সালটা ১৯৩৫।
পঁচিশ বছরের হানিফ চৌধুরী রেঙ্গুনে ভালোই ব্যবসাপাতি করছে।
এবার হানিফ দেশে আসলে হানিফের মা, ছেলেকে বিয়ে করাবার জন্য চেপে ধরেন।
বলেন,
“আর কতো দেরি করবি বাপ? বয়স তো কম হয় নাই! এবার তো বিয়ে কর। আমি মেয়েও ঠিক করে রেখেছি। সায়েরা কে তো চিনিস…”
“কোন সায়েরা মা?” হানিফও জানতে চায়।
“ঐ যে পুকুর পাড়ের কোণার ঘর, তোর চাচা, সালামত উল্লাহ্’র মেয়ে। বয়স তেরো চলছে। গায়ের রঙ একটু মন্দা। মেয়ে কিন্তু শান্ত শিষ্ট, নামাজি। কোরানও খতম দিয়েছে। যতবার তাদের ঘরে যাই, দেখি গুনগুন করে সুরে সুরে কোরান পড়ছে, নয়তো মায়ের কাজে সাহায্য করছে। বড় ভালো স্বভাবের মেয়ে।
কি বলিস, তার বাপকে বলবো?”
“ঠিক আছে মা, তুমি যা ভালো মনে করো।”
মা বাপের পছন্দের উপর খুব কম সন্তানই কথা বলতো তখন।
হানিফও তার ব্যতিক্রম নয়।
ছয়ফুট লম্বা, সুন্দর স্বাস্থ্য, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ হানিফের সাথে হালকা পাতলা ছোট খাটো সায়েরা’র বিয়ে হয়ে যায়।
বিয়ের সময় মেয়ের সাথে দুইটি কাঁচের প্লেট আর একখানা পাটি দেন সায়েরা’র বাপ। ঐ সময় এরচেয়ে বেশি কিছু দেবার নিয়মই ছিলোনা।
একেবারে কিছু না দিলেও কারো কিছু বলার থাকতোনা।
আর ছেলেপক্ষের কারো দাবি দাওয়া, উপহারাদি চাওয়া এসবের বালাই ছিলোনা সেকালে।
মেয়ে সুন্দর অসুন্দরের চেয়ে মেয়ে কতোটা নরম স্বভাব, কতোটা ধার্মিক তাই দেখা হতো। আর কেউ কেউ দেখতো, বয়স কতোটা কম!
বিয়ে হলো।
কয়মাস পর হানিফ আবার রেঙ্গুন চলে যায়। চিঠি আদান প্রদান কিছুই হতোনা তাদের। কেউ দেশে আসলে তার দিয়ে কিছু চালানি (উপহার) পাঠানো আর সে ভালো আছে খবর দিতো শুধু। চিঠি পাঠিয়েই বা লাভ কি, মা বা বউ কেউতো আর বাংলা লিখতে পড়তে জানতোনা।
হানিফ যাবার পর সায়েরা বুঝতে পারে, সায়েরা গর্ভবতী হয়েছে। সায়েরা এবং শ্বাশুড়ি দুইজনই খুবই খুশি এই সংবাদে।
মাসে মাসে দাই এসে তল পেটের উপর সরষের তেল মেজে, হাত দিয়ে বাচ্চা’র উপস্থিতি অনুভব করে যায়।
নয়মাস পার হলে, তার ব্যথা উঠে। উতালপাতাল সেই ব্যথা। তাড়াতাড়ি দাইকে ডেকে আনে ছোট দেবর নকীব।
অনেক কষ্ট পেয়ে সে এক মৃত সন্তানের জন্ম দেয়।
দুই তিন বছর পার হলে, হানিফ আবার দেশে আসে। যথারীতি দুই তিনমাস পর ব্যবসার কাজে আবার চলেও যায়। যাবার সময় ছোট ভাই নকীবকেও সাথে নিয়ে যায়। ব্যবসা আরেকটু বাড়াবার ইচ্ছে তার। ছোট ভাইকে ব্যবসা শিখাবে এই তার ইচ্ছা।
কিন্তু এবার আর সায়েরা’র পেটে বাচ্চা আসেনা।
সায়েরা আর একা শ্বাশুড়ি মাত্র দুইজন মানুষ ঘরে। শ্বশুর অনেক আগেই মারা গেছেন। সায়েরা ছোটকালে হয়তো তাকে দেখে থাকবে, রাস্তাঘাটে।
সায়েরা এমনিতেই নরম মেয়ে, শ্বাশুড়িও তাকে দেখে এনেছে। দুইজনের সংসারে কোনো অশান্তি নেই। শুধু একটা বাচ্চার জন্য হাহাকার দুইজনের মনেই। কিন্তু কেউ কাউকে বলেনা সে কথা।
সংসারের কাজ, ধানের সময় ধান আসলে সেই ধানের কাজ, গরু আছে কয়েকটা, এসব দেখাশোনা, নামাজ, মাসে দুই একটা কোরান খতম দেয়া সবমিলিয়ে ব্যস্ত সময় কেটে যায় তাদের। যদিও চাষবাসের বা ধান পাকার সময় অনেক কাজের মানুষও আসে সাহায্য করতে।
মানুষ দুইজন হলেও সবসময় সরগরম থাকে তাদের ঘর। আশেপাশের সবার সাথে তাদের ভালো সম্পর্ক। তাছাড়া সায়েরার হাতের রান্নার সুনাম চারিদিকে। কেউ কেউ আবদার নিয়ে আসে,
“অ চাচি, তোমার বউকে বলোনা, আমাদের মেয়ের আকদের রান্নাটা কিংবা খৎনা অনুষ্ঠানের রান্নাটা করে দিতে।”
সায়েরা খুশি মনেই করে দেয় তাদের কাজগুলো। সবাই তাকে দোয়া দেয় মন থেকে।
আর সবার দাবিও আছে যেন সায়েরার উপর। সেতো এই বাড়িরই মেয়ে, পর কেউ নয়।
এভাবে দিন যায়। হঠাৎ সায়েরা ও তার শ্বাশুড়ি হানিফের মায়ের কানে খবর আসে, হানিফ বিয়ে করেছে রেঙ্গুনে। তাও এক বার্মিজ মেয়ে!
বউ, মা দুইজনের মাথায়ই হাত!
সায়েরা চুপিচুপি কাঁদে, স্বামীকে ভালোভাবে চেনার আগেই সে পর হয়ে গেলো যেন। বিয়ে হয়েছে পাঁচবছর হলে কি হবে, স্বামীর সাথে সংসার তো পাঁচমাসও হয়নাই। সে শুধু এক মৃতসন্তানের মা হতে পেরেছে, আর কোনো সন্তানেরও মুখ দেখেনি। কিভাবে দেখবে? হানিফ ঘনঘন দেশে আসলেই না বাচ্চা হবে!
হানিফের মাও কাঁদেন।
ছেলেটা কি তবে পর হয়ে গেলো? কোন বার্মিজ এর ফাঁদে পড়লো তার সোনার টুকরো ছেলে! ঐ দেশেও কি তবে বশীকরণ তাবিজ দোয়া আছে! নাকি সুন্দর দেখিয়ে তার ছেলেকে বশ করেছে?
বিবি ছালিমা, মা বাবার খুবই আদরের মেয়ে। তার বাপজান বাংলাদেশি হলে কি হবে ছালিমা বাংলা ভাষার কিছুই জানেনা বলতে গেলে। দুই একটা শব্দ বুঝতে পারে অবশ্য, কিন্তু বলতে পারেনা বা শেখার ইচ্ছে হয়নি কখনো তার। শিখে কি হবে, সেতো রেঙ্গুন ছেড়ে আর কোথাও যাচ্ছেনা।
ছালিমা’র মা মুসলিম বার্মিজ। রেঙ্গুনেই তাদের সবার বসবাস।
১৯৪০ সাল। ছালিমা’র বয়স তখন কুড়ি চলছে। ছোটবেলা থেকেই সে খুবই চঞ্চল প্রকৃতির। তার বড় একবোন মারা যাবার পর পর তার জন্ম হওয়ায় মা আর বাপজানের চোখের মণি সে। তার কথার উপর কোনো কথা নাই। সামান্য কিছু পড়ালেখা করার পর যখন সে আর স্কুলে, মাদ্রাসায়ও যেতে চাইনি; তখন তার বাপজান কয়দিন বুঝিয়েছে শুধু। শেষে মেয়ের ইচ্ছেই পূরণ হয়। ছালিমা আর স্কুলে যায়না। তবে সে লিখতে পড়তে পারে।
বান্ধবীদের সাথে দলবেঁধে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা খুব প্রিয় ছিলো ছালিমা’র। সেসব হলে ছেলেরাও সিনেমা দেখতে যেতো। দীর্ঘকেশী, দুধে আলতা গায়ের রঙ তার, আর চোখের উপর কুচকুচে কালো জোড়া ভ্রু দেখে পাগল হয়ে, অনেক ছেলে প্রেমপত্রও দিয়েছে তাকে!
ছালিমা মাথায় ইয়া বড় করে বিভিন্ন আকারের খোঁপা করতো। খোঁপার উপর আটকাতো নানান রকম কাটা।
লম্বা হাতের এক রঙা রঙিন ব্লাউজ পরতো সে। সে ব্লাউজের হাতে আর গলায় কুর্শি কাজের নকশা করতো নিজ হাতে। আর পরতো ছাপানো ফুলের থামি। এমন সজ্জায় অপরূপা লাগতো সুন্দরী ছালিমাকে বিনা সাজেও।
না, ছালিমা’র হাতে চিঠি কেউ দেয়নি। সুন্দরী মেয়েদের দূর থেকে ভালোবাসা যায়, কাছে এসে প্রেম নিবেদন, এই যে ভীষণ কঠিন কাজ। মুখের উপর না করে দেয়া বা অপমান করার সমুহ সম্ভাবনা থেকে যায়। সুন্দরী মেয়েরা বরাবরই অহংকারী হয়ে থাকে।
বন্ধুদের সামনে লজ্জিত বা অপমানিত হওয়া, এরচেয়ে লজ্জাকর পরিস্থিতি আর কি হতে পারে!
এতো এতো চিন্তাভাবনা করে ছেলেরা, ছালিমা’র কোনো বান্ধবীকে তার নাম ধরে চিঠি হাতে গুঁজে দিতো। বান্ধবীরা প্রথমে তাদের ভেবে খুশি হয়ে, পরে মন খারাপ করে, ছালিমা’র হাতে দিয়ে দিতো চিঠি।
ছালিমা অহংকারী না হলেও কখনো সেইসব চিঠি খুলেও দেখেনি। মা না থাকলে চুপিচুপি রান্নাঘরে গিয়ে জ্বলন্ত চুলোয় পুড়িয়া ফেলতো তা। তার কাছে এসব খুবই সস্তাদর রসিকতা মনে হতো। আর তার বাপও নিশ্চয় প্রেম ভালোবাসা পছন্দ করবেনা একেবারে, এটা তার মাথায় রাখতো।
ভীতুর ডিম ছেলেরা গোপনে তাকে ভালোবেসে তৃপ্ত থাকতো শুধু।
দুই একজন সাহসী ছেলে অবশ্য তার ভ্রুর প্রশংসা করতে গিয়ে রসিকতা করে বলতো,
“হায় আল্লাহ, আয়না উল্টো করে ধরে ভ্রুতে কাজল দিয়েছে মনে হয়!”
ছালিমা শুনে মুচকি হাসতো, জবাব দিতোনা কিছু।
ছালিমা মেয়ে হলেও তাকে মেয়েলী কোনো বাধ্য বাধকতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি। ছোট ভাইবোন, বান্ধবীদের সাথে খোলা উঠোনে সে ফুটবলও খেলতো। ২০১৮ সালে এসে যা বাংলাদেশের অনেক গ্রামে গঞ্জে এখনো কল্পনাতীত ঘটনা। অথচ আশি বছর আগে তা রেঙ্গুন শহরে খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিলো!
বিবি ছালিমা ছোটবেলা থেকেই বাপজানের পকেট থেকে না বলে সিগারেট নিয়ে খেতো। এক আধ’বার বাপের এঁটো সিগারেটে টান দিয়েই তার এই কু-অভ্যাস! বাপজান জানতে পারলেও তেমন কিছু বলেনি। তবে আরেকটু বড় হলে, তাকে সিগারেট কেনার জন্য আলাদা টাকা দিতো।
সেই বিবি ছালিমা’র জন্য বাপজান ছেলে পছন্দ করেছেন। ছেলের নাম হানিফ চৌধুরী। দেখতে শুনতে খুবই ভালো। একেবারে রাজপুত্র!
ভালো ব্যবসা করে, দুইটা কাপড়ের দোকান আছে তার। তা ছালিমা’র বাপজানের দোকানের পাশেই। খুব শিঘ্রী ঘরও কিনে ফেলতে পারবে। প্রায় পাঁচ ছয়বছর ধরে তিনি হানিফকে দেখছেন। ছেলের কোনো বদ অভ্যাসও নেই। সবচেয়ে বড় কথা, তার দেশের ছেলে। তিনি ছেলেকে বারবার করে জিজ্ঞেস করেন, দেশে সে বিয়ে শাদী করেছে কিনা।
ছেলে প্রতিবার জবাব দেয়,
“না!”
খুব ধুমধামের সাথেই বিবি ছালিমা আর হানিফ চৌধুরী’র বিয়ে হয়। বিয়েতে হানিফ চৌধুরী, এক ঝুড়ি পরিমাণ স্বর্ণালংকার দেয় ছালিমাকে। যা ওজন করলে ত্রিশ ভরির কম হবেনা। সেখানে সোনার মাথার তাজ হতে পায়ের মল, সোনার কোমরবন্ধনীও ছিলো! সাথে হীরের আংটি, নাকফুল। বিয়ের দিন দুইজনকেই মনে হয়েছিলো তারা দুই রাজকুমার, রাজ কুমারী!
আর একে অপরের জন্যই যেন তাদের সৃষ্টি! এতোই সুন্দর দেখাচ্ছিলো তাদের। বাপজান যেন মেয়ের উপযুক্ত বর খুঁজে এনেছেন।
বিয়ের এক বছরের মাথায় ছালিমা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। নাম রাখা হয় তার, লোকমান চৌধুরী। মায়ের গায়ের সাদা রঙ পায় সে, অপূর্ব সুন্দর হয় সেই ছেলে। একটু বড় হতে কিচিরমিচির করে বার্মা ভাষায় কথা বলা শিখে সে। ছালিমা’র এতো ভালো লাগতো শুনতে!
ধীরেধীরে লোকমান শিশু থেকে বালক হতে থাকে।
হানিফ ছালিমাকে বুঝাতে থাকে, এবার তাদের দেশে গিয়ে বসবাস করা দরকার।
ছালিমা বাংলাদেশের নামও শুনতে চায়না। ছাব্বিশ সাতাইশ বছর ধরে পরিচিত চেনা এই রেঙ্গুনই তার জন্মভূমি, সবটুকু ভালোবাসা।
সে কিভাবে অন্য আরেক পরিবেশে গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নেবে! তাছাড়া হানিফ সাথে গেলেও আবার ব্যবসার কাজে রেঙ্গুন ফেরত আসবে।
এরচেয়েও বড় যা সমস্যা, ছালিমা লোকমুখে শুনেছে, হানিফ আরেকটা বিয়ে করেছে এই রেঙ্গুনেই!
তাকে জিজ্ঞেস করলে সে তা স্বীকার করে ।
ওখানে সন্তানও হয়েছে তার। এই নিয়ে ছালিমা হানিফের নিত্য ঝগড়া। এই ঝগড়ার হাত থেকে বাঁচতেই মনে হয়, তাকে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দিতে চাইছে হানিফ।
ছালিমা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, সে যাবেইনা, যা হবার হবে।
লোকমান সাত বছরের হয়। হানিফ একদিন লোকমানকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাচ্ছে বলে, উড়োজাহাজে উঠে, সোজা বাংলাদেশ চলে আসে!
এবার বুঝবে ছালিমা, কত ধানে কত চাল!
মহিলাদের এতো রাগ ভালো নয়। হানিফ কতো বুঝালো, দেশে চলে যেতে।
না, সে শুনবেই না।
দেশে তার এতো সম্পত্তি কে খাবে? তার প্রথম ঘরে তো কোনো সন্তানই নাই।
তাই লোকমানকে চুরি করে দেশে নিয়ে যাবার এই সিদ্ধান্ত। আর এটাকে সে চুরিই বা বলবে কেনো! লোকমান তো তারই ছেলে।
ছালিমার মতো, তারও অধিকার আছে, লোকমান কোথায় বড় হবে সে সিদ্ধান্ত নেয়ার।
মনে মনে এসবই ভাবে হানিফ।
লোকমানকে তার বাপ হানিফ দেশে নিয়ে গেছে শুনে ছালিমা অনেক কান্নাকাটি করে। কিন্তু তার রাগ কমেনা, বরং সে তার জিদ নিয়েই বসে থাকে।
তবে দেখার বিষয় হলো, তার রাগ কতোদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়।
সায়েরা বানু আর লোকমানের দাদি নাতিকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়!
লোকমানকে দেখে, হানিফের উপর সব অভিমান সায়েরা বানু’র ধুয়েমুছে যায়। সে লোকমানকে মাথায় রাখবে নাকি বুকে রাখবে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তার শূন্য কোল যেন এই দেবশিশু ভরিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হলো, লোকমান বাংলা ভাষা বুঝতে পারেনা। সে পানি চাইলেও সায়েরা বুঝতে পারেনা; জামা চাইলেও বুঝতে পারেনা। লোকমান আর সায়েরা কয়দিন ইশারা ভাষা ব্যবহার করে। তারপর লোকমান বাংলা ভাষা শিখে ফেলে খুব দ্রুতই।
সায়েরা আর দাদি’র আদর ভালোবাসায় মায়ের অভাবও বোধ করেনা লোকমান।
সায়েরাকে যখন সে দূর থেকে মা….বলে চিৎকার দিয়ে ডাকে, সায়েরার মাতৃত্বের অপূর্ণতা আর থাকেনা। সে ভুলেও ভাবতে পারেনা, এ তার গর্ভজাত সন্তান নয়।
বিবি ছালিমা বছরখানেক সন্তান ছাড়া কাটিয়ে দেয়। কিন্তু মায়ের মন আর মানাতে পারেনা। সে এবার হানিফকে বলে, তাকে বাংলাদেশে, তার ছেলের কাছে নিয়ে যেতে।
হানিফ এটাই চেয়েছিলো। সে খুশি মনে ছালিমাকে দেশে নিয়ে আসে।
হানিফ বিদেশি বউ নিয়ে আসছে, এই সংবাদে গোটা বাড়ির মানুষ একজোট হয়ে দলে দলে বউ দেখতে আসে। লোকমান তো এখন সবার পরিচিত। এখন তার মাকে দেখার পালা।
সবাই এসে অবাক হয়ে যায়,
এই মেয়ে নিশ্চয় জ্বীনজাতীয় কিছু হবে। এতো সুন্দর গায়ের রঙ কি মানুষের হয়!
এতো বড় খোঁপা, মাথার চেয়ে খোঁপা বড়! না জানি, কতো লম্বা হবে তার চুল!
কেউ কেউ সারাদিন বসে থাকে, তার খোঁপা খোলা চুল দেখবে বলে।
যখন কেউ হঠাৎ এসে ছালিমাকে খাটে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে দেখে। বাইরে গিয়ে বলে বেড়ায়,
হানিফের বউ আসলেই জ্বীন কন্যা! তার লম্বা চুল পায়ের গিঁড়ায় এসে নেমেছে!
ছালিমা এসে দেখে, তার ছেলে এতোদিন এখানে খুব খুশিতেই ছিলো। তার খৎনাও করা হয়েছে ইতিমধ্যে। স্কুলে ভর্তি হয়েছে, মাদ্রাসায়ও যাচ্ছে। মাঠে গিয়ে খেলছে, অনেক বন্ধুও জুটিয়েছে। আর ক্ষিদে লাগলে সায়েরার আঁচল ধরে এটা ওটা বায়না করছে। ছালিমাকে খুঁজেওনা সারাদিন।
মা ডাকলে ছালিমা জবাব দেবার আগে সায়েরা জবাব দিচ্ছে।
না, ছালিমা’র তাতে কোনো হিংসে লাগছেনা। প্রথমে সায়েরাকে দেখে একটু ধাক্কা খেয়েছিলো। পরে সামলিয়ে নিয়েছে। ছালিমাকে না জানিয়ে রেঙ্গুনে বিয়ে করতে পারলে, হানিফ তার আগে দেশেও বিয়ে করতে পারে, অসম্ভব কিছু নয়।
সায়েরা বরং তারচেয়েও বেশি দু:খি। ছালিমা’র নিজের একটা সন্তান হলেও আছে, সায়েরার তো তাও নেই।
থাক, লোকমানকে সন্তান ভেবে সে কিছু সুখ নিক।
লোকমান চৌদ্দ বছরের হলে হানিফ দেশে আসে। সদরে লোকমানের নামে একটি কাপড়ের দোকান কিনে দেয়।
তারপর সেই যে গেলো আর কখনোই ফিরে আসেনি। চল্লিশবছর বয়সে তার পায়ে একটি ফোঁড়া হয়। ফোঁড়াটা অপারেশন করার পর ইনফেকশন দেখা দেয়। হঠাৎ একদিন বাড়াবাড়ি রকম খারাপ লাগলে তাকে হাসপাতাল ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাবার কয়দিন পর সে মারা যায়। ভাই নকীব ছিলো সাথে, ওখানেই তাকে দাফন করা হয়।
রেঙ্গুনে তার কেনা দুইতলা কাঠের ঘরটিতে তখন তার তৃতীয় বউ আর সন্তানেরা থাকতো।
লোকমানের দাদিও মারা যান একসময়। দুই সতীন তাদের সব ভালোবাসা দিয়ে ছেলেটিকে মানুষ করতে চান। লোকমান দুই মায়ের আদর সোহাগে কেমন যেন উল্টো পথে হাঁটতে চায়। পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে সারাদিন বন্ধুদের নিয়ে হৈ হল্লা, অযথা টাকা খরচ করা শুরু করে দেয়।
দুই মা চুক্তি করে, ছেলেকে ফেরাতে হবে এসব থেকে।
আর তাই ছেলেকে ঘরমুখো করতে তারা মেয়ে দেখা শুরু করে।
কারো মুখে শুনে নৌকা যোগে দূর গ্রামের এক সুন্দরী মেয়েকে দেখতে যায় তারা। দুই ঘণ্টা ‘র বিরক্তিকর যাত্রা ছিলো তা। মেয়ে দেখে তাদের ক্লান্তি মিটে যায়। যে আশায় এসেছে, সে আশা সফল হয় তাদের। মেয়ে রূপে গুণে সেরা। ঘোর গ্রামের হলেও মেয়ে বাংলা, আরবি, উর্দু সব পড়তে পারে। বার্মা ভাষায়ও কথা বলতে পারে।
চার বছর মা বাবার সাথে রেঙ্গুন থেকে এসব সে শিখে এসেছে। মেয়ের বাপেরও রেংগুনে ব্যবসা।
কয়মাস পর, পনেরো বছরের আনোয়ারা বেগম নামের মেয়েটিকে, তাদের আঠারো বছর বয়সী একমাত্র পুত্রের জন্য নিয়ে আসে বউ করে। শুধু বউ নয়, তাদের আরেক সন্তান বানিয়ে রাখে আনোয়ারাকে।
সুখে শান্তিতে কাটতে থাকে তাদের ছোট্ট এই সংসার।