” নাম কী? ” আতিকা জাহান।
” বাড়ি কোথায়? ” মাদারীপুর।
” লেখাপড়া কতদূর? ” আমি একজন মা ও শিশু বিশেষজ্ঞ।
” বিয়ে হয়েছে? ”
হ্যাঁ। ” তাহলে আপনার আর এই বাবুর দরকার কী? ” সব বিবাহিত নারীর গর্ভবতী হওয়ার সৌভাগ্য হয় না। ” বুঝলাম, আপনি এই বাচ্চাটির দাম জানেন? ” জ্বী, পঞ্চাশ হাজার। ” টাকা এনেছেন? ” হ্যাঁ, সাথে পঞ্চাশ হাজার টাকা বকশিসও। বাচ্চাটির মাকে পৌঁছে দিবেন দয়া করে। ” ঠিকাছে, কিছু কাগজপত্রে আপনার সাক্ষর দিয়ে বাচ্চাটিকে নিয়ে যেতে পারেন। ”
— মা, সামনে আমার ফাইনাল পরীক্ষা। ” কবে শুরু হবে? পরিক্ষার ফিসটিশ কত লাগবে? ”
— ওসব আমি টিউশনি করে জোগাড় করে ফেলেছি। কিন্তু ” কিন্তু কি রে মা? ”
— আমার একটাও ভালো জামা নাই। দুই বছর ধরে এক জামা পড়ে পরীক্ষা দিচ্ছি। এবার আর পড়ার মতো অবস্থা নাই। তুমি বাবাকে বলো তো একটা জামা আনতে কমদামের মধ্যে। ” আচ্ছা ” বইটা বন্ধ করলো শিরিনা। কপালে একটু লজ্জার ছাপ।
— মা আমার বান্ধবী রুমানার কথা তোমাকে বলেছিলাম না? ওর গতমাসে বিয়ে হয়েছিল। জামাইটা এত্ত ভালো কি বলবো। শুধু তাই না। শ্বাশুরিটাও মাটির মানুষ।
” ভালো তো। সুখে থাকলেই ভালো। ”
— কিন্তু আমি যে একটা ভুল করে ফেলেছি। লতা বেগম হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলেন। একটা মাত্র মেয়ে তাঁর।
” কী ভুল রে মা? ”
— আমি ওকে জামাই আর শ্বাশুরীসহ একদিন আসতে দাওয়াত দিয়ে ফেলেছিলাম। সত্যি সত্যিই এখন উনারা আসবে। এই বস্তির এক কুঠরীর ঘরে এসে কী লজ্জাটাই না পাবেন উনারা না? লতা বেগম কোনো কথা বললেন না। ” শিরিনা, আন্টি কোথায় রে? ”
— পাশের বাড়িতে গেলো কিজন্য যেন৷ তুই উনাদের নিয়ে একটু বস। আমি মাকে নিয়ে আসছি। চারদিকে থালাবাসনের শব্দ আর মানুষের আর্তনাদ। খাবার নেই, পানি নেই৷ এরকম একটা বস্তির মাঝে এসেও রুমানা ইতস্ততবোধ করছে না। তাঁর বর ও না। শ্বাশুরি যেন একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তা রুমানার চোখ এড়ালো না।
— আম্মা, কোনো কথা বলছেন না যে? ” না, কিছু না৷ ”
বলতে বলতে শিরিনা মাকে নিয়ে হাজির হলো। রুমানা আর তাঁর বর বাবর আহাম্মেদ লতা বেগমের পা ছুঁয়ে সালাম করে নিলেন৷ কিন্তু তার পরেই যেন লতা বেগমের বুকে সাত আসমানের বজ্রপাত কম্পিত হলো। তাঁর মেয়ের বান্ধবী, বান্ধবীর বর আর তাঁর শ্বাশুরির আচরণ দেখে সত্যিই মুগ্ধতায় দুলে গেলেন লতা বেগম। খাওয়াদাওয়া করে রুমানা আর শিরিনাকে নিয়ে রুমানার বর বাইরে বেরোলো। এই ফাঁকে রুমানার শ্বাশুরির পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন লতা বেগম। উনি হাত ধরে তুলে বললেন— আরে আপনি আমার পা ধরে কাঁদছেন কেনো? লতা বেগমের কান্না থামছেই না। অনেক্ষণ পরে বললেন— আপনার ঋণ আমি কোনোদিনও শোধ করতে পারবো না।
অবাক হয়ে রুমানার শ্বাশুরির জবাব দিলেন— ঋণ, কীসের ঋণ? লতা বেগম অশ্রুসিক্ত হয়ে বললেন— আপনি একজন মা ও শিশু বিশেষজ্ঞ না? আপনার নাম আতিকা জাহান না? বাড়ি তো মাদারীপুর? মাথা নাড়িয়ে ভদ্র মহিলা গলা বাড়ালেন— সবই ঠিকাছে, এখানে ঋণের কী আছে? লতা বেগম ভদ্র মহিলার হাত ধরে বললেন— যেদিন আপনি সদর হাসপাতাল থেকে একটি ফুটফুটে বাচ্চা কুলে নিয়ে বের হন। আমি আপনার পিছনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। ত্রিশ বছর আগের কথা। আপনি নিশ্চয় ভুলে যাননি। ভদ্র মহিলা এবার চোখ বড়বড় করে বললেন— কাঁদছিলেন কেনো?
— কারণ আমিই সেই মা, যে পঞ্চাশ হাজার টাকার বিনিময়ে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করা ছেলেটিকে বিক্রি করে দিয়েছিলাম! কি করবো বলুন? স্বামী স্ত্রী পাশাপাশি বেডে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে কেমন দেখায়? পঞ্চাশ টাকা ছিলো না যাদের পুঁজি। তাঁরা পঞ্চাশ হাজার টাকার বিপদে পড়ে যায়। উনার পা না ভালো করলে সেদিন আজ শেষ বয়সে এসেও রিকশা চালাতে পারতেন না। আতিকা জাহান এই মাত্র বুঝে উঠলেন। কেন এই বস্তিতে এসে তাঁর বুকে কিছু একটা টুকা দিচ্ছিলো। ” আপনার ছেলেকে আমি কোনোদিন কষ্ট দিইনি। ওর জন্যই বেঁচে আছি। ”
— তা তো দেখতেই পারছি৷ আমার সাথে থাকলে তো, টাই কোর্ট পড়া ছেলেটা কবেই মরে যেতো। নাহয় হতো রাস্তার টোকাই। তাঁদের কথাবার্তা আর দীর্ঘ হয়নি। শিরিনা তাঁর বান্ধবী আর তাঁর বরকে সঙ্গে নিয়ে আবার ঘরে ফেরে। লতা বেগম চোখ ভরে নিজের ছেলেকে দেখে নিলেন। মন ভরে ছেলে বাবর আহাম্মেদ ও তাঁর পুত্রবধূকে আশির্বাদ করে দিলেন। যদিও তাঁরা জানে না লতা বেগম তাঁদের আসলে কী হয়? তাতে কী?