ছাদে কাপড় শুকোতে দিতে গিয়ে প্রথম ছেলেটাকে দেখতে পায় দিনা।ভীষণ কড়া রোদ ছিল সেদিন।মা বললো,”যা তো কাপড় গুলো ছাদে দিয়ে আয়।এই কদিন তো বৃষ্টির দাপটে সূর্যের চেহারাই দেখা যায় নি ভালো মতো।” কাপড় নাড়তে নাড়তে একটু দূরের সাত তলা বিল্ডিং টায় চোখ পড়ে যায় দিনার। উদাস নয়নে আকাশের দিকে মুখ করে বসে আছে একটা ছেলে।
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সূর্যটার দিকে।”তাজ্জব ব্যাপার! এমন রোদের মধ্যে কেউ এভাবে বসে থাকে!”দিনা আরো কিছুক্ষণ লক্ষ্য করলো ছেলেটা কে। নাহ্,একে তো আগে এই পাড়ায় কখনো দেখেনি।নতুন এসেছে বোধহয়। মনে অনেক গুলো প্রশ্ন নিয়ে দিনা ছাদ থেকে নেমে এলো । জিকুর বুধবার কোচিং থাকে না।এইসময় টায় নিজের ঘরে বসে কম্পিউটারে গেইম খেলে সে।দিনা এসে তার বিছানায় পা উঠিয়ে আরাম করে বসলো।
-জিকু কি করিস?
-দেখতেই তো পারছিস কি করি।
-তোর কোচিং নেই আজ?
-নারে আজকে নেই।আবার জ্বালাতে এসেছিস আমায়?
-জ্বালাবো না।যেটা জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিয়ে দে।চলে যাবো ।
-তাড়াতাড়ি বল।
-আচ্ছা আমাদের পাড়ায় যে সাততলা বিল্ডিং টা আছে অইখানের কাউকে চিনিস তুই?
-কেন বলতো আপু?
-আরে শোন না কি হয়েছে।আজকে ছাদে গেছিলাম জানিস।যেয়ে দেখি অই ছাদে এক ছেলে ট্যাংকির উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে।আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই।পিছন থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেও টের পাবে না বোধ হয়।
-ওয়েট ওয়েট!! আপু ছেলেটার বাম কব্জিতে কি গাঢ় কাটা দাগ আছে?
-কিহ! পাগলের মতো কথা বলিস কেন। এত দূর থেকে আমি ছেলের হাত দেখেছি নাকি।এমন কাউকে চিনিস তুই!
-আরেহ, চিনি তো।বস কে চিনবো না মানে!
-বস!
ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগলো দিনার কাছে। সে খাট থেকে নেমে গেল।একটা চেয়ার নিয়ে জিকুর মুখোমুখি এসে বসলো।
– অই বস মানে কি ? এই বস টা আবার কে?
-তুই যেই বিল্ডিং এর কথা বললি সেই বিল্ডিংয়ে অতুল ভাইয়ারা থাকে।আমাদের ফিজিক্স এর ক্লাস নেয়।ভাইয়া ইস এ বস বুঝলি! উনার সাথে যে পাঁচ মিনিট কথা বলে সেই ভাইয়ার ফ্যান হয়ে যায়।খুব ফ্রেন্ডলি । আর ভাইয়ার পেইন্টিং!! কি বলবো ।তুই দেখলে ঠাশকি খেয়ে যেতি। দিনা জিকুর কথা শুনে খানিক টা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে।কি যেন ঠিক মেলানো যাচ্ছে না।
-অহ! অইটা তোদের অতুল ভাইয়া তাহলে।
-আমি শিওর না তো।শুনেছিলাম ভাইয়া নাকি দিনে রাতে যেকোনো সময় ছাদে উঠে বসে থাকে। তোর কথা শুনে মনে হলো অতুল ভাইয়ার কথাই বলছিস।উনাকে দেখলে শিওর করে বলতে পারতাম।
-ও আচ্ছা। শিওর হয়ে আমায় বলিস তো অইটাই অতুল ভাইয়া কিনা।
-এখন যেয়ে দেখে আয় তো সেই ছেলে ছাদে আছে নাকি।
-নারে।এখন বিকেল বিকেল হয়ে গেছে।মা আর যেতে দিবে না।
-আচ্ছা যেদিন দেয় অইদিন বলিস।এখন যা তো আপু।অনেক সময় নষ্ট করেছিস আমার।
খুব ব্যস্ত থাকে দিনা সারাদিন।এই ভার্সিটি তো এই আবার কোচিং, এই আবার বাসা,বাসা থেকে আবার কোচিং।এত ব্যস্ততার মাঝে ছাদের কাহিনী আর অই ছেলেটাকে দিনা ভুলে গেছে।অনেকগুলো দিন পার হয়ে যায় তারপর।একদিন বিকেলবেলা দিনা বিছানায় শুয়ে শুয়ে গান শুনছে।ওর ঘরের জানালাটা দিয়ে অনেক টুকু আকাশ দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে প্রায়ই অনেক কিছু চিন্তা ভাবনা করে সে। এমন সময় আকাশ বিকট আওয়াজে ডাকতে শুরু করল।দিনা বুঝে।মুশলধারে বৃষ্টি হবে এখন।চারদিক ভাসিয়ে দিয়ে যাবে।মনে মনে খুশি হয়।কতদিন হলো জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখা হয় না।বৃষ্টি ছোঁয়া হয় না!
হঠাত খেয়াল হয় আজকে বুয়া এক সপ্তাহের কাপড় ধুয়ে দিয়ে গেছে।তার মানে ছাদে অনেক কাপড় দেয়া! এখন না নিয়ে আসলে সব ভিজে একশা হয়ে যাবে আবার।তাড়াতাড়ি ছাদে চলে যায় দিনা।দ্রুত কাপড় গুলো নামাতে থাকে।হালকা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে প্রায়।ঠিক তখনি দ্বিতীয় বারের মতো সেই ছেলেটাকে দেখে সে।মুহূর্তেই সব মনে পড়ে দিনার। সেইদিনের ভঙ্গী তেই ছেলেটা বসে আছে।খুব মনোযোগ দিয়ে আকাশ দেখছে।দিনা অবাক হয়ে যায়। তার মানে কি এতগুলো দিনের প্রতিদিনই এ ছাদে এসে এইভাবে বসে ছিল? এত কথা ভাবতে ভাবতে যে বৃষ্টির তেজ প্রচন্ড বেড়ে যাচ্ছে দিনার খেয়াল ই নেই।হাতের কাপড় প্রায় সব ই আবার ভিজে গেছে।ছাদের দরজায় তালা দিয়ে নিচের সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায় সে।কিন্তু ছেলেটা এখনো সেই একিভাবে আছে।
এরপরের দিন একাউন্টিং কোচিং মিস দেয় দিনা।আজ যে করেই হোক জানতেই হবে। কে সেই ছেলে।দুপুরের দিকে আগের দিনের মতোই বৃষ্টি শুরু হয়।তবে খুব হাল্কা বৃষ্টি।জিকু বাসায়ই ছিল সেদিন।জিকু হাজার বার না করা সত্ত্বেও দিনা যেয়ে হাত ধরে টেনে তাকে ছাদে তোলে।ছাতা দিয়ে।
-তুই খুবই বিরক্তিকর কর আপু।এই বৃষ্টির মধ্যে আমাকে ছাদে নিয়ে আসার মানে কি!
-এমন কোনো বৃষ্টিও হচ্ছে না।তোকে যে কারনে নিয়ে এসেছি সেটা বল।
-কি বলবো?
-অই বিল্ডিং টার দিকে তাকাতো। দেখ তো অই ছেলেকে চিনিস কিনা।
-কোন বিল্ডিং?
-আরে অই যে সাত তলাটা।
-দাঁড়া দেখি ভালো মতো।আরে হ্যা!! এ তো অতুল ভাইয়া।আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার।সানি যা বলেছে সব সত্যি!
-কি বলেছে সানি?
-কিছু না।তুই তাহলে অতুল ভাইয়ার কথাই জিজ্ঞেস করেছিলি সেদিন।
-তুই শিওর এটা তোর অতুল ভাইয়া?
-আরে শিওর মানে কি! এই গ্রিন কালারের গেঞ্জি টা পড়েই তো সকালে আমাদের ক্লাস নিল।দাঁড়া একটা ডাক দিই।
-ডাক দিতে হবে না।তুই নিচে যা।
-আচ্ছা চল।
-তুই যা। আমি একটু পর আসছি।
-আপু তুই এই বৃষ্টির মধ্যে কি করবি এখন? মা শুনলে বকবে তো
-বকুক। যেটা বললাম কর। আমি কিছুক্ষণ থাকবো।
দিনা এখন প্রায়ই ছাদে যায়। গল্পের বই পড়ে।বিকেলে ছাদে নিয়ে গিয়ে কফি খায়।অতুলকে দেখে।একটা দিন ও এমন হয় নি যে অই ছেলেটা উঠেনি।প্রতিদিন বিকেলে যেয়ে দেখে অতুল হাত পা ছড়িয়ে ছাদে বসে আছে। সন্ধ্যে নামার আগে আগে দিনা নেমে যায়। কিন্তু তখনো অতুল ছাদে বসেই থাকে।অতুলকে খুব অদ্ভুত লাগে দিনার। এমন অদ্ভুত কাজের কারণ টা জানতে ইচ্ছে হয় তার।দিনার কেন যেন মনে হয় ছাদে এইভাবে বসে থাকাটা খুব একটা অকারণে নয়।কোন এক গভীর কারণ এর পিছনে নিশ্চয় আছে। নির্লিপ্ত ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা।একমনে কোন কিছু চিন্তা করা।দিনার মনে হয় অতুল এই বিশাল আকাশে কিছু একটা খুঁজে বের করতে চাচ্ছে। আরো একটা আশ্চর্য ব্যাপার হলো এতদিন ধরে অতুলকে দিনা খেয়াল করছে,এর মধ্যে একটা বারের জন্যও অতুল দিনার দিকে ফিরে তাকায় নি।একদিন ও না। খুব মনোযোগ দিয়ে কেউ যে তাকে দেখছে অতুল এটা টেরই পায় না।
আজকে দিনার টেস্টের রেজাল্ট দিয়েছে।তিনটা সাব্জেক্টে বি এসেছে।বাসায় যাওয়ার একদম ই ইচ্ছে হচ্ছে না।রেজাল্ট খারাপ কোনো ব্যাপার না দিনার কাছে।কিন্তু মা জানার পর যে একটা কাহিনী শুরু করবে এটা ভেবেই হতাশ লাগছে তার।অন্যমনস্ক ভাবে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল।হঠাত পিছন থেকে কে যেন ডাক দিল দিনা কে।পিছন ফিরে তাকাতেই বড়সড় একটা শক খেল ।হাতের বইগুলোও নিচে পড়ে গেছে।অতুল দাঁড়িয়ে আছে।
-একি!! তোমার বইগুলো সব নিচে পড়ে গেল তো!
-জ্বি.. মানে..
-দাঁড়াও আমি তুলে দিচ্ছি।তুমি তো দিনা তাইনা।জিকুর বোন।অই পাঁচ তলা সবুজ বিল্ডিং টায় থাকো।
-জ্বি।
-আমাকে চিনো?
-জ্বি।
-তোমাকে কেন ডাক দিলাম বুঝতে পারছো?
-জ্বি।
-জ্বি জ্বি করলে তো হবে না।বলো কেন ডাকলাম।
-জ্বি.. না।আসলে জানি না আমি।
-যা মনে হচ্ছে সেটাই বলো।
ভয়ে দিনার হাত পা ঠকঠক করে কাপা শুরু হয়েছে।কি বলবে এখন ও! তার মানে ও যে প্রতিদিন অতুলকে দেখতো এটা অতুল খেয়াল করতো!এখন কি হবে! কি না কি ভাবছে দিনা কে।এখন যদি রাস্তায় সবার সামনে বকা দেয়? বই গুলো হাতে নেয়ার সময় অতুলের হাতের জঘন্য কাটা দাগ টা দেখতে পেয়েছে দিনা।সেটা দেখে ভয়ে অন্তর আত্মা একবার কাঁপুনি দিয়ে উঠলো তার।
-কি হলো চুপ করে আছো কেন?
-আমি সত্যি ই জানি না ভাইয়া।
-জানো।প্রতিদিন এইভাবে ছাদে এসে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থাকো কেন!তোমার এইসবের জন্য আমার যে খুব অস্বস্থি হতে পারে এটা কি মনে হয়নি তোমার?
-সরি ভাইয়া।আর উঠবো না ছাদে।
-ছাদে উঠবে না কি করবে সেটা তোমার ব্যাপার।কিন্তু আমার ছাদের দিকে আর কখনো তাকাবে না।তুমি নিশ্চয় চাও না তোমার জন্য আমার ছাদে উঠা বন্ধ হয়ে যাক।
-না ভাইয়া।আপনি যা বললেন মনে থাকবে আমার।
-ভেরি গুড। যাও বাসায় যাও। আর কিছু বলতে চাইলে ফেসবুকে বলো।
-ফেসবুকে মানে?
-দিনা তুমি আমাকে মোট ছয়বার রিকোয়েস্ট দিয়েছিলে ফেসবুকে।প্রতিবারই ডিলিট করেছি।লাস্ট কালকে দিয়েছো।এক্সেপ্ট করেছি আমি। যাও বাসায় যাও।