাও কিনা দেখো।

প্রয়োজনে কাজের মেয়ে কি পাওয়া যায়!
মাঝেমধ্যে তোর ফোরকান চাচার মেয়ে এসে সাহায্য করে। প্রতিদিন কি অন্যের মেয়ে থেকে সাহায্য নেয়া ভালো দেখায়! বল?

আর বাকি কথার জবাব দেন না তিনি, চুপ করে থাকেন। নাত নাতনী, মেয়ে জামাইয়ের খবর নিয়ে ফোন রেখে দেয়।

মেয়েকে বলা হয়না সবকিছু। ছেলের বউ বুড়ো মানুষ পছন্দ করেনা খুব একটা । হাত লেগে কিছু পড়ে গেলেও ধমক দিয়ে উঠে।

আপনি পারেন না, ধরতে যান কেনো? ভাঙল এবার, হলো!

না বউ, ভাঙেনি।

ভাঙতে তো পারতো। পানি জগ ভরে রুমে রাখিয়েন। রুম থেকে আর বের হতে হবেনা, ঠিক আছে?

আচ্ছা, বলে তিনি রুমে চলে যান। বউ চায়, সে রুমে থাকুক সারাক্ষণ। আর তিনি চান, সবার সাথে একটু গল্প করতে।

বউকে যদি বলে ঘরে একা একা লাগে। জবাবে বলে,

কার এতো সময়, আপনাকে কোলে নিয়ে বসে থাকবে?

ওরা বাইরে যাবার সময় বলে যায়,

দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকবেন। আওয়াজ শব্দ বেশি করবেন না। এটা গ্রাম না, নিচের ঘরে ভাড়াটিয়া থাকে, বিরক্ত হবে। আর শুনেন, কেউ দরজা ধাক্কালেও খুলবেন না। ফকিরকেও ভিক্ষা দিতে যাবেননা, ডাকাতও হতে পারে।

একদিন কৈতরি কিছু বেতন বাড়াবার জন্য তাকে সুপারিশ করতে বলে, তিনি করেনও।

বউমা, কৈতরি কে পারলে কিছু টাকা বাড়িয়ে দিতে পারো কিনা দেখো, আমাকে বলছিলো।

কৈতরি টা আবার কে! 

তোমাদের বুয়া

আপনি আসতে না আসতে তার নামও জেনে গেছেন! মা শুনেন, ওদের অতো মাথায় তুলিয়েন না, নামাতে কষ্ট হবে আবার আমার। ওর সাথে এতো কি কথাই বা বলার আছে আপনার? পারলে ও কিছু চুরি চামারি করছে কিনা খেয়াল করিয়েন।

কথাগুলো শুনতে তেমন ভালো লাগেনি আমেনা খাতুনের। কৈতুরির একটা নাম আছে, আর বুয়া মানেই কি চোর হতে হবে!

এতো নিয়ম ওর ভালো লাগেনা, বন্দি জীবন দম বন্ধ লাগে। এটা বলায় বউ বলে,

আপনার যখন টাউন এতো অপছন্দ, ভালো লাগেনা, তো না আসলেই পারতেন। আসছেন যখন, নিয়ম তো মানতে হবে, আমাদের সজাগ থাকা দরকার।

না, শ্বাশুড়ী আমেনা খাতুন এর এত্তো এত্তো নিয়ম ভালো লাগেনি। রমজান মাসে ফকিরকে চালও দিতে পারবেনা, এ কেমন কথা! চারদিন পর শুক্রবার আসলে ,ছেলের সাথে দেখা হয়।

আমাকে গ্রামে রেখে আয়, নাজিম। এখানে ভালো লাগেনা।

এখানে ভালো লাগেনা, এ কেমন কথা! কি অসুবিধা?

অসুবিধা কিছু না, গ্রামের জন্য মন কেমন করছে।

কি যে বলোনা মা, বেহেশত ফেলে দোযখে যেতে চাইছো! আমি কিন্তু ঈদ ছাড়া আর যেতে পারবোনা, দেখতেই পারছো, কেমন ব্যস্ত।

ঠিক আছে, ঈদেই আসিস।

আমেনা বেগমকে ছেলে দিয়ে যায়।

আশে পাশে কয়েক ঘর মানুষ আছ। প্রতিবেশিরা, আমেনা বেগমের হঠাৎ চলে আসা নিয়ে কথা বলতে আসে,

কিরে নাজিমের মা, চলে এলে কেনো?

গ্রাম ছাড়া ভালো লাগেনা

নাকি বউ ভালো না? বউয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে?

বউয়ের সাথে ঝগড়া হবে কেনো? বউ খুব মান্য করে। কিন্তু, ঘরের ভেতর বন্দি লাগে গো, দম বন্ধ হয়ে আসে।

অহহ তাই বলো। ভাবলাম, বউ ভালো না। সারাজীবন গ্রামে থাকছো, হঠাৎ কি আর কারো শহর ভালো লাগে। ক’দিন থাকতে, অভ্যাস হয়ে যেতো। একা কি করবে? মেয়েও তো বিদেশে….

থাক, সমস্যা কি? অনেক বছর ধরেই তো একা।

হুম তাও ঠিক, তবে বয়স তো বাড়ছে বৈ কমছেনা।

হুম, বলে দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে আমেনা খাতুন।

তার এক ছেলে এক মেয়ে, আর ছেলে পুলে হয়নি। স্বামী মারা গেছে পাঁচ বছর হয়, এর পর থেকে সে একা। ছেলের বাসায় দুই তিনদিনের বেশি মন টিকেনা। স্বামীরও শহর ভালো লাগতো না, তাই বুড়োবুড়ি গ্রামেই থেকেছে সবসময়।

মা তেমন কিছু না বললেও, সায়লা কিন্তু বুঝতে পারে মায়ের সমস্যা কোথায়। ভাবি একমাত্র ছেলের বউ হলেও মা বাবাকে তেমন করে কখনোই ভালোবাসেনি, সায়লাকেও না। 

মায়ের এই বয়সে একা একা থাকা, রান্না করে খাওয়া, কেমন কষ্ট হয়ে বিধে সায়লার মনে। 

আহা, মায়ের না জানি কতো কষ্ট হচ্ছে! 

“হে আল্লাহ, আমার মাকে তুমি শান্তিতে রাখো….”

এমন দোয়া মনে আসার সাথে সাথে তার এতোক্ষণ রাস্তায়, দোকানে দেখা হওয়া বুড়ি মহিলাদের চেহেরা ভেসে উঠে!

হায় আল্লাহ, এতোক্ষণ এবং এতোদিন ধরে মনে মনে কতো গাল মন্দই না করেছি তাদের! আল্লাহ, তুমি আমাকে মাফ করো।

আচ্ছা, এখন আমার মাও এই একাকিত্বে কষ্ট পাচ্ছে, একদিন তো আমিও বুড়ি হবো…
এমন দিন কি আমার জন্যও অপেক্ষা করছেনা?

সায়লা’র মনে এখন ঐ মহিলাদের জন্য গভীর মমতায় ভরে যায়, সাথে মায়ের জন্য এক বুক কষ্ট। 

পরদিন,

সায়লার তেমন কিছু কেনাকাটার নাই, তবুও সে টুকিটাকি কিনতে বেরুয়। না, আজ উদ্দেশ্য কেনাকাটা নয়, বুড়িদের সাথে  দেখা করা, মনে মনে তাদের সে সরি বলে আসবে।

সবসময়ের মতো লাইনে অনেকের ভীড়ে তার সামনে একজন বুড়ো আছেন। ঘাড় বেঁকে গেছে তার, চোখে চশমাও আছে। টাকা জমা দিতে যথারীতি উনারও অনেক সময় ব্যয় হয়। সায়লা আন্তরিকতার সাথে অপেক্ষা করে। ভদ্রলোক পলিথিনে জিনিষ ভরতে যাবে, সে বলে,

ভদ্রলোক, আমি কি তোমার কাজে সাহায্য করতে পারি?

বুড়ো জবাব দেন,

প্রিয়তমা, অবশ্যই পারো। তবে তোমার কষ্ট হবে নাতো?

না, আমি খুশি মনেই করবো।

তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ঈশ্বর তোমার সহায় হবে। দোয়া করে তিনি চলে যান।

 এতে করে মনটা অনেকখানি ভালো লাগে তার।

দোকান থেকে বেড়ুতেই দেখে এক বুড়ি, বয়স সত্তুরের বেশি হবে, স্কার্ট পরা। সাদা, চিকন লম্বা পা দেখা যাচ্ছে, চুল ছোট করে কাটা। মুখে একগাদা মেকাপ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। বাইরে রেস্ট করার জন্যে রাখা ব্যাঞ্চে বসে আছেন।

আমি কি এখানে বসতে পারি?

কেনো নয়, প্রিয়তমা? বসো বসো…

ধন্যবাদ, তুমি খুব সুন্দরী মেম। কি সুন্দর তোমার সাজ, আমি এমন সাজ খুব ভালোবাসি। বলে সায়লা

সত্যি তুমি পছন্দ করেছো!

হ্যাঁ। 

আমি সাজতে খুব ভালোবাসি, কিন্তু এখন বুড়িয়ে গেছি। মন খারাপ করে বুড়ি।

কিন্তু এখনো তুমি সুন্দরী আছো।

অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।

তুমি কি বাজার করতে এসেছো?

হ্যাঁ,,তুমি?

আমিও। তোমার সন্তানরা তোমাকে বাজার সদাই করতে সাহায্য করেনা?

অহহ না, আমি তো একা থাকি। সন্তান বড় হলে মায়ের সাথে থাকেনা, পৃথক থাকে।

তুমি অসুস্থ হলে কি করো?

ইমার্জেন্সিতে কল করি, এম্বুলেন্স এসে নিয়ে যায়।

যদি কল করতে না পারো?

মরে পড়ে থাকবো, কেউ বুঝতে পারলে পুলিশ ডাকবে।

ভয় লাগেনা তোমার?

না, তবে সবার অভাব বোধ করি। সবাই কে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, আমি এখন যাবো।

ঠিক আছে, বিদায়। তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো।

সত্যি! কিন্তু বুড়োদের সাথে কথা বলতে কেউ ভালোবাসেনা, নিজের সন্তানও না! বিদায়।

বুড়ি চলে গেলো। কিন্তু তার বলা শেষ কথাটা সায়লা’র কানে বাজতে লাগলো,

বুড়োদের সাথে কথা বলতে কেউ ভালোবাসেনা, নিজের সন্তানও না…

আসলেই কি তাই!!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত