আম্মার চেঁচামেচিতে ভোরবেলা ঘুম ভাঙলো। কোন রকম মাথার উপর থেকে কম্বল সরিয়ে বললাম;
– ইশ! আম্মা সমস্যা কি? রাত তো ভালো করে পোহালো না। তুমি আর তোমার মা মিলে সকাল সকাল ওয়াজ নসিহত শুরু করে দিলা?
– তোমার তো রাত পোহাবে দুপুরে। এদিকে যে লঙ্কা কান্ড ঘটেছে সে খেয়াল আছে? সারারাত তো মোবাইলে ঢুকে থাকো।
– কি হয়েছে আবার?
– কোত্থেকে এক মেয়ে আইসা তর নাফিস মামাকে খুঁজতেছে।
– খুঁজতেই পারে। চেঁচানোর কি আছে?
– বলতেছে এটা নাকি তার বাড়ি।
– ওমা! টুইস্ট আছে তো, তারপর?
– তারপর আপনি উঠে দয়া করে সিনেমাটা দেখেন।
বারান্দায় এসে দেখি নানু এক হাজার একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে মেয়েটাকে। উঠোনে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে, পিঠে বিশাল একটা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। একদম মিষ্টি মেয়ে। শহুরে দামি পোষাক পরা। দূরে এডভ্যাঞ্চার ট্যুরে যেমনটা মানুষ প্রস্তুতি নিয়ে বের হয় এমন পোষাক পরিচ্ছেদ। তারপর নানুকে থামিয়ে আমি বললাম;
– আপনার নাম কি? কাকে চান?
– আমি বীথি, নাফিস খানকে খুঁজছিলাম।
– নাফিস খান আপনার কি হয়?
– উনি আমাকে চিনবেন। আমি কি ঘরে আসতে পারি ভাইয়া?
– আচ্ছা আসেন।
নানু চিৎকার দিয়ে বলতেছে, “হারামজাদা কে না কে ওই মেয়ে। তুই আমার ঘরে আনতেছিস ক্যান?” “আহ্ নানু! এই মেয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চা মেয়ে। দূর থেকে আসছে বুঝাই যাচ্ছে। ঘরে আসুক। এভাবে চিল্লাচিল্লি করলে মানুষ জড়ো হবে। কি ভাববে মানুষ?” যদিও মানুষ অলরেডি জড়ো হয়েই গিয়েছে। গ্রামের মানুষ একদম সুবহে-সাদিকে উঠে পড়ে। এর মধ্যে মামীও উঠে গিয়েছে। এবার মনে করেন পরিস্থিতি অন্যরকম হবে। এমনি মহিলাটা চব্বিশ ঘণ্টা তার স্বামীকে ক্যাচলানোর উপর রাখে।
বারান্দা থেকে ঘরে এসে দেখি মেয়েটা ব্যাগ ট্যাগ রেখে আমার বিছানায় উল্টে পরে ঘুমোচ্ছে! আম্মা কাছে গিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিলো। কী ঘটতে যাচ্ছে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। মেয়েটার বয়স পনেরো ষোল হবে আর নাফিস মামার বয়স চল্লিশ প্লাস। কি সম্পর্ক থাকতে পারে? মামী তো চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে। মামাকে ফোন দিয়েই যাচ্ছে, মামার ফোন বন্ধ। উনি অফিসের কাজে রাজশাহী আছেন। সকাল দশটার আগে ফোন খুলেন না। এদিকে মেয়েটার ব্যাগ চেক করার জন্য আম্মা প্রিপারেশন নিচ্ছে। আমি সাফ বলে দিয়েছি, “বোমা থাকলে কিন্তু ছাদ ছিড়ে সবার আগে উড়ে যাবা তুমি। এখন খুলো।” আম্মা ভয়ে একদম সোজা হয়ে গিয়েছে। মেয়েটার মুখের দিকে বারবার কাছে গিয়ে দেখছে আর বলছে, “কেমন যেন পরিচিত চেহারার মতো লাগছে। রবিন দেখতো তুই ভালো করে। সবাইকে টেনে বের করলাম রুম থেকে। একটা মেয়ে ক্লান্ত, ঘুমোচ্ছে। আগে উঠুক তারপর দেখা যাবে। সবাই টিভি রুমে বসে আছি। কেউ এখনো নাস্তাটুকুও করে নাই। অনেকক্ষণ পর মামার ফোনে কল ঢুকেছে। মামী কথা বলতেছে লাউড স্পিকার অন করে;
– হ্যালো সামিয়ার আব্বু, আপনি ফোন ধরেন না ক্যান? কোথায় আপনি?
– এইতো আমি রেডি হচ্ছি বাড়ি ফিরবো। ফোন অফ ছিলো। ক্যান কোন সমস্যা? মামী কাঁদো কাঁদো গলায় বলতেছে;
– বীথি নামের একটা মেয়ে তোমাকে খুঁজে বাড়িতে আসছে। এখন ঘুমোচ্ছে, যদি উল্টো পাল্টা কিছু হয় তাহলে এক সেকেন্ডও আমি এই বাড়িতে থাকবো না বলে দিলাম।
– এই কিসব বলতেছো? বীথি টিথি আমি চিনিনা। রবিনের কাছে ফোন দাও।
– হ্যালো মামা।
– এই গাধা বাড়িতে ডিম পারিস নাকি? কোত্থেকে মানুষ বাড়িতে ঢুকে দেখস না? তর হাড্ডি আমি আইসা ভাঙবো।
– হ’ আমারেই সুবিধে হয় তোমাদের। ছোট একটা মেয়ে। আমাদের সামিয়ার বছর চারেক বড় হবে। তোমাকে খুঁজে আসছে অনেক দূর থেকে। এখন কি ওরে মেরে তারিয়ে দিবো?
– আচ্ছা শুন সবাইকে ম্যানেজ কর। আর দেখ কোথা থেকে কে পাঠিয়েছে, আমি আসতেছি। দুপুর বেলা বীথি ঘুম থেকে উঠলো। সবাই দৌড়ে ওর রুমে চলে আসলো। আম্মাকে খুব সুন্দর করে বললো;
– ফুপ্পি ওয়াশরুম কোন দিকে?
আম্মা তো ওর মুখে ফুপ্পি ডাক শুনেই কাবু। সেই লেভেলের ইমোশনাল উনি। যাইহোক সবাইকে সরিয়ে ওকে ওয়াশরুমে দিয়ে আসলেন। ব্যাগ থেকে কাপড় চোপড়ও বের করে নিলো। এখন সবাই ওয়াশরুমের দরজার সামনে। মামী টেনশনে কাহিল হয়ে যাচ্ছে। কিছু বলতেছে না। এই মহিলা চেঁচানো শুরু করলে খবর আছে। তবে একটা ব্যাপার নোটিস করতে পারছি। মেয়েটাকে সত্যিই চেনা চেনা লাগছে। আমাদের নিজের মানুষই হবে। নানু এটলিষ্ট এতো তাড়াতাড়ি দমে যাওয়ার মানুষ না। উনি কিছু একটা গেস করছেন হয়তো।
অবশেষে বীথি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসলো। এখন মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা পরী বের হয়েছে। এতো মায়াবী একটা মেয়ে, চোখ সরানো দায়। খুব সুন্দর করে নানুকে বলতেছে, “আমার খুব খিদে পেয়েছে দাদীমা, কিছু আছে খাওয়ার?” নানু সত্যিই নরম হয়ে গেলো। কিচেনে গিয়ে এটা সেটা নিয়েও আসলো। এবার সোফায় বসে বসে খাচ্ছে। আমি শুধু তাকিয়ে দেখতেছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে বলতেছে, “রবিন ভাইয়া তুমি এখন কিসে পড়ো?” এই মেয়ে আমার নাম জানে কিভাবে? মানে সবাইকে চমকে দিচ্ছে! আমি বললাম;
– তুমি আমাকে চিনো?
– হুমম আমি তিনটা মানুষের নাম সবচেয়ে বেশি শুনেছি। এক কাজল ফুপ্পি, দুই রবিন পেটুক আর তিন দাদীমা। এই মেয়ে দেখছি ইজ্জতের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে! আমি যে পেটুক এটা অবধি জানে!
– আচ্ছা বীথি এবার বলো তো তুমি কে? কোথা থেকে আসছো? দেখতেই পারছো সবাই খুব টেনশনে আছে।
– নাফিস খান আসেননি? উনি আসলে উনিই আমার পরিচয় দিবেন। আর আমাকে নিয়ে ভয় পাবেন না।
তারপর মামীর দিকে এগিয়ে গিয়ে মামীকে জড়িয়ে ধরে বলতেছে, “আপনি একদম আমার মায়ের মতো, আমি আপনাকে আম্মি বলে ডাকবো কিন্তু।”
মামী মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তবে ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে কোন এক অজানা সংশয়ে এটা বুঝা যাচ্ছে। তারপর ব্যাগ থেকে একটা ট্যাব বের করে পিচ্চিদের নিয়ে খেলতে বসে গেলো বীথি। নাফিস মামার দুটো সন্তান। সামিয়া আর সামিন। সামিয়ার বয়স বারো বছর। আর সামিন নার্সারিতে পড়ছে। আমি কোন হিসেব মিলাতে পারছি না একদম। সবাই একটু স্বাভাবিক, যার যার কাজ করছে আপাতত। মামী আরো কাকে কাকে জানি ফোন করে বলতেছে ঘটনা। আমি বীথিকে নিয়ে ভাবছি। বীথিকে ডেকে রুমে আনলাম।
– বীথি তুমি আমার সম্পর্কে আর কি জানো?
– তোমার একটা ফটোগ্রাফ আছে আমার কাছে। যেটাতে তুমি অনেক ছোট, নেংটু হয়ে মাটিতে বসে দুধভাত খাচ্ছো। যে বাটিতে দুধভাত ওটাতে হিসু করতেছো আর ওটা থেকেই আবার ভাত তুলে খাচ্ছো। হাহাহা এই মেয়ে দেখি সাংঘাতিক! এই ফটোগ্রাফ আমি আমাদের ঘর থেকে কত কষ্ট করে গায়েব করেছিলাম। এটাও ওর কাছে আছে! কি ভয়ানক!
– এই এতকিছু কে বলেছে তোমাকে?
– কেনো আমার আম্মু দেখিয়েছে।
– তোমার আম্মু আমাকে কিভাবে চিনে?
– কারন আমার আব্বু তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসতো তাই।
– তোমার আব্বু কি করে চিনে আমাকে?
– খুব ভালো করেই চিনে। সবকিছু নাফিস সাহেব আসলেই উনি বলবেন। উনি জানেন।
– দেখো উনি কিন্তু তোমাকে চিনেন নাই।
– দেখলে চিনবে। আম্মু তোমাকে খুব দেখতে চায় ভাইয়া। উনার অনেক ইচ্ছে।
সেদিন রাতের বেলা মামা বাড়ি ফেরে। সবাই মামার দিকে তাকিয়ে আছে। মামা কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে একদম টিভি রুমে চলে আসলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এসে বললেন, “সবাই এতো চুপচাপ কেনো? কি হয়েছে?” সবাই বীথির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা অদ্ভুত ভাবে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো মামার দিকে। মামা তাকে বললো;
– তুমিই বীথি।
– জ্বি।
– কোথা থেকে আসছো?
– চট্টগ্রাম চকরিয়া।
– বাহ্ অনেক দূর থেকে। একা একা কিভাবে আসলে? আর আমার কাছে কি চাই?
– মা ট্রেনে তুলে দিয়েছে। আপনার কাছে কিছু চাইনা। আপনাকে দেখতে আসছিলাম শুধু।
– তোমার মায়ের নাম কি?
– সারাহ্।
– তুমি সারাহ্’র মেয়ে! দেখো কান্ড!
সবার উদ্দেশ্যে মামা বলতেছে, “আরে বীথি আমার ইউনিভার্সিটির বান্ধবীর মেয়ে। তোমরা কি কান্ডটাই শুরু করছিলা না চিনে।”
– কিছু খাইছো মামনি? তোমার মা বাবা কেমন আছে?
– জ্বি, দুজনেই ভালো। বাবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন। উনি দেশের বাইরে যাওয়ায় আসার সুযোগ পেলাম। মা ভালই আছে, আগের মতোই। অনেক কষ্টে ঠিকানা বের করে আসা হলো। মামা হাহাহা করে হেসে পুরো পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে ফেললেন। মামীও যেনো প্রাণ ফিরে ফেলো। যেই উঠে দাঁড়াবে সেই বীথি আবার বলে উঠলো;
– আমি আমার জন্মদাতা বাবাকে দেখতে এসেছি এখানে। আপনি আমার জন্মদাতা পিতা। মামা হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন;
– এসব কি বলছো বীথি?
– ইয়েস “বীথি” এই নামটি আপনি রেখেছিলেন। ভুলে গেলেন? আ’ম ইউর ডটার।
এবার বীথি কাঁদতেছে। মামা পুরো একটা শখ খেয়ে নিরব হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। মামী ঝটপট উঠে গিয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছে। আম্মা বীথির পাশে বসে বলতেছে; “তুই ভেবে বলতেছিস মা?” বীথি কেঁদে কেঁদে বলতেছে, “আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে তুমিই বলো না ফুপ্পি, কোনটা মিথ্যে।” আম্মা নিরব হয়ে গেলো। নানু মহিলাটা অনেক বুদ্ধিমতী, অনেক আগেই উনি সব বুঝে গিয়েছিলেন। একদম শান্ত হয়ে বসে আছেন। মামী তার বাচ্চা দুটো নিয়ে বের হয়ে গেলেন রাতেই। আর আমি, টায় দাঁড়িয়ে দেখছি সব। ঘোলাটে লাগছে সব কিছুই। কি একটা মূহুর্তে আমরা এতগুলো মানুষ এখন। মামা বীথির কাছে এসে বললেন, “তোমার মায়ের নাম্বারটা দাও।” নাম্বার টুকে ছাদে চলে গেলেন, আমিও আস্তে আস্তে পিছে পিছে গেলাম। কিছু শুনার চেষ্টা করছি। মামা কথা বলতেছে…
“সারাহ্ এতোদিন পর কেনো এমনটা হলো? ‘কি অপরাধের শাস্তি দিচ্ছো আমাকে? ‘মানে কী, বাচ্চা মেয়ে নিজে নিজে এসব করবে? ‘আচ্ছা মানলাম, তাই বলে আমি জানিনা কেনো? ‘খুঁজ নিয়েছো, পাওনি এসবের মানে কি? ‘মেয়েটাকে এভাবে একা পাঠিয়ে দিলে? ‘না তোমাকে আসতে বলছিনা, বাট, সারাহ্ সারাহ্! হয়তো ওপাশ থেকে কলটি কেটে দেয়া হয়েছে। আমি নেমে আসলাম দ্রুত। সবকিছু এখন বুঝতে পারলাম। মামা সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে বাইরে চলে গেলো। আম্মা বীথিকে বুঝিয়ে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। আমি কি করবো কি করা উচিত তা জানিনা। বীথির খাওয়া শেষে ওকে নিয়ে ছাদে আসলাম। কোথা থেকে শুরু করবো তাও বুঝতে পারছি না;
– বীথি, মামী আমাকে দেখতে চায়?
– হুমম।
– কেনো?
– বাবা তোমাকে ভালোবাসে নাকি খুব। তোমার জন্মের পর সিলেট থেকে অনেক মিষ্টি কিনে নিয়ে আম্মুকে খাইয়েছে। আরো অনেক কথা শেয়ার করেছে।
– মামী খুব সুন্দর। তাইনা? তোমার মতো?
– আমিতো বাবার মতো অনেকটা। আম্মু অনেক কিউট।
সেদিন আমি একা ছাদে অনেক সময় কাটালাম। হঠাৎ দেখি মামা ঘরে ঢুকছে। আস্তে আস্তে আবার পিছে গেলাম। দেখি বীথির রুমে ঢুকে মাথার কাছে বসে বীথিকে দেখছে আর চোখ মুছছে। কতো অদ্ভুত জীবন! একটা অপরাধী বাবাকে আমি দেখছি। তারপর মামা বীথির গায়ে চাদর টেনে দিয়ে চলে আসলো। পরেরদিন বীথি সারা বাড়ি, এলাকা, চায়ের বাগান সবখানে চষে ঘুরে বেড়িয়েছে। খুব স্মার্ট। অল্পতেই সবাইকে অদ্ভুতভাবে আপন করে নিচ্ছে। সবকিছুই একটা খাপ ছাড়া স্বাভাবিক শান্ত ছিলো। সেদিন বীথিকে নিয়ে সবাই অনেক আড্ডা আর খানাপিনা হলো। মামা এখনো আর কথা বলেননি বীথির সাথে। তারপরদিন মামী তার বাবার বাড়ির লোকজন নিয়ে হাজির। উঠোনে বিচার ব্যবস্থা বসানো হলো। পঞ্চায়েতের মুরুব্বীরা বললো, “নাফিস, তুমি এলাকার শিক্ষিত ছেলে ছিলে। তোমার কাছ থেকে এমন কিছু আশা করিনি আমরা। এখন শুধু এটা বলো, মেয়েটার বাবা তুমিই নাকি?” নাফিস মামা কারো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বীথির কাছে আসলেন। এসেই হাঁটু গেড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন আর বলতেছিলেন;
– মা’রে আমাকে মাফ করে দে তুই। আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলছি। আমার কলিজার ধনকে আর হারাতে দিমু না। আর না। আমায় মাফ করে দে,
বীথি তার বাবাকে তুলে জড়িয়ে ধরলো। তারপর কোন রকম কান্নাটাকে গিলে ফেলে সবার উদ্দেশ্যে বললো, “সবাই আমার বাবাকে ক্ষমা করে দেন। আম্মি তুমিতো আমার দ্বিতীয় মা, তুমিও আমার বাবাকে ক্ষমা করে দাও। আজ থেকে আঠারো বছর আগে বাবা আমার মাকে ভালবেসে নিজেরা নিজেরা সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছিলেন। জানিনা শরিয়া মোতাবেক এটা কতটা যৌক্তিক ছিলো। তবে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য মনকে “এটাই সত্য” বলে বুঝাই। আমি মায়ের গর্ভে এসেছি এটা জানার পরেই বাবা মাকে একটা চিরকুট লিখে চলে এসেছিলেন। আমার কাছে আছে সেটা। চিরকুটে লিখা ছিলো, “সারাহ্ আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। বাবা মারা গিয়েছেন, পরিবারে সবাই তিনবেলা ভাত খাওয়ার মতোও অবস্থায় নেই। আমার কিছু করা লাগবে। তুমি আমাদের বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলো। আমাকে ভুলে যাও আর ক্ষমা করে দিয়ো।”
আমার মা আমাকে নষ্ট করেন’নি। একবার নাকি আমার বাবা আমার মায়ের কোলে মাথা রেখে বলেছিলো, “সারাহ্ আমার যদি একটা মেয়ে হয় তার নাম রাখবো ‘বীথি।’ আমার মেয়েকে একটা আঁচড়ও দিতে দিবো না তোমাকে।” আমার মা এই কথাটি রাখতে পৃথিবীতে আমাকে নিয়ে আসছিল। আমি এটার প্রমান দিতেই আসছি। আমি আমার বাবাকে নিয়ে যেতে আসি নাই। কোন স্বত্বার দাবীও করতে আসি নাই। আমার আরেকটা বাবা আছে যিনি আমার মাকে ঐ কঠিন মূহুর্তে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনিই আমার বাবা। আজ অবধি বাবার কোন কিছু ঘাটতি রাখেননি। আমি সত্য ঘটনাটা ভুলে না জানলে কোনদিন টেরও পেতাম না আমার জন্মদাতা আরেকজন। আমার বাবাকে আমি লুকিয়ে এখানে এসেছি। আপনাদের সবাইকে খুব মিস করবো। আমি আর আসবো না। চলে যাচ্ছি।
এটা বলেই ঘরে ঢুকে ব্যাগটা নিয়ে বীথি বেড়িয়ে পড়লো। সবাই চোখ মুছতেছে আর কাঁদতেছে। এটাকেই হয়তো বলে ‘জীবন নাটকের চাইতেও নাটকীয়।’ আমার মা পাগলের মতো বীথিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাচ্ছেন। মামা অসহায়ের মতো মাটিতে বসে আছে। নানু এই প্রথম দেখছি বাকশক্তি যেনো হারিয়ে ফেলেছেন। শুধু অশ্রু ঝড়তেছে চোখ বেয়ে। মামী নিজেও কাঁদতেছে। বীথির মা মানে আমার ওই মামী নাকি আমাকে খুব ভালোবাসে। আমাকে নাকি দেখবে, এটা বীথি বলেছিল। আমিও ঘরে ঢুকে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বীথির সাথে। পেছনে একটি বারের জন্যও বীথি থাকায়নি। সারা গায়ের মানুষ জড়ো হয়ে চোখ টিপে কাঁদতেছে। বাচ্চা মেয়েটাকে সৃষ্টিকর্তা কতোটা ধৈর্য্য দিয়ে পাঠিয়েছেন ভাবছি আর হাঁটছি।