ভাঙ্গা চশমা

ভাঙ্গা চশমা

দুতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে তড়িঘড়ি করে নামছি। অনেকটা লেট হয়ে গেছে। আজ নিশ্চিত প্রথম ক্লাসটা পাবো না। ঠিক তখনি কারো সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে গেলাম। দূর তড়িঘড়ি করলেই দেড়ি হয়।

রাগ নিয়ে ধাক্কা খাওয়া বস্তুর দিকে তাকালাম। ততক্ষণে আমার রাগটা শেষ হয়ে গেছে। আমার ঠিক দুই তিন সিঁড়ি নিচেই একটা ছেলে পড়ে আছে। দেখতে কেমম হাবাগোবার মত চেহারা। তার চোখের দিকে তাকাতেই সব রাগটা যেন মিলিয়ে গেল। মুখের কোণে অজান্তেই একটা হাসি চলে আসল। এই ছেলেটার মুখে এতটাই মায়া কাজ করছে যে আমি চোখ ফেরাতেই পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, তার মুখের মায়ায় যেনও হারিয়ে যাচ্ছি। আমি উঠে পড়তেই দেখলাম ছেলেটা হাত দিয়ে কিছু একটা খুঁজছিল। ভদ্রতাসূচক তার দিকে তাকিয়ে বললাম..

– আই এম সরি। আপনি কি কিছু খুঁজছেন?
– আসলে চশমাটা…

সিঁড়ির নিচের দিকে তাকাতেই দেখলাম চশমাটা একবারে নিচের সিঁড়িতে আছে। কিন্তু ফ্রেমটা ভেঙ্গে গেছে। দূর..

– আসলে আপনার তো চশমার ফ্রেমটা ভেঙ্গে গেছে?
– ওহ।
– আপনি কি চশমা ছাড়া দেখতে পারেন না?
– দেখি। তবে ঝাপসা।
– ওহ।

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একটু কষ্ট হল, বেচারা। চশমাটার তো বারোটা বেজে গেছে, এখন? যেভাবে তাকাচ্ছে তাতে তো মনে হয় চশমা ছাড়া এক কদম ও দিতে পারবে না। আমি বললাম…

– আপনি যাবেন কয়তলায়?
– তিনতলা।
– আসেন আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।
– না ঠিক আছে।
– আরে আমার জন্যই তো আপনার চশমাটা ভেঙ্গে গেল, সরি। আসুন আপনাকে নিয়ে যাই? আর আপনার চশমা নিয়ে যাচ্ছি, আসার পথে নতুন একটা ফ্রেম লাগিয়ে নিয়ে আসব?
– না, লাগবে না। বাসায় চশমা আরেকটা আছে।

তিনতলায় ছেলেটা কে দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। ১০:৩০ বাজে। দূর, অলরেডি একটা ক্লাস শেষ। ধাক্কা খাওয়ার আর সময় পেলাম না। কলেজ থেকে এসেছি দুপুরের দিকে। আমার হাতে সেই ভাঙ্গা চশমাটা। কলেজে গিয়ে একটা ক্লাসও ভাল করে করতে পারিনি। বারবার সেই মায়াময়ী নিষ্পাপ মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। এক ধাক্কাতেই ছেলেটা আমার মনের ভেতর জায়গা করে নিয়েছিল। ভাঙ্গা চশমার দিকে তাকাচ্ছি, আর ভাবছি ছেলেটার কথা। কিন্তু আমি এত ভাবছি কেন?

এই বাসায় এসেছি এক মাস হল। এরমধ্যে ছেলেটা কে কয়েকবার দেখেছি। তবে তেমন একটা ভাল করে দেখা হয়নি। বিকেলের সময়টুকু প্রতিদিনই আমি ছাদে থাকি। রক্তিম লাল সূর্য ডুবা দেখি। একটা আলাদা অনুভূতি হয় তখন। মন খারাপ থাকলেও মুহূর্তেই মন ভাল হয়ে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রকাণ্ড ছাদের ঠিক পশ্চিম দিকে আমি দাঁড়িয়ে আছি। দক্ষিণ দিকে চোখ যেতেই দেখলাম সকালের সেই ছেলেটা বসে আছে। তার হাতে হুমায়ূন আহমেদের মৃন্ময়ী বইটা। একটু এগিয়ে গেলাম…

– কি করছেন?

কথাটা বলা মাত্রই ছেলেটা তড়িঘড়ি করে আমার দিকে তাকালো। মনে হচ্ছে ভয় পেয়ে গেছে। হঠাৎ করে এমনভাবে এসে কেউ কথা বললে ভয় পাবারই কথা।

– বই পড়ছি। (ছেলেটা বলল)

ছেলেটার মুখের দিকে তাকালাম। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া। হাবাগোবার মত দেখতে, সহজ সরল একটা ছেলে। শুধু ছেলেটা ছেলেটা করছি কেন? ওর নামটা জেনে নিলেই তো হয়।

– আচ্ছা, আপনার নাম?
– আবির রহমান।
– আমার নামটা জানতে চাইলেন না যে?
– সরি, ফিরতি প্রশ্ন করার অভ্যাস নাই তো এরজন্য। আপনার নাম?
– মেঘমালা!
– আপনার নাম তো খুব সুন্দর!
– ধন্যবাদ। আপনি করেন কি?
– এমবিএ করছি।
– ওহ, আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার।

ছাদ থেকে নিচে নেমে আসলাম। কিছুই ভাললাগছে না। বারবার ছেলেটার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মস্তিষ্ক ভড় করে আছে, কেন যে এত ভাবছি সেটাই বুঝতে পারছি না। তাহলে কি আমি আবিরের প্রেমে পড়ে গেলাম। দূর..কি সব ভাবছি। কিন্তু মাথা থেকে আবির নামের ছেলেটা কে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। তার প্রেমে যে হাবুডুবু খাচ্ছি সেটা নিজেই টের পাচ্ছি। কিন্তু এখন করব টা কি? ওকে কি বলে দিব? কিভাবে বলব? আর একটা মেয়ে হয়ে আগ বাড়িয়ে বলাটা কি ঠিক হবে? রাতে ঘুমাতে পারিনি। বিছানায় ছটফট করেছি। ঘুম আসেনা। বারবার সেই মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ঘুম লেগেছে শেষ রাতের দিকে। যারজন্য সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারিনি। কলেজ যাওয়া ও হয়নি। রাত ভেবে ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আজই আবির কে বলব, আমার মনের কথা। না হলে এক মুহূর্তও ভাল থাকতে পারব না।

কফির মগটা নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। ছাদের দরজাটা ধরে ধাক্কা দিতেই, কেউ ও মাগো বলে চিৎকার করল। ততক্ষণে আমি দরজার ওপাশে চলে গেছি। আবির নিচে পড়ে আছে,, পাশে একটা বই পড়ে আছে, বইয়ের উপরে ভাঙ্গা চায়ের কাপ পড়ে আছে। ঠিক পাশেই চশমাটা.. সেটাও ভেঙ্গে গেছে। তড়িঘড়ি করে ছেলেটার হাত ধরে টেনে তুললাম। বেচারার কনুই থেকে রক্ত পড়তেছে, মনে হয় কেটে গেছে।

– সরি…
– না ঠিক আছে।

ততক্ষণে ছেলেটা আমাকে অবাক করে দিয়ে পকেট থেকে একটা গোলাপ ফুল বের করে বলল পাশে একটু জায়গা চাই! সেই প্রথম দিন থেকেই দেখে আসছি..তোমাকে। আমি ভালবেসে ফেলেছি! আমি লক্ষ্য করছি আমার চোখ দিয়ে অশ্রু বেয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে আনন্দে কাঁদতেছি। তার হাতটা ধরে আছি। একটা আলাদা অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই হাতটা সারাটা জীবন আমি ধরে রাখতে পারব। আর আমি ধরে রাখতে চাই। শত বিপদ আসুক… তবুও এই হাত, আর মানুষটা যেন হারিয়ে না যায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত