এই নিয়ে তৃতীয় বারের মত নিজে থেকে বিয়ে ভেঙ্গে দিলো নীরা। ছেলে, ছেলের প্রফেশন, ছেলের ফ্যামিলি সব কিছুই ঠিকঠাক থাকার পরও বিয়েতে রাজি হতে পারেনা নীরা। ছেলেপক্ষ ওদের বাড়ি আসে, দেখা সাক্ষাৎ হয়। খাওয়া দাওয়াও হয়। কিন্তু শেষে নীরা একটা শর্ত রাখায় পুরো বিয়েটাই ভেস্তে যায়। অবশ্য নীরাই বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়। নীরার বাবা অনেকভাবে মেয়েকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু কোনোভাবেই মেয়েকে বোঝাতে সক্ষম হননি। সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে মেয়েটা বাবাকে এভাবেই আগলে রেখেছে। সেই যে হাত ধরেছে এখনও সেই হাত ছাড়েনি নীরা। পাঁচ বছর থেকে পঁচিশ বছর হয়ে গেছে, এখনও বাবার হাতটা ছাড়ার কথা ভাবতেও পারে না পাগলীটা!
তৃতীয় বারও যখন নীরা একই ভাবে বিয়ে ভেঙ্গে দিলো। তখন রতন সাহেব কোনো উপায় না পেয়ে মেয়েকে কাছে দেখে নিয়ে বলেছিলেন, “মামনি তুমি এমনটা কেনো করছো? মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে যেতে হয়!” নীরা বাবার হাতটা শক্ত ধরে বলেছিলো, “বাবা সেদিন তোমার হাতটা ধরে কি বলেছিলাম তোমার মনে আছে? নীরা তখন বাচ্চা ছিলো ঠিকই কিন্তু অবুঝ ছিলো না। বুঝেছো তুমি? তোমার মেয়ে বাচ্চা না, যা করছে সব কিছু বুঝে শুনেই করছে।” কথাটা বলেই নীরা নিজের রুমে চলে গেলো। রতন সাহেব চোখ থেকে চশমাটা খুলে টিস্যু দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিলেন।
ইজি চেয়ারটায় বসে রতন সাহেব ফিরে গেলেন ২০বছর আগে। সেদিন কাঠগড়ায় ছোট্ট নীরাকে যখন জজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “বাবু বলতো তুমি কার কাছে থাকতে চাও? বাবার কাছে নাকি মায়ের কাছে?” রতন সাহেব জানতেন এতটুকু বাচ্চা মাকে ছাড়া কখনো বাবার কাছে থাকতে চাইবে না। তিনি ভাবলেশহীন হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটাকে দেখতে লাগলেন। কারণ, এর পর আর কখনো মেয়েকে দেখার সুযোগ পাবেন কি না, সে ব্যাপারে তিনি বেশ সন্ধিহান ছিলেন।
কিন্তু, ছোট্ট নীরা সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেদিন বলেছিলো, “আমি বাবার কাছে থাকবো।” কথাটা বলেই দৌড়ে এসে রতন সাহেবের একটা আঙ্গুল খুব শক্ত করে ধরে ফেলেছিলো। কোর্টের সমস্ত মানুষ নীরার এমন কথায় অবাক হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি জজ সাহেবও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নীরাকে আবারও জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি মায়ের কাছে থাকতে চাওনা কেন?” নীরা সেদিন অকপটে বলেছিলো, “আমার মায়ের কাছে অনেক মানুষ আছে। মার বাবা মা ভাই বোন সবাই আছে। কিন্তু আমার বাবার আমি ছাড়া আর কেউ নেই।” কথাটা বলেই নীরা রতন সাহেবের গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, “চলো বাবা আমরা বাড়ি চলে যাই। এখানে থাকলে মা আমাকে জোর করে নিয়ে যাবে!”
নীরার কথা শুনে রতন সাহেবের বুকটা গর্বে ফুলে উঠেছিলো। নিজের সন্তানকে নিয়ে তিনি এখনও সেই আগের মত করেই গর্ব করেন। সেই দিন থেকে আজ অব্দি নীরা বাবার কাছেই আছে। নীরাকে ওর মা অনেকবার নিতে এসেছিলেন কিন্তু নীরা একটাবারের জন্য মায়ের সাথে যায়নি। তখন নীরা যে পাগলামি করেছিলো সেটা মেনে নেয়া যায়, কিন্তু এখনকার পাগলামি যে মেনে নেয়া যায় না সেটা পাগলী মেয়েটা বুঝতেই চাইছে না। কোনো ভদ্র ফ্যামিলির শিক্ষিত ছেলে কি ঘরজামাই থাকতে রাজি হবে? এটা তো অসম্ভব একটা শর্ত!
রতন সাহেব ডিনার টেবিলে নীরাকে বললেন, “মামনি আমি ঠিক করেছি কিছুদিন কোথাও থেকে ঘুরে আসবো। তুমি একা থাকতে পারবে না?” নীরা খেতে খেতে বললো, “বাবা আমি জানি তোমার মনের ইচ্ছেটা কি। সো এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।” “মারে বুড়ো বয়সে মেয়ের সুখের সংসার দেখে যাওয়ার ভাগ্য কি আমার হবে না! আমি নাতি নাতনি নিয়ে খেলার সুযোগ কি পাবো না?” “আমার শর্ত মেনে যে আমাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হবে আমি তাকেই বিয়ে করবো।” কথা বলেই নীরা খাবার ছেড়ে উঠে নিজের রুমে চলে গেলো। রতন সাহেবের এক দূর সমর্কের আত্মীয় একটা খুব ভালো সমন্ধ নিয়ে এসেছেন। ছেলেটা নাকি একজন “Texttail Engineer”। দেখতেও বেশ সুন্দর, ফ্যামিলিও ঠিকঠাক। রতন সাহেব ঠিক করলেন এই ছেলের সাথেই নীরার বিয়ে দেবেন, যেভাবেই হোক নীরাকে বিয়ের জন্য রাজি করাবেন।
এক শুক্রবারে ছেলেপক্ষ নীরাকে দেখতে এসেছে। নীরা খুব সুন্দর করে সেজেগুজে ছেলে পক্ষের সামনে বসে আছে। ছেলে ছেলের বাবা মা আর বড় বোন এবং দুলাভাই এসেছেন। নীরা আড় চোখে ছেলেটাকে দেখে নিলো। নীরার বেশ পছন্দ হয়েছে ছেলেকে। ছেলের পরিবার ও বেশ মিশুক। ছেলেপক্ষ যদি ওর শর্ত টা মেনে নেয় তাহলে এই ছেলেকেই নীরা বিয়ে করবে বলে মনে মনে ঠিক করে নিলো। ছেলের মা নীরাকে বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন করার পর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাবা মারুফ আমাদের তো মেয়ে পছন্দ হয়েছে, তুমি কি বলো?” মারুফ মাথা নিচু করে বললো, “তোমাদের যেটা ভালো বলে মনে হয় করো।” মারুফের কথা শুনে সবাই একসাথে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠলো। মারুমের মা ব্যাগ থেকে একটা আংটি বের করে নীরাকে বললেন, “দেখি তো মা তোমার হাতটা দাও তো!”
নীরা মারুফের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার কিছু বলার ছিলো!” রতন সাহেব মেয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন, “নীরার কোনো কিছু বলার নেই, আপনারা আংটি পরান।” মারুফ রতন সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আংকেল উনাকে বলতে দিন। উনার ও মতামত আছে। নীরা আপনি বলুন কি বলতে চাইছেন।” নীরা খুব স্বাভাবিক গলায় বললো, “এই বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই, তবে আমার একটা শর্ত আছে।” মারুফের বাবা নীরার কথা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলেন। মারুফের মা নীরার দিকে তাকিয়ে একটু বিরক্তি নিয়ে বললেন, “তোমার আবার কি শর্ত?” নীরা মারুফের দিকে তাকিয়ে বললো, “মারুফ সাহেব আপনি কি ঘর জামাই থাকতে রাজি আছেন?”
নীরার এমন কথায় রুমের সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। মারুফের মাকে দেখে মনে হচ্ছে নীরার গালে একটা জোড়ে থাপ্পড় দিতে পারলে বেশ খুশী হতেন। মারুফের বাবা খুব আগ্রহ নিয়ে পরের কথা শোনার জন্য নীরার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আর মারুফ নীরার প্রশ্ন শুনে পুরাই চুপসে গেছে। মারুফের বড় বোন মীনা দাঁত মুখ শক্ত করে বললেন, “এই মেয়ে তোমার কি মাথা ঠিক আছে? কি সব আবোল তাবোল বলছো!” নীরা এবারও স্বাভাবিক গলায় বললো, “জ্বী আমি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক আছি।” মারুফ এবার একটু নরমাল হলো। তারপর নীরাকে বললো, “নীরা আপনি হঠাৎ এমন একটা শর্ত রাখলেন কেনো?”
রতন সাহেব মাথা নিচু করে বসে আছেন। নীরা বাবার কাছে গিয়ে বসে বাবার হাত দুটো খুব শক্ত করে ধরে বললো, ” আপনারা হয়তবা জানেন আমার বাবা মা সেপারেট। পাঁচ বছর বয়সে জজ সাহেবের সামনে আমি আমার বাবার হাত ধরেছিলাম। জজ সহবকে কথা দিয়েছিলাম এই হাত দুটো কখনো ছাড়বো না।” নীরার কথায় সবাই কেমন যেনো অন্যরকম হয়ে গেলো। রতন সাহেব চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখলেন। মারুফ নীরার চোখ দুটোর দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। নীরার চোখ দুটো যেনো ওকে কিছু বলতে চাইছে। কিছুক্ষণের জন্য মারুফ নীরার চোখের মধ্যে হারিয়ে গেলো। কান্না ভরা চোখ দুটো দেখতে অপূর্ব লাগছিলো।
নীরা বাবার হাত দুটো ধরে আবারও বললো, “জানেন তো আমি ছাড়া আমার বাবার আর কেউ নেই। আমার মা নিজের সুখের কথা ভেবে আমার বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু আমি আমার সুখের কথা ভাবতে পারছিনা। আমি পারছিনা স্বার্থপর হতে। বাবাকে ছেড়ে আমি কোথাও গিয়ে শান্তিতে থাকতে পারবো না। এর আগেও আমি তিনটে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছি, আপনাদের কোনো প্রবলেম থাকলে আপনারাও বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে পারেন আমার কোনো অভিযোগ থাকবে না। দরকার পড়লে আমি সারাজীবন অবিবাহিত থাকবো তারপরও বাবাকে রেখে কোথাও যাবো না।”
নীরার কথা গুলো শুনে মারুফের বাবা উঠে এসে নীরার মাথায় হাত রেখে বললেন, “আল্লাহ্ তোমার মঙ্গল করুন মা।” মারুফ এতক্ষণ নীরার কথাগুলো মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো। নীরা আর নীরার বাবা চুপ করে বসে আছে। কারণ তাদের বলার আর কিছু নেই, ছেলেপক্ষ যা স্বীদ্ধান্ত নেবেন তাই হবে। নীরা জানে এই বিয়েটাও ভেঙ্গে যাবে, তাতে অবশ্য নীরার কোনো আফসোস নেই। মারুফের মা রতন সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভাই সাহেব এখানে আমাদের বলার মত কোনো কিছু নেই। আমি আপনার মেয়ের শর্ত মত আমার ছেলেকে তো আর ঘরজামাই রাখতে পারবো না সেক্ষেত্রে মারুফ তার মাকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে বললো, “আমি ঘরজামাই হতে পারবো না।” মারুফের কথা শুনে নীরা মৃদু একটা হাসি দিয়ে বললো, “আমি জানতাম আপনি মানতে পারবেন না। সমস্যা নেই।”
মারুফ রতন সাহেবের কাছে এগিয়ে গেলো। তারপর রতন সাহেবের হাত ধরে বললো, “আমি ঘরজামাই হতে পারবো না তাতে কি? আপনি তো আপনার মেয়ের ঘরে থাকতে পারবেন।” রতন সাহেব অবাক হয়ে বললেন, “মানে? বাবা আমি কিছু বুঝলাম না।” মারুফ বললো, “আংকেল আমার উপর যেমন আমার বাবা মা ভাই বোনদের অধিকার আছে, আপনারও তেমন আপনার মেয়ের উপর অধিকার আছে। আপনি আপনার মেয়ের বাড়িতে থাকবেন। এতে নীরার ও কোনো আপত্তি থাকবে বলে আমার মনে হয় না।”
নীরা ছলছল চোখে মারুফের দিকে তাকিয়ে আছে, মারুফ নীরার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো, “আংকেল আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করবো। আর আপনি আপনার মেয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকবেন। আমার মনে হয় না এতে আমার বাবা মায়ের কোনো আপত্তি থাকবে।” মারুফ আবারও নীরার দিকে তাকালো। তারপর নীরার চোখে চোখ রেখে বললো, “যে মেয়ে বাবার জন্য বিয়ে করতে রাজি হয়না, নিজের লাইফ নিয়ে কোনো চিন্তা করে না আমার মনে হয় না সেই মেয়ে অন্য কোনো বাবা মার অসম্মান করবে। আমি নীরাকেই বিয়ে করবো, নীরাকে বিয়ে করলেই আমি সুখী হবো। আর এটাই আমার শেষ কথা।”নীরা ছলছল চোখে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে মারুফের দিকে তাকিয়ে রইলো।