আস সলাতু খাইরুম মিনান নাউম (ঘুম হতে নামাজ উত্তম) ….
শীতের খুব ভোরে আজান দিচ্ছে মসজিদে।
বিবি সায়েরা খাতুন দেয়াল হাতড়ে সুইচ খুঁজে নিয়ে লাইট জ্বালান।
পাশে শোয়া নাতনী রুবি বিরক্ত হয়।
-লাইট দাও ক্যান দাদি? শান্তিতে ঘুমুতে দিবেনা?
-আজান দেয় শুনিসনা!? জেগে গেছিস যখন উঠে যা, পিঠটা আগে চুলকিয়ে দে, বড্ড চুলকায়। তারপর নামাজ আদায় করে নে।
রুবি না উঠেই চোখ বন্ধ করে দাদির পিঠ হাতড়িয়ে চুলকাতে চায়।
দাদি হাতে আস্তে একটা থাপ্পড় দেন।
-কাম চোর উঠ…
রুবি চোখ কচলায়।
-তোমার পিঠ চুলকায় কেনো খালি? মিনিটে মিনিটে পিঠ চুলকায় দে, মাথা আচড়ায় দে….!
-হাত দিয়ে কি চুলকাস? নখ তো নাই মনে হয়। মাঝখানে চুলকা, চিরুনি নে, ভালোভাবে কর।
-হুম, চিরুনি দিয়ে একেবারে ছিঁড়ে দিবো।
-দে দে শীতের বাতাস লেগে গা ফাটা শুরু হয়ে গেছে। তুই ছিঁড়ে দিলেও খবর হবেনা।
এবার একটু চুলটা আছড়ে দেতো সোনা।
-আবার চুলও!
-ধুর, কয়টা চুল আছে আমার, এতো রাগ করিস কেনো? মাথার তালুতেও মনে হয় ফাটা শুরু হয়েছে। এতো চুলকায়, হাত নামেনা। জোরে চিরুনি চালা না।
-ফাটা না দাদি, সব খুশকি!
তেলের সাথে সব খুশকি ভরা, চিরুনি ময়লা হয়ে গেলো।
-হোক, তুই আছড়াতো, চিরুনি আমি ধোব।
নাতনী চুল বেধে দেয়, রগদুই তিনটা টুকরো কাপড় চুলের সাথে যোগ করে বাঁধতে হয়,নইলে একফোঁটা এই চুল খোঁপা করা অসম্ভব, মুহূর্তেই খুলে, পিঠে ছড়িয়ে যাবে চুল।
দাদি ওযু করতে বাথরুমে ঢুকেন। মাও জেগে যান। তিনি উঠেই রান্নাঘরে ঢুকে চুলায় চায়ের কেটলি বসিয়ে দেন, শ্বাশুড়ি নামাজ শেষেই চা চাইবেন।
সায়েরা খাতুন বাথরুম থেকে বেরুলে, পুত্রবধূ যান এবার।
রুবি বিছানায় গড়াগড়ি দেয়। হঠাৎ মনে পড়ে কিছু…তাড়াহুড়া করে বিছানা ছাড়ে।
“হায় আল্লাহ, এখনই তো শাহেদ মসজিদে নামাজ শেষ করে তার ঘরের সামনে দিয়ে একবার হেঁটে যাবেই!”
যদিও তার বাড়ির উল্টো পথে রুবি’র ঘর।
তবুও সে আসবেই, প্রতিদিন আসে। আর রুবিও না জানার মতো করে জানালা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে একনজর দেখবে বলে।
রুবি দাঁত ব্রাশ করার আগে আয়নার সামনে গিয়ে অগোছালো চুলটা আগে আঁচড়িয়ে গুছিয়ে বাঁধে। জামাটাও পরিপাটি করে, উড়নাটা সুন্দরভাবে ভাঁজ করে পরে নেয়।
তারপর যেই বাথরুমে ঢুকে ব্রাশ করতে নেবে, হৈহৈ শব্দ শুনা যায়, ব্রাশ বেসিনে ফেলে দৌড় দেয় জানালার পাশে।
শীতের সকাল, একটু আলো ফুটলেও কিছুটা কুয়াশাচ্ছন্ন চারিদিক। হালকা মিষ্টি বাতাস গরম কাপড়হীন রুবিকে বারবার কাঁপিয়ে দিয়ে যায়।
ঐতো শাহেদ আসছে, গ্রামের সুন্দর পথটি ধরে। সাথে আরো কয়েকজন আগে পিছে। সবাই নামাজ শেষে কিছু হাঁটাহাঁটি করবে কিংবা দোকান থেকে রুটি আনবে বলে বাড়ি না গিয়ে পথে হাঁটছে।
শাহেদ তার হাঁটার গতি কমিয়ে দেয়, ধীরেধীরে হাঁটে সে। সবার পেছনে পড়ে যায়। আর রুবি’র জানালার দিকে তার চোখ। চোখাচোখি হয় দুইজন।
হঠাৎ জানালার পাশে আসে শাহেদ।
-শোন..
-কি!
-এইনে তোর জন্য শিউলি ফুল, একদম তাজা, এখুনি কুড়িয়ে আনলাম।
জানালার শিক চেপে পলিথিনে মোড়া শিউলিফুল দুইহাতে বাড়িয়ে নিতে গিয়ে একটু হাতও যেন ছোঁয়া হয়ে যায়। খুব ভালো লাগার আবেশে বুঁদ হয় সে। হয়তো শাহেদও হয়!
জানে উচিত না এই ভালো লাগা। তবুও মন মানেনা।
ফুল দিতে পেরে শাহেদ যেমন খুশি, তেমনি সামান্য ফুল পেয়ে রুবিও ভীষণ খুশি। মনে মনে ভীষণ আনন্দিত, আন্দোলিত সে। যেন দেবী পূজা’র অর্ঘ্য পেয়ে তৃপ্ত, তুষ্ট!
প্রতিদিন শাহেদ হেঁটে যায়, ঘরের সামনে দিয়ে। চোখ তার জানালায় দাঁড়ানো রুবি’র দিকে। আর রুবি অধীর অপেক্ষায় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, শাহেদের পথপানে….
কি জানি এই চোখাচোখি কখনো ভালোবাসা হবে কিনা,কখনো তা শেষতক যাবে কিনা।
এই মুহূর্তে গ্রামের এই পনেরো বছর বয়সী রুবি আর সতেরো বছরের শাহেদের কাছে মুহূর্তের এই দেখা চোখাচোখিই প্রেম, এটাই ভালোবাসা।এই অপেক্ষাতেই যেন পৃথিবীর সব সুখ!