অফিস থেকে ফিরলাম, অস্বস্তি লাগছে। মনকে ডাক দিলাম, কোন সাড়াশব্দ নেই। এর কারণ আমি জানি। আজ মনের মন খারাপ, কথা দিয়েছিলাম তাড়াতাড়ি বাসায় আসবো, তাও লেট হয়ে গেলো। অফিসে হুট করে একটা বাইরের ক্লায়েন্ট আসায় ঝামেলায় পড়ে গেছিলাম তারউপর জ্যাম, তাই আরকি।
“মন” আমার মেয়ে, মানে আমার পৃথিবী। আমার মেয়েটা খুব বাবা ভক্ত জানেন? আমায় ছাড়া কিছুই বুঝে না। আমিই তার বাবা আবার আমিই তার মা। ভালোই লাগে, মাঝে মাঝে ভাবি মন না থাকলে আমি কাকে নিয়ে বাঁচতাম। কার কথা বলছেন? ওর মা কোথায়? জ্বি বলছি, আসলে আমার মেয়ের আগে ওর মা ছিলো আমার অর্ধেক পৃথিবী আর বাকি অর্ধেক ছিলো মন। আজকে পুরো পৃথিবীটাই আমার মেয়ে।
জীবনের রেসিপিটা এতো ইজি না। এই যেমন তেল মসলা নুন সবজি হলেই হয়ে গেলো নিশ্চিত কিছু এমনটা না। এই রেসিপিটা আমরা কেউ বুঝিনা। কখন সুখ আসে আবার কখন দুখ আসে বলা মুশকিল। কার স্বাদ কতখানি তাও বলা মুশকিল। সুখ চিরস্থায়ী না এটা বলতে পারবো নিশ্চিত হয়ে।
আনিকা হঠাৎ করেই আমার জীবনে এসেছিলো। আমাকে রাঙিয়ে দিয়েছিলো অদ্ভুত সুখ আর ভালোবাসায়। আবার একদিন এভাবেই জীবন থেকে চলে গিয়েছিলো, তখন না ছিলো সুখ না ছিলো ভালোবাসা। আমি জীবনের সমীকরণ উপলব্ধি করতে পারতাম জানেন? আমি বলতাম আনিকাকে, “তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবা না’তো? আমি কিন্তু মরে যাবো।” আনিকা বলতো, “যেতে যেতেই যখন ফিরে আসছি আর যাবো’না।” তাও একদিন আনিকা ঠিক’ই চলে গেলো, আর আমিও বেঁচে আছি। হাহাহা রেসিপিটা বুঝেছেন? নাহ্ এখনো বোঝেন নি। শুনেন আমার জীবনে সুখ চিরস্থায়ী হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয় মরে গেলেই তো বেঁচে যাই। আবার ভাবি মরার জন্যই তো বেঁচে আছি। আবার ভাবি আমার মন’টার জন্য বেঁচে থাকা চাই।
আমি খুব অগোছালো ছিলাম। পড়াশোনা শেষ করে আবার চাকুরী করার জন্য পড়বো? এটা আমার দ্বারা সম্ভব হয়নি। মাস্টার্স পর্যন্ত পড়ে মনে হইছিলো অর্ধেক জীবনটা’ই বিনাশ করলাম, আর না। আর এর ফলে কোনো চাকুরীও জুটে নি কপালে। একটা দূরসম্পর্কের মামা পাঠাও রাইডস’এর সাথে আলাপ করে আমাকে রোজগার করার একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। আম্মা আব্বু আর খরচ দিতে পারছিলো না। অবশ্য আর কতো! মাস্টার্স কমপ্লিট একটা ছেলে আমি। পুরোদস্তুর দায়িত্ব কাঁধে থাকার কথা।
একটা বাইক কিনে হয়ে গিয়েছিলাম পাঠাও রাইডার। একদিন হঠাৎ করে রিকোয়েস্ট আসলো আনিকার। সে’ই ছিলো আমার প্রথম ফিমেল প্যাসেঞ্জার। ওরে ফোন করেছিলাম উনত্রিশবার। মেয়েটা এতো ছটফটে, আমাকে এক যায়গায় আসতে বলে ও আরেক জায়গায় রিক্সা নিয়ে গিয়েছিলো আরেক কাজে। আমি শেষমেশ বিরক্ত হয়ে ওকে খুঁজে পেয়েছিলাম। মেজাজ আরো গরম হচ্ছিলো যখন বললো, “যেখানে খুশি নিয়ে যান।” আমি রেগে’ই বলছিলাম, তো এতোক্ষণ ঘুরালেন ক্যান? ও উল্টো ধমক দিয়ে বললো, “প্যাসেঞ্জারের সাথে এভাবে বিহ্যাভ করেন? টাকা লাগলে আমি দিবো। যেতে থাকেন।” বুঝেছিলাম মুশকিল ঘাড়ে চেপেছে। সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরলাম। তারপর সন্ধ্যায় বললাম হয়েছে এবার সঠিক করে বলেন কোথায় নামিয়ে দিয়ে আসবো। তখন যা বললো তাতে আমার মাথায় বাজ পড়লো।
আনিকা বললো, “আমি বাসা থেকে পালিয়ে আসছি।” আমি বাইক স্টার্ট দিয়ে বললাম, আপনি থাকেন আমি গেলাম। ও বললো, “প্লিজ দাঁড়ান, আপনার কোন সমস্যা হবেনা আমি বাসায় বলছি আজ বান্ধবীর বাসায় যাবো। এটা বলে আসছি, সো আজকে কেউ খুঁজবে না। আমার জমানো আর হালকা লুকিয়ে লাখ দুয়েক টাকা’ও আনছি এই দেখেন, সব আপনি নিয়ে নেন।” শেষমেশ টাকার কথাটা শুনে এক মিনিট ভাবলাম। বাইক কেনার কিস্তি রয়ে গেলো। ধার অনেক টাকা রয়ে গেছে, বাড়ির অবস্থা ভালো না। বাড়িতে’ও টাকা পাঠানো লাগবে। লোভ হলো, অভাবে স্বভাব নষ্ট যাকে বলে। ভাবলাম মুরগি পাইছি। সব ভেবে বললাম, “তাহলে কোথায় যাওয়া যায় আসেন যাই।”
আনিকার বাবার প্রচুর টাকা আছে বুঝাই যাচ্ছিলো। আমরা বাইক রেখে সেদিন রাতেই বাসে করে কক্সবাজার রওনা দিলাম। জানিনা কোন ভরসায় আর কিসের জন্য এতবড় রিস্ক আমি নিয়েছিলাম। আমি এমনটাই ছিলাম, এতো ভাবতামনা কিছুই। ভাবলে হয়তো আনিকাকে পেতামনা। আর আনিকা কোন কারণেই’বা আমাকে এতোটা বিলিভ করলো তাও জানিনা । আমরা পরের দিন পুরোটা সময় সমুদ্র সৈকতে কাঠিয়েছি। আনিকার উৎসাহগুলো ছিলো মুক্ত পাখির মতো। যেনো খাঁচা থেকে বহুকাল পর মুক্তি পেয়েছে। মেয়েটা খুব সুন্দর করে হাসতে পারতো। ওর হাসিটাই আমি দেখতাম বেশি। প্রথম প্রেমে পড়ি ওর হাসির। সন্ধ্যায় একটা হোটেলে ফিরলাম। ব্যাপার ছিলোনা, আমার একটা ফ্রেন্ড হেল্প করছিলো। দু’জন এক রুমেই। আমি আনিকাকে আশ্বস্ত করছিলাম, “আনিকা আপনি ভয় পাবেন না। আমি সোফায় শুবো, আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান বেডে।” ও বলেছিল, “আমি আপনাকে চিনি। যতটুকু চিনতে পেরেছি ততটুকুতেই রিস্ক নেয়া যায়। আপনার নাম নাম্বার দুটো ফেসবুকে সার্চ করে আপনার বায়োডাটা, আপনার লিখা গল্প এসব পড়েছি আর আপনাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছি ততক্ষণ। তারপর নিশ্চিত হয়েই আপনাকে নিয়ে পালাবো এই ডিসিশন নিয়েছি। এটা বলেই আনিকা হাসতে ছিলো। ওর হাসি দেখে ভুলেই গিয়েছিলাম কোন বিষয়ে আমরা ছিলাম।
মধ্যরাতে আনিকাকে ঘুম থেকে তুলে বললাম, “একটা জায়গায় যাবেন?” ও সম্ভবত ঘুমাচ্ছিলনা, এক ডাকেই উঠে বসে বলছিলো আসেন যাই। আমার প্রতি ওর এমন অন্ধ বিশ্বাস ছিলো আমার প্রথম প্রশ্নবোধক চিহ্ন। যাইহোক ওকে নিয়ে বীচের চরে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলাম। তারপর দুজনে দুটো কফি খেয়ে রেস্টুরেন্টের পাশে স্লিপিং কোচ ভাড়া করে বললাম, আপনি একটাতে শুয়ে পরেন আমি একটাতে শুই।
বসন্তের দ্বিতীয় দিন ছিলো এটা। আবহাওয়া যা ছিলো তা অকল্পনীয়। আনিকা অনেক আগ্রহ নিয়েই আমার কমান্ডগুলো পালন করছিলো। তারপর আবার বললাম, “চোখ বন্ধ করেন আর মন দিয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করেন।” আনিকার সাথে সঙ্গ দিতে আমিও চোখ বন্ধ করলাম। শুনলাম শো…শো শীতল করা বাতাসের শব্দ। শুনলাম পানি তীরে এসে আছড়ে পড়ার শব্দ। কলকলানির কলকল আওয়াজ। কানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মর্মে এসে ভেদ করছিলো শব্দগুলো। এক বেহেশতি অনুভূতি, যা আমি অনেকবার শুনেছি এখানে এসে। তার অনেক পরে উঠে দেখি আনিকা এখনো চোখ বুঁজে আছে। তার বন্ধ চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম আনিকা কেমন লাগছে? আনিকা চোখ বুঁজে’ই বলেছিলো, “আমি আরো হাজার বছর বাঁচতে চাই রবিন, এটা সত্যিই বেহেশতি অনুভূতি ছিলো। এই পৃথিবী ছেড়ে কোথাও যেতে চাইনা আমি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
তারপর রাঙ্গামাটি, সুন্দরবন, বান্দরবান সব ঘুরেছি আমরা। ছুঁয়েছি মেঘ, ছুঁয়েছি জলপ্রপাত। ঘুরেছি কতো নদনদী পাহাড় পর্বত। ততদিনে আমরা ভালো বন্ধু হয়ে যাই এমনটাই বলা যায়। সেবার রাতে ঢাকা ফিরেছিলাম লুকিয়ে লুকিয়ে। আমাদের নেক্সট ট্রিপ ছিলো সিলেট। মাথায় আরেকটা চমক ঘুরছিলো আমার। আমি সারাজীবন পড়াশোনার চেয়ে ঘুরেছিলাম বেশি, তাই অভিজ্ঞতা ভালোই। এর চাইতে বেশি অনুপ্রাণিত হচ্ছিলাম আনিকার চমকে যাওয়াগুলো। আনিকা কখনো এমন চমক পায়নি। আমি ওকে বললাম ট্রেনের সামনের যে রেলিং আছে ওটার নিচে বসতে পারবা? আনিকা হেসে এক কথায় রাজি। মেয়েটার দম আছে বলা যায়। আমি টিটির সাথে অনেক ঝামেলা করে রাজি করালাম যে, একটা মেয়েকে নিয়ে আমি ওখানে বসে যাবো। তারপর কানে তুলো গুজে দিলাম রওনা।
হুড়ড়রে!!! বলে খুশিতে আনিকা একটা চিৎকার করছিলো আর বলছিলো, “রবিন আমি উড়তেছি। নাউ আই এম অ্যা বার্ড!!! সারারাত শেষে ভোরের আলোয় ট্রেন যখন পাহাড়ের ভেতর ঢুকছিলো, হালকা কুয়াশা আর প্রজাপতি ছুটাছুটি করছিলো যখন সামনে, তখন আনিকা খুশিতে কেঁদে দিয়েছিলো।
ওকে নিয়ে উনিশদিন টানা ঘুরছিলাম। তারপর আমার বাড়িতে নিয়ে আসছিলাম। সেখানে আরো নয়দিন থেকেছিলো আনিকা। আনিকার বাবা ওরে খুঁজে খুঁজে অনেক বিজ্ঞাপন আর লোক লাগিয়েছিলো। আমি বাধ্য হয়ে আনিকাকে বলছিলাম, “আনিকা আমি কেনো জানি তোমায় ছেড়ে দিতে পারছিনা। কোন এক বাঁধায় আমি আটকে আছি কিন্তু তাও চাচ্ছি তুমি এবার বাড়ি ফেরো।”
আনিকা কান্নায় ভেঙে পড়ছিলো আর বলতেছিলো, “রবিন আমি তোমার সাথে যতদিন ছিলাম যতদিন আছি ততদিন’ই বেঁচে আছি। আমার ব্রেইন টিউমার ধরা পড়ে গত মাসে। আমি লাস্ট স্টেজে আছি রবিন। আমার আর বন্দি হওয়ার ইচ্ছে নেই। আমি সারাজীবন মা বাবার কথা রেখেছি। যখন যা চেয়েছে সেভাবেই হয়েছে। যে রেজাল্ট চাইছে আমি তাই দিয়েছি। তার পেছনেই ছুটেছি। আজকে আমি কি পেলাম? আজকে আমি মৃত্যুর দুয়ারে। এবার নিজের মতো মরি? প্লিজ? এটা করতে দাও!
আমি সেবার বরফ হয়ে গিয়েছিলাম আনিকার কথা শুনে। আর ওকে কোথাও যেতে দেইনি। ও দিনদিন আবার ভেঙে পড়ছিলো। ঔষধ খেতে পারতো না বমি করে ফেলে দিতো। আমার খুব কষ্ট হতো। আমি যেনো পুরোদস্তুর আনিকার হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ওরে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। যাকে নিয়ে এতটাদিন পরে আছি তাকে ভালো না বেসে উপায় ছিলোনা। আনিকার হাসিটাই আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিতো। আমি আনিকাকে ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব করি। আনিকা বলছিলো, “রবিন আমায় করুণা করছো?” আমি বলছিলাম আমি তোমাকে চাই আনিকা। আমি আর চাইলেও কারো হতে পারবোনা। তুমি আমায় করুণা করো প্লিজ। একটা লোভে পড়ে আমি তোমার সাথে ছিলাম এতোদিন। আজকে আর কোন লোভ না বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে তোমার কাছেই চেয়ে নিচ্ছি। ভালোবাসি তোমাকে আনিকা।”
পরিবারের অনেকেই বলাবলি করছিলো আনিকা আমার জীবন নষ্ট করছে এটা সেটা। আমার মায়ের কান্নাকাটি সব কিছু উপেক্ষা করেই আমি আনিকাকে বিয়ে করি। এবার আর কোন লোভ ছিলোনা। একটা অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলাম।
তারপর আনিকার মৃত্যুর চিন্তাটা যেনো আমি নিয়ে ফেলছিলাম। কখন জানি আমার আনিকাটা আমায় ছেড়ে চলে যাবে। এই আতঙ্ক আমার ভেতরে বাসা বেঁধে ফেলেছিলো। মানতেই পারছিলামনা আনিকাকে হারিয়ে ফেলবো আমি। প্রতি মাঝ রাতে উঠে বারান্দায় এসে বসে কাঁদতাম। ঘুমন্ত মায়াবী চেহারাটার দিকে অপলক তাকিয়ে দেখতাম।
এভাবেই কেটে গেলো অনেকদিন। আনিকাকে হারানোর এক কঠিন ভয়ে আর আতঙ্কে আমি দিনদিন কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। আমি এলাকায়’ই ছোটখাটো একটা ব্যাবসা করি তখন। একদিন আনিকার বাবা আমার বাড়ি খুঁজে বের করে ফেলে। সবকিছু জেনে উনি আর কিছু রিএক্ট না করেই সব মেনে নিয়েছিলেন। আমরা আনিকার বাসায় বেড়াতে যাই। এরপরদিন’ই হসপিটাল থেকে জরুরি একটা নোটিশ আসলো আনিকাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি সেবার আর কান্না লুকোতে পারছিলাম না। তাও গেলাম আনিকাকে নিয়ে চেম্বারে।
ডাক্তার কয়েকটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললো, ” আমরা আপনাদের কাছে কিছু বলতে চাই। আসলে আমরা অনেক দুঃখিত এবং ক্ষমাপার্থী মিসেস আনিকা। সেদিন যে রিপোর্ট’টা দেয়া হয়েছিলো ওটা ভুল ছিলো। আপনার ব্রেইন কন্ডিশন সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। আমরা সেদিন যে রিপোর্ট দিয়েছিলাম ওটা আনিকা তানজিম নামে একটা পেশেন্টের ছিলো, যা ভুল করে আনিকা তাহসিন, মানে আপনাকে দেয়া হইছিলো। আপনার মাথা ব্যাথাটা একটা স্বাভাবিক ডিজিস ছিলো। আর আনিকা তানজিম প্যাশেন্ট’টি গত সপ্তাহেই মারা গেছেন যাকে আমরা স্বাভাবিক রিপোর্ট’টা দিয়েছিলাম। ইট ওয়াজ অ্যা বিগ ফল্ট। উই আর ভেরি সরি ফর এবরিথিং। এটা জাস্ট টেকনিক্যাল রং ছিলো।”
আনিকা খুশিতে আমায় চেম্বারের ভেতরেই জড়িয়ে ধরেছিলো। সেদিন ছিলাম আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ। যদিও আনিকা তানজিম প্যাসেন্ট’টির জন্যেও খারাপ লেগেছিলো। তারপরদিনই আনিকা জানালো আমি বাবা হতে যাচ্ছি। এবার আর কি বলবো? সুখের ঠেলায় আমি ভাসছিলাম। সবকিছুই মনে হচ্ছিল স্বর্গের মতো। আমি একটা ভালো জব পেয়েছিলাম আনিকার বাবার রেফারেন্সে। আমিই আমি। তারপর শুনবেন? তারপর আসে আমার মন, আমার মেয়ে, আমার অর্ধেক পৃথিবী। আনিকা আবার পালটে যেতে লাগলো অদ্ভুতভাবে। যদিও এই সময়টায় এরকম হয় বলে জানতাম কিন্তু না আনিকার পাল্টে যাওয়াটা ছিল অনেক ভিন্ন।
কারণ? কারণ আমিও জানিনা। হঠাৎ আকাশে মেঘ করে বৃষ্টি নামার কারণ যেটা আমার ক্ষেত্রেও হয়তো সেটাই ঘটেছিল। নানান বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে সংঘাত বাধতে লাগলো দিনদিন। ভালোবাসাগুলো আর ভালোবাসার জায়গায় ছিলোনা। সবকিছুই আনিকা রেপেডলি ভুলে যাচ্ছিলো। আমাকে ওর সহ্য’ই হতো না। আমার খেয়াল আমার যত্ন ওর কাছে বিরক্তিকর লাগতো। হাহাহা, ইট’স অ্যা লাইফ।
দু’বছরের মাথায়’ই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। ডিভোর্স পেপারে সিগন্যাচার করার আগ পর্যন্তও কিছু একটা মিরাকলের আসায় ছিলাম। কিছুই ঘটেনি, খসখস করে সিগন্যাচার করে দিয়েছিলো। কিচ্ছু করার ছিলোনা। আমার ভাগ্যে কিংবা আমার নসিবে অথবা আমার কপালে কখনোই সুখ সয়’নি। আনিকা ওর লাইফ চান্স পেয়ে আর আমাকে দরকার পড়েনি। আমি দেখেছিলাম চোখের সামনেই কেমন করে আমার গড়া আমার প্রিয় মানুষটার পাল্টে যাওয়া রুপ। কোন আফসোস করিনি আর। হারানোর প্রস্তুতিতো আমার ছিলই।
আমি আমার মেয়েকে দেইনি ওর মায়ের সাথে। এতে আনিকার সুবিধেই হইছিলো বোধকরি। আনিকা সুখেই আছে। আরেকটা বিয়ে করেছে শিল্পপতি ছেলে দেখে। আমরা বাপ বেটি যতটুকু আছি মন্দ কি বলেন? জীবন কয়দিনের? আমার মেয়ের জন্যেই বেঁচে আছি। জানি আর মনেপ্রাণে এটাও মানি আমার মেয়ে কোনদিন আমাকে ভুলে ছেড়ে যাবেনা। কক্ষনোই না।
অনেক্ষণ পর আমার মেয়ে দরজা খুলে আসলো। ওকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা কিসি দিয়ে কান ধরে দু’শতম স্যরি বললাম। ও গুনে রেখেছে সব। ভালো করেই জানে ওর ফাজিল বাবাটা আবার ভুল করে এসে স্যরি বলবে। হাসিটা একদম মায়েরটা’ই পেয়েছে। সুখ বিভিন্ন ধারায় এসে মাঝে মাঝে চিরস্থায়ী হয়’ও বটে। আমরা অনেক সুখি।