গত এক ঘন্টা ধরে মোবাইলে একটি ইমেইল লিখছেন আফতাব সাহেব। দোতলা বাড়ির বিশাল এক ঝুলন্ত বারান্দায় ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে তিনি ধীর গতিতে মোবাইলে টাইপ করে যাচ্ছেন। বয়সের সাথে সাথে কমে এসেছে চোখের জ্যোতি। তাই মোবাইলের ক্ষুদ্র লেখাগুলোও এখন যেন আরও ক্ষুদ্রতর মনে হয়।
৭৫ বয়সী আফতাব সাহেবের অবসরের এই জীবন এখন বেশির ভাগই কাটে বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে। কখনো পত্রিকা পড়ে, কখনো পুরনো ক্যাসেট প্লেয়ারে পুরনো দিনের গান শুনে, আবার কখনো বা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে স্ত্রী রেণুর সাথে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের চিন্তা করতে করতে। অফিস থেকে অবসর নেয়ার সাথে কমে গিয়েছে আফতাব সাহেবের জীবনের সব ব্যস্ততা। অথচ এই কয়েক বছর আগেও করিমের চায়ের দোকানে সন্ধ্যাবেলায় এলাকার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া হতো। ইতোমধ্যে জীবনের ইতি টেনেছে অনেক বন্ধু। বাকিরা প্রায় সবাই অসুস্থ। করিমও কিছুদিন আগে স্ট্রোক করে বিছানায় পড়েছে। ওর ছেলেই এখন চায়ের দোকানটা সামলায়। সেই সাথে ঘরের সমস্ত বাজার সদাইয়ের দায়িত্বও ছেলেটাকে বুঝিয়ে দিয়ে যেন কর্মহীনতাকে আরেকটু পূর্ণতা দিয়েছেন রেণু। সন্ধ্যার পর আগের মতোই এলাকার যুবক ছেলেদের দিয়ে কোলাহলপূর্ণ হয়ে ওঠে করিমের চায়ের দোকান। আফতাব সাহেব প্রতিদিন আনমনা হয়ে চেয়ে থাকেন সেদিকে। কি জানি, কি ভাবেন!
তিন ছেলেমেয়ে, বাবা-মা আর স্ত্রীকে আফতাব সাহেবের সংসার এক সময় অনেক কোলাহলপূর্ণ ছিল। সময়ের সাথে গত হয়েছেন বাবা-মা। বড় হয়ে ছেলেমেয়েরা নিজেদের জগতে, জীবন নিজেদের মতো সাজিয়ে নিয়েছে। বড় ছেলে বউ-বাচ্চা নিয়ে ক্যানাডায় স্যাটল, একমাত্র মেয়ে শ্বশুর বাড়ি আর ছোট ছেলে পড়ালেখার জন্য অস্ট্রেলিয়া। এতক্ষণ ধরে তিনি ছোট ছেলেকেই মেইল লিখছিলেন। আফতাব সাহেবের মতে ইদানিং ছেলেটা অনেক বেয়াদব হয়ে গিয়েছে। সেদিন ফোনে বিয়ের কথা তুলতেই ছেলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে তার নিজের পছন্দেই বিয়ে করবে, এসব নিয়ে কারো কিছু ভাবতে হবে না, একাই সে সব করতে পারবে। আফতাব সাহেব ছেলেমেয়েদের পছন্দ নিয়ে কখনো কোন আপত্তি করেন নাই। কিন্তু তাই বলে মুরুব্বিদের পরামর্শ নিবে না, আশীর্বাদ নিবে না? চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বেতের চেয়ারটা টেনে এনে আফতাব সাহেবের পাশে এসে বসেন রেণু,
– ছেলে চিঠি পেয়েছে? কিছু জানিয়েছে?
– মেইল তো করলাম। এখনো কিছু বলছে না।
– ফোন দিতে। আবার এইসব মেইল না কি দিতে গেলে কেনো? ছেলের যে রাগ। দেখেটেখে কিনা
– এত রাগ তো ভালো না। আমরা ওর বাবা-মা। আমাদেরও রাগ থাকতে পারে। এই তুমি রাগ ভাঙাতে প্রতিবার ফোন দিয়ে ছেলেকে মাথায় তুলেছো।
– আমি আবার কি করলাম! ওসব মেইল টেইল আমি পারি না। ফোনই ভালো। ছেলেটা একা একা থাকে। খোঁজ নিব না?
– আমাদের ছেলেমেয়ে গুলা কেমন যেন হয়ে গেল রেণু। আমাদের এখন ভালোই লাগে না তাদের।
– না গো না। ওই বিয়ের কথা বলেছো তো। তাই একটু রেগে গিয়েছে। জানই তো চার বছর ধরে এক মেয়েকে পছন্দ করে। অন্য মেয়েকে কি আর বিয়ে করবে?
– আহহা! আমি তো ওকে বিয়ে করতে বলি নাই। শুধু একটু কথা বলে দেখতে বলেছি।
– তোমার কথা হয়তো বুঝতে পারেনি
– অবশ্য আমিও এমনই করেছিলাম বাবা যখন সাফ জানিয়ে দিয়েছিল তুলিকে বিয়ে করা যাবে না। আমারই ছেলে তো। এক ডিগ্রী বেশি ঘাড়তেরা আর কি।
কথাটা বলে হাসতে হাসতে চায়ের কাপে চুমুক দেন আফতাব সাহেব। রেণু ইতোমধ্যে মুখ গোমড়া করে ফেলেছেন। মাথা নিচু করে দ্রুত চাটুকু শেষ করে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। আফতাব সাহেব আবার বলা শুরু করেন,
– জানো রেণু? আমাদের ক্লাসের সবথেকে সুন্দরী ছিল এই তুলি মেয়েটা, সেই সাথে অনেক ট্যালেন্টেড। সবসময় রঙ্গিন শাড়ি পরে ক্লাসে আসতো। চোখে মোটা করে কাজল দিত, আর চুল খোপা করে রাখতো। চুলের একপাশে মৌসুমী ফুল গুঁজে রাখতো। কি যে অপরূপ লাগতো। সমস্যা শুধু ছিল তুলি আমার সমবয়সী ছিল। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। বাবা আর্মি অফিসার ছিল। দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতো। বাবা কিছুতেই মেনে নিত না। আমাদের সময় কি আর এত আধুনিক মেয়ের চাহিদা ছিল!
কথগুলো বলতে বলতেই মোবাইলে মান্না দে’র গান ছাড়েন আফতাব সাহেব, “দ্বীপ ছিলো, শিখা ছিলো; শুধু তুমি ছিলে না বলে আলো জ্বললো না…” গত পরশুদিন বড় নাতনির কাছ থেকে মোবাইলে গান চালানো শিখে নিয়েছেন তিনি। রেণু আর কিছু না বলে, চায়ের কাপ দুটো হাতে নিয়ে আস্তে করে সেখান থেকে চলে গেলেন। রেণুর উঠে যাওয়া টের পেলেও না দেখার ভান করে গানে মনোযোগ দিলেন।
মিনিট পনেরো-বিশ পরে বারান্দা থেকে নিজের ঘরের দিকে গেলেন আফতাব সাহেব। দরজার কাছ থেকে উঁকি দিয়ে রেণুকে দেখছেন তিনি। রেণু নিজের বাঁকা চোখে মোটা করে কাজল আঁকছেন। আফতাব সাহেব মুগ্ধ তাকিয়ে থাকেন। গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে এই অদ্ভুত মানবীর প্রতি তিনি বরাবরই মুগ্ধ হয়ে আসছেন।
পড়ালেখা শেষ করে সবে মাত্র সরকারি চাকুরিতে ঢুকেছেন। এমন সময় আফতাব সাহেবের বাবা একদিন ডেকে বললেন বিয়ে করতে হবে। পাত্রী তার বন্ধুর মেয়ে রেণু। আফতাব সাহেবের মাথায় সেদিন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। একে তো এত জলদি বিয়ে করতে প্রস্তুত ছিলেন না তিনি, তার উপর ক্লাসের সবথেকে সুন্দরী তুলির ভূত তখনো উনার মাথা থেকে যায়নি। অনেক ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ে থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। বাবার এক কথাই শেষ কথা। বিয়েটা হয়ে যায় রেণুর সাথে। এরপর আর কি! শুরু হয় সংসার জীবন। কাঁধে আসে একগাদা দায়িত্ব। শুরু থেকেই রেণুর সাথে মনের একটা দূরত্ব ছিল। কেমন সাধাসিধা একটা মেয়ে। একদম সাজে না। চুপচাপ থাকে। তবে মেয়েটার মধ্যে কিছু একটা ছিল। কিভাবে যেন মনের খবর জেনে যেত। কিছু বলার আগেই সবার সব কাজ কিভাবে যেন হয়ে যেত। রেণু আসার পর একদম হঠাত করেই আফতাব সাহেবদের বাড়িটা কেমন সাজানো গোছানো ঘর হয়ে গেল।
বিয়ের কিছু দিন পরেও আফতাব সাহেবের বাবার মারা যান। এর ঠিক দুই বছর পর ক্যান্সার ধরা পড়ে মায়ের। বাঁচবে না জেনেও মায়ের চিকিৎসায় কোনো কমতি রাখেননি তিনি। চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে করতে যখন তিনি প্রায় নিঃস্ব, তখন তার মা মারা যান। শোকের সাথে যোগ হয় অভাব। বাবার করে যাওয়া বাড়িটা ছাড়া পুঁজি আর কিছুই নেই। শুরু হয় জীবন যুদ্ধ। চাকুরির পাশাপাশি রাতে টিউশনি শুরু করেন আফতাব সাহেব। রেণু সেই অল্প টাকাতেই কিভাবে যেন দিব্যি সংসারের খরচ চালিয়ে নিত। সাথে আবার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কিছু কিছু করে টাকা জমানোও শুরু করেছিলেন। গ্রামের সাধাসিধা একটি মেয়ে, যার নেই কোনো উচ্চতর ডিগ্রী, সে এমন নিখুঁত ভাবে কেমন করে সব সামলে নিচ্ছেন। আফতাব সাহেব মুগ্ধ হতে থাকেন। নীরবে মনের মাঝে প্রণয় কবে ঠায় করে নিয়েছিল, সেই খবর কেও বলতে পারেনি।
সময়ের সাথে চাকুরি, সংসার, সন্তানের দায়িত্ববোধ চেপে বসে দুইজনের কাঁধের উপর। জীবনের ব্যস্ততায়, চিন্তায় বয়সের দিকে তাকানোর সময়টিও কারো হয়নি। এভাবে একসাথে কেটেছে বহু বসন্ত। হাজারো শোক একসাথে মোকাবেলা করেছে, হাজারো ভয়কে একসাথে জয় করে, পাড়ি দিয়েছে অনেকগুলো সুখের সময়। তবুও একান্ত নিজেদের জন্য একটু সময় আর বের করা হয়ে ওঠেনি। হয়ে উঠেনি একসাথে একসাথে হাত ধরে বৃষ্টিতে ভেজা কিংবা সুরে সুর ইলিয়ে গুনগুন করে ছাদের উপর বসে নজরুল গীতি গাওয়া। রেণু একবার বলেছিল নজরুল সংগীত তার খুব প্রিয়।
আফতাব সাহেবের সব কথাই কোনো এক অদ্ভুত কারণে রেণুর ভালো লাগে। শুধু তুলির কথা বললেই মুখে আষাঢ়ের কালো মেঘ নেমে আসে। মন খারাপ হবে জেনেও আফতাব সাহেব ইচ্ছে করেই মাঝে মাঝে তুলির কথা বলেন। কারণ তুলির কথা শুনেই তো গোমড়া মুখে রেণু যেয়ে বসেন আয়নার সামনে। অনেকটা সময় নিয়ে আফতাব সাহেবের সেই কল্পণার মানবীর মতো নিজেকে সাজানোর চেষ্টা করেন তিনি। আর দরজার আড়াল থেকে মুগ্ধ হয়ে আফতাব সাহেব রেণুকে দেখতেন। রেণুর সাথে কেটেছে তিন যুগের বেশি সময়। প্রকৃতির নিয়মে চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, পড়েছে বলিরেখা, চুলগুলোতে ধূসর রঙ ধরেছে, চোখের জ্যোতি কমেছে, শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ। তবুও কমেনি আফতাব সাহেবের খুনসুটি আর মুগ্ধতা। শাড়ি, কাজল আর খোপায় বুড়িটাকে এখনও যে কি অপরূপ লাগে!
– কি চাই?
রেণুর ডাকে ঘোর কাটে আফতাব সাহেবের। মন চাচ্ছে রেণুকে চমকে দিয়ে গুনগুন করে গেয়ে উঠতে, “তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, এ কি মোর অপরাধ?” কি কারণে যেন আর গাওয়া হয় না। এতগুলো বছরে একবারও গাইতে পারেননি তিনি।
– বৃষ্টি আসছে। ছাদের কাপড় গুলা নিয়ে আসতা?
– হ্যা যাচ্ছি। রেণু ছাদের দিকে পা বাড়ায়। পিছে পিছে আফতাব সাহেবও যান। কাপড় তুলতে তুলতে রেণু বলে,
– ছেলেকে রাতে একটা ফোন দিও। রাগ করে কি হবে বল? আমাদের ছেলেই তো।
– তুমি ছেলেমেয়ে ছাড়া আর কিছু বুঝো না।
– মা হলেও তুমিও বুঝতা। আর ওদের ভালো থাকাতেই তো আমাদের ভালো থাকা তাই না? এই যেমন ধরো তোমার বাবা যদি সেদিন তোমার কথা শুনত, তাহলে আজকে তুলি তোমার জীবনে থাকতো। তোমার জীবনটা কত সুন্দর হতো।
– তা হতো বটে। তবে একটা জিনিস হতো না।
– কি সেটা?
– একটা জীবনে এত ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকে। আর আমাদের এত সুন্দর ছাদে একসাথে নজরুলের গান গাওয়া।
কথাটা বলেই আফতাব সাহেব ছাদের গাছ থেকে নেয়া একটা লাল ফুল গুঁজে দেন রেণুর খোপায়। ধূসর রঙ্গা চুলগুলোতে লাল রঙ কি যে মায়াবী লাগছে। রেণু লজ্জায় লাল হয়ে যায়। ভাঁজ পড়া চিবুকেও সেই গোধুলির লাল রঙ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আফতাব সাহেব রেনুর হাত ধরে গলা ছেড়ে, কাঁপাকাঁপা কন্ঠে গাওয়া শুরু করেন, “আলগা করো গো খোপার বাঁধন, দিল ওয়াহি মেরা ফাস গায় বুড়া-বুড়ির ভালোবাসায় পূর্ণতা দিতে শহরের বুকে বৃষ্টিও নেমে এসেছে। আশেপাশে উঁচু বিল্ডিং থেকে আফতাব সাহেবদের দোতালা বাড়ির এই ছাদটি স্পষ্ট দেখা যায়। এই বয়সে তাদের এভাবে হাতে হাত ধরে গলা ছেড়ে গান গাওয়া কি মানাচ্ছে? আচ্ছা! আশেপাশের সবাই কি ভাববে? বিশেষ করে আজকের ইয়াং জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা? নাগরিক প্রেমের রোজকার হিসাব করতে থাকা ওরা কি বুঝবে এক জীবন এভাবেই ভালোবাসার এমন পাগলামো?