ইচ্ছের মৃত্যু

ইচ্ছের মৃত্যু

চারমাসও হয়নি, সেতু মৌয়াজের বউ হয়ে এসেছে। মাত্র বছর কুড়ি বয়স তার। এখনো পড়া লেখার মধ্যেই আছে। মৌয়াজ তাকে, ঘরের কাছের কলেজে ভর্তি করে দিয়েছে, যদিও প্রতিদিন ক্লাস করা হয়না।

মৌয়াজ দেশেই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, শিক্ষিত।
এমন প্রস্তাব পেয়ে সোবহান সাহেব, সেতু’র বাবা, আর না করেননি। মেয়ে দেশেই থাকবে, স্বামী’র পাশেই থাকবে। সুখে দু:খে মা বাবার কাছেও আসতে পারবে, আর কি চায়!

দুই তিনবছর ধরেই প্রস্তাব আসছে সেতু’র জন্য, মেয়ের চেহারা সুরুত মাশাআল্লাহ ভালোই, তাই হয়তো।
তবে বেশিরভাগই প্রবাসী।

প্রবাসী তিনি নিজেও। বছর দুইবছর পর দেশে আসেন বউ ছেলে মেয়েকে কাছে পেতে। বিদেশে বউবাচ্চা নেয়ার মতো, অতো সামর্থ্য নেই তার, অনেক খরচ সেখানে!

তাই তার প্রবাসী ছেলে পছন্দ নয়, ঘরের বিপদে দৌড়ে আসতে পারেনা তারা।
মা বাবার মরা মুখটাও তিনি দেখতে পারেননি, খুব আফসোস হয় তার!
সোবহান সাহেবের অনেক বন্ধু, বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন। যারা বড় চাকরি করেন, ভালোভাবেই আছেন। আর যারা তার মতো মোটামুটি, তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

সোবহান সাহেব তাই মেয়ের পড়া শেষ হবার অপেক্ষা করেননি। এমন প্রস্তাব প্রতিদিন আসেনা। ছেলের বয়স মেয়ে হিসেবে একটু বেশিই। কিছু করার নাই, প্রতিষ্ঠিত হতে হলে বয়স তো হবেই। দেশের যে শিক্ষা ব্যবস্থা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করে বের হতে হতে ত্রিশ!
মৌয়াজ এরও বত্রিশ হলো, মেয়ের বারো বছরের বড়!

সোবহান সাহেবের স্ত্রী, মরিয়ম, বাইশ বছর আগে তাদের বিয়ে, উনার চেয়ে দশ বছরের ছোট। তার যখন আটাশ, মরিয়মের ছিলো আঠারো ।
সেজন্য মনে মনে জামাইর বয়স নিয়ে একটু দোনামোনা ভাব আনতেই মরিয়ম তা এক জাপটাই ফেলে দিলো।

-আল্লাহ যদি এখানে তার বিয়ে লিখে রাখেন, তবে তুমি অসন্তুষ্ট হয়ে আর কি করবে! তাছাড়া ছেলে দেখতে ত্রিশও মনে হয়না! শিক্ষা আছে, সুন্দরও আছে, টাকা পয়সা আছে, দেশে থাকে, ছোট পরিবার, আর কি চাও?
তোমার মেয়েও তো রাজকন্যা নয়!

শেষে ভালোই ভালোই বিয়ে দিলেন।
কিন্তু সেতু যেন খাপ খেতে পারেনা। মৌয়াজ বর হিসেবে খুবই ভালো। একে অপরকে বুঝতে পারে, বয়সটা তাদের মধ্যে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

কিন্তু পরিবারের অন্য সবাই যেন কেমন! খারাপ ব্যবহার ঠিক তেমন করে কেউ করেন না। কিন্তু শতভাগ আন্তরিকও নন কেউ ।
সেতু বরাবরই কাজকর্মতে একটু আনাড়ি। মায়ের প্রথম এবং একমাত্র মেয়ে বলে কাজে খুব বেশি হাত দেয়নি। রান্নাবাড়া তো বলতে গেলে করেইনি।

আসলে নিজেদের ঘরে সে মাঝেমধ্যে ঘর গুছানো, আলমারি গুছানো ছাড়া আর কোনো কাজই করেনি।
কিন্তু শ্বশুরঘরে সবাই বউ থেকে পারফেক্ট কাজ আশা করে। সে ধীরস্থির করে গুছিয়ে কোনো কাজ করতে গেলেই ধমক খাচ্ছে।
-এতো সময় নিয়ে কাজ করলে তো সারাদিনেও শেষ হবেনা। এসব তো কামচুরি!
সেতু কিন্তু সবার মন জয় করার জন্য, নিজেকে পারফেক্ট প্রমাণ করার জন্য খুব চেষ্টা করছে।
ভোরে উঠে সবার জন্য রুটি বানাতে বসে। শ্বাশুড়ি দেখেই বলেন,
-থ্যাবড়ানো মুচড়ানো এসব কি বানাও! গোল গোল বানাও।
ওর খুব ইচ্ছে করে বলতে,
-মা শিখিয়ে দেননা।
বলা হয়না, হয়তো জবাবটা তার পছন্দ হবেনা।
তিনি তো নিজে থেকেই বলতে পারতেন,
-রাখো তো বউ, আমি দুইটা করে দেখাই,তারপর বানাও দেখি কেমন হয়!
ভুলটা দেখিয়েই দিলেন, শুদ্ধটা কি হবে তা বলেননি।

তার এক দেড়বছর আগে আনা বড়বউ, ভাবিটাও যেন কেমন। সেতু বারবার তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ান, বন্ধুত্ব করবে বলে, কিছু শিখবে বলে। কিন্তু সে তাকে এড়িয়ে চলে, পাত্তা দেয়না।

তিনি সবার মাথার মনি হয়েই আছেন। হবেনই বা না কেনো? সব কাজে পারদর্শী, তাছাড়া বছর ঘুরতেই ফুটফুটে একটা পুত্র সন্তান যে উপহার দিয়েছেন।

এখন সবাই সেতু’র দিকে তাকিয়ে আছে। কাজে কর্মে মন জয় করতে পারেনি সে, প্রথম সন্তান পুত্র হলে, সেই বদনাম হয়তো কিছু গুছবে।
হ্যাঁ, একমাস পার হয়েছে তার প্রেগন্যান্সি’র।
সবাই বলাবলি করছেন,
প্রথম সন্তান ছেলে হলে নিশ্চিন্ত, আর কোনো সন্তান না হলেও সমস্যা নেই।
সে এইসব শিক্ষিতগুলোর মাঝে কাকে বুঝাবে, ছেলেমেয়ে সব আল্লাহ’র ইচ্ছায় হবে।
তাছাড়া সবাই জানে, যদি এতে দোষ বা দায়ী কেউ হয়ে থাকে তবে সে নারী নয় পুরুষ!
সবাই জানে, কিন্তু মানতে চায় না, সে নারী হলেও না।
সেতু’র খুব শখ, তার পুতুলের মতো একটা মেয়ে সন্তান হবে, সে তাকে প্রতিদিন সুন্দর সুন্দর সব জামা পরিয়ে সাজাবে।
কিন্তু ইচ্ছেটা মনের গভীরে লুকিয়ে সেও হয়তো চায়, থাক, একটা ছেলে সন্তানই আসুক। তারও তো সবার আদর ভালোবাসা আর মনোযোগ পেতে মন চায়!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত