শ্যামলা মেয়েটি এতো পছন্দ হয় সানজিদা’র! ছেলে রবিন এর পছন্দ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে সেও মাথা নেড়ে সায় দেয়।
তাদের এক ছেলে রবিন, আরেক মেয়ে রিংকু।
সুন্দর পরিপাটি অনুষ্ঠান এর মধ্য দিয়ে বউ হয়ে আসে নূপুর। অনুষ্ঠান নূপুরের পরিবারে নয়, সানজিদা আর তার বর আরিফ সাহেবই করেন।
আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশীতে ঘর ভর্তি।
একেকজন একেক মন্তব্য করেন,
-এসব তো আগের ফার্নিচার, বউয়ের বাপের বাড়ির গুলো কই?
-কেনো আপা, আমাদের আল্লাহ’র রহমতে যা আছে,তা দিয়েই তো ঘর সুন্দর সাজানো আছে, ওদের গুলো দিয়ে কি করবো, তাই বারণ করে দিয়েছি।
সানজিদা জবাব দেয়।
-বারণ করেছেন, কি বলেন! অনেকে অবশ্য ওসবের বিনিময়ে টাকা নিয়ে নেয়।
-হয়তো নেয়, আমাদের তো তার প্রয়োজন নেই। আপনিও কি নিতেন আপা? সানজিদা জানতে চায়।
-বারে, আমি নিতে যাবো কেনো?
-আচ্ছা, অনুষ্ঠান ওদের পক্ষেরটা কখন হবে? এমনিতে তো, আজকের বিয়ের খাবার মেয়ের পক্ষেই হয়, তোমরা এমন করলে কেনো?
-মেয়েকে লিখিয়ে পড়িয়ে উপযুক্তা করে আমার ঘরে পাঠাচ্ছেন, আবার এতো এতো টাকা নষ্ট করে সবাইকে খাওয়াবার দরকার আছে কি ভাবী?
-কেনো, তোমরা বুঝি পড়াওনি?
-হ্যাঁ পড়িয়েছি, টাকাও উপার্জন করছে আমার ছেলে। আর এই অনুষ্ঠান ধর্ম মতে ছেলের ঘরেই করে, ওলিমা বলা হয় তাকে।
-অহ তাই!
-কাবিন কতো ছিলো বিয়ের?
-১০ লাখ।
-এতো কম! ২০/৩০ লাখের নিচে আজকাল ধরে নাকি কেউ? এতো কম দিলে কেনো?
-জ্বি, ২০/৩০ লাখ যারা ধরেন, তাদের তা বাকি’র খাতায় লেখা থাকে। আমরা নগদ সামর্থ্যানুযায়ী যতো টুকু দিতে পারবো, তা দিয়েই এনেছি।
-সব টাকা দিয়ে দিলে!
-হ্যাঁ, দিয়েছি। আপা, টাকাটা তো নগদ দিয়ে দেওয়ায় নিয়ম…
-তাই নাকি? কই আমরা তো দিইনি। আর, তোমার ভাই সাহেবও তো আমাকে এখনো দেয়নি।
তা কালো বউ আনলে কেনো?
-আপা, আমি আনিনি, ওদের জোড়া অনেক আগেই তৈরি হয়েছে। এই মেয়ে আমার ছেলের জন্যই সৃষ্টি, আর কাউকে ধরে আনলে কি হবে?
-এরপরও রঙ কালো, সব ছেলে মেয়ে যদি মায়ের মতো কালো হয়!
-সেটাতো কেউ জানিনা এখনো। আর ওর গায়ের রঙ দেখলেন, সুন্দর মায়াময় চেহারা দেখলেন না, শিক্ষা দেখলেন না!
-চেহারা সুন্দর নাকি?
-আলহামদুলিল্লাহ অনেক সুন্দর। ওকে আমরা সবাই পছন্দ করেই এনেছি। আর চেহারা সুন্দর না হলেও যার আসার সেই তো আসতো আপা। তাই না?
-হুম।
বিয়ের তিন দিন পর,
নতুন বউ, নূপুর বলে
– মা, আজ আমি রান্না করি?
-তুমি রাঁধতে পারো?
-কিছু কিছু পারি, বাকিটা আপনি না হয় শিখিয়ে দিলেন।
-ঠিক আছে।
ঠিক তখনই একজন প্রতিবেশী’র আগমন।
-বউ আনতে না আনতেই কাজ ধরিয়ে দিলে?
-না আন্টি, আমি মায়ের কাছে শিখতে এসেছি।
-ভালো ভালো।
-তা কি রাঁধছো?
-চিংড়ি মাছ দিয়ে কাকড়োল, মুরগি আর পটল ভাজি করবো ভাবি। সানজিদা জবাব দেয়।
-বউ কিভাবে কুটছো কাকড়োল! চিংড়ি দিয়ে এমন কুটে? প্রতিবেশী আন্টি হায় হায় করে উঠেন।
-আন্টি, আমি জানিনা।
-কেনো, তোমার তো যথেষ্ট বয়সে বিয়ে হয়েছে..মায়ের কাছে কিছু শিখোনি?
-ভাবী, আপনার আমার মেয়েই বা কয়টা কাজ করে ঘরে? সময় কই তাদের, এতো এতো পড়ালেখা, কোচিং….
কিচ্ছু হবেনা নূপুর। দাঁড়াও, আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।
শ্বাশুড়ি, সানজিদা বলেন।
-আচ্ছা, মা।
-জানো নূপুর, আমি যখন প্রথম এই ঘরে বউ হয়ে আসি, কিছুই জানতাম না, বলতে গেলে।
শুঁটকি দিয়ে কাকড়োল রান্না করতে হলে কিভাবে কুটতে হয়, তাও জানতাম না। এক তরকারি নানা স্টাইলে কুটতে হয়, তাই জানা ছিলোনা আমার।
-তোমরা রাঁধো, আমি যাই।
-চা খেয়ে যান ভাবী।
-আরেকদিন খাবো।
-তারপর মা?
-কি?
-আপনিও জানতেন না..
-অ হ্যাঁ, একদিন একজন খুব করে লজ্জা দেয়। পুকুরে নিচ্ছিলাম ধুতে, সে সবাইকে আমার কুটা তরকারি দেখিয়ে খুব হাসাহাসি করেছিলো, অথচ শিখিয়ে দেয়নি।
-আপনি রাগ করেননি?
-মনে মনে করেছি, নতুন বউয়ের কি রাগ দেখানো চলে?
-তারপর?
-তারপর আর কি, লজ্জা পেলাম, আস্তে ধীরে শিখলাম।
আমি তখন মুরগি কিভাবে পিস করে তাও জানতাম না। জা’য়ের মেয়ে, প্রায় আমার সমবয়সী ছিলো। সে তার মা কিভাবে পিস করে তা দেখে এসে আমাকে শিখিয়ে যেতো।
-মা, আমিও মুরগি ভালো পিস করতে পারিনা! সুন্দর কম হয়।
-সমস্যা নেই, আস্তে আস্তে সব শিখে যাবে।
কেউ তো আর মায়ের পেট থেকে শিখে আসেনা।
-হুম। আচ্ছা মা, আপনার কি ছোটকালে বিয়ে?
-না বউমা, আমার তখন একুশ বছর বয়স।কলেজে পড়তাম। পড়াবস্থায় বিয়ে। বাপের বাড়িতে কুটাবাছা করিনি, তবে অন্যান্য কাজে মাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম।
-মা, আমিও ঘর গুছাতে পারি ভালো। বাসার সবার কাপড় আয়রন করে দিই।
-খুব ভালো তো। আর
তুমি যদি রান্না শিখতে চাও, তবে বলো, কোথাও রান্না শেখানোর কোর্স করতে ভর্তি করে দেবো। ইচ্ছে আছে?
-না, মা।
-আমারও রান্না বান্না’র প্রতি কোনো আগ্রহ ছিলো না কোনো কালে।
-সত্যি?
-হুম।
তা তুমি কি ঘরে বসে থাকবে এতো পড়ে, নাকি কাজ টাজ কিছু করবে?
-মা, আগামী মাসে, আমার কয়েকটা ইন্টার্ভিউ আছে, আগে দেখি, কি হয়।
-ঠিক আছে। তার আগে কোথাও হতে বেড়িয়ে আসো কয়দিন। কাজে ঢুকে গেলে আর বেড়াতে পারবেনা।
-না মা, কোথাও যেতে হবেনা, লজ্জা পেয়ে বলে সে।
-অবশ্যই যেতে হবে। সাতাশ বছর আগে আমরা গিয়েছি, আর এখন তোমরা যাবেনা! কি বলো! আমি রবিনকে বলে দিচ্ছি। যতোদিন খুশি ঘুরে আসো। সময়টা চলে গেলে আর পাবেনা।
– জ্বি আচ্ছা। মা, আপনারা কোথায় গিয়েছেন বিয়ের পর?
-আমরা কক্সবাজার গিয়েছিলাম। তখন ওখানেই প্রায় সবাই যেতো।
-তাহলে আমরাও যাই?
-বারে, আরো কতো জায়গা আছে! তোমরা দুইজন পরামর্শ করে ঠিক করো।
আরো কয়দিন পর, নূপুর, সানজিদাকে বলে,
-মা, আমার আম্মুরা নাকি আসবেন, ঘন্টাখানেকের ভেতর। এদিকে কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলেন বললেন।
-আচ্ছা, সমস্যা নেয়। আসো, আমরা তাড়াতাড়ি কিছু নাস্তা বানিয়ে নিই।
দুইজন ফ্রিজ থেকে সমুচা, রোল নামিয়ে ভেজে নেয়। দোকান থেকে কিছু কেক, মিষ্টি খাবার আনিয়ে নেয়।
ওরা আসতে আসতে টেবিল ভর্তি।
-এতো খাবার কেনো বেয়াইন!
নুপূরের মা অবাক হয়ে জানতে চায়।
-এতো কই দেখলেন, হঠাৎ আসছেন শুনে আমরা দুইজন যা পারি করলাম।
খাওয়া দাওয়া শেষে সানজিদা নূপুরকে বলে,
-যাও, তোমার মা বোনকে তোমার রুমে নিয়ে যাও। কতোদিন পর দেখলে একটু সুখ দু:খের কথা জানতে চাও, যাও।
-না, মা, এখানে ঠিক আছি।
-রুমে নিয়ে যাও তো। আমি ততোক্ষণে কাজ কিছু গুছিয়ে নিই।
আর অবশ্যই রাত্রে খেয়ে যাবেন আপনারা, যা আছে তা দিয়েই না হয় খেলেন। সানজিদা বেয়াইনকে বলে।
-মা, কাজ রেখে দিন, আমি করবো।
-তুমি আগে তোমার পরিবারকে সময় দাও।আমি বুলবুলি মাকে ফোন করে দেবো ,এসে সাহায্য করবে।
বউয়ের চাকরি হয়। পুত্র আর বধূ দুইজনই একসাথে কাজে বেড়িয়ে যায়। বিকেলে বউ এসে শ্বাশুড়ি’র কাছ থেকে কাজ কেড়ে নিতে চায়। আর শ্বাশুড়ি চায়, বউ একটু রেস্ট নিক, যেমন তার ক্লান্ত ছেলেও নিচ্ছে।
যেমন করে, কলেজ থেকে এলে তার মেয়েটি বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। পরের মেয়েটিও তো একজন মানুষ। তার অন্য সন্তানদের মতো তারও ক্লান্তি আসে নিশ্চয়, বিশ্রামেরও প্রয়োজন হয়।
আর বউ ভাবে, তার শ্বাশুড়িকে কাজে সাহায্য করা দরকার, তাকে কিছু সময় দেয়াও দরকার গল্প করার জন্য।
সে যখনই সময় পায়, স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ননদ সবার মন জয় করে চলার চেষ্টা করে।
ননদ রিংকু ভাবী’র কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে মাঝেমধ্যে ভুল ধরার চেষ্টা করলে, সানজিদা নয়তো আরিফ সাহেব বকা দিয়ে উঠেন।
-সে তোমার সম্মানে আর বয়সে সবদিকে বড়। ভুল করতেই পারে, সবাই পারফেক্ট হয়না।তুমিও নও, আমিও নই। সবকিছু শিখতে একটু সময় লাগবেই। রাগ করোনা মা, তুমি ছোট, ছোট’র মতোই থাকো। শেখাবার দায়িত্ব আমাদের।
আরেকটা কথা, তোমার বিয়ের পর, তোমার ননদ তোমাকে ছোট করে কিছু বললে তোমার কেমন লাগবে?
রিংকু বুঝতে পারে হয়তো। চুপ করে থাকে। ভাবি, নূপুরের সাথে বন্ধুত্ব পাতায় সে। এইভাবে সুখেই দিন কাটে সানজিদা’র পরিবারে। এখন সানজিদা ভাবে, তার এক মেয়ে নয় দুই মেয়ে, একছেলে।