সারপ্রাইজ

সারপ্রাইজ

— মা জানো, আজও কলেজে বন্ধুরা আমাকে নানা রকম কথা শোনালো। মা এই কলেজে ভর্তি না হলেও পারতাম। এই খানে তো সব বড়লোকের ছেলে মেয়েরা পড়ে মা। আমাদের মতো মধ্যবিত্তরা এইসব কলেজে শুধু অপমানিত হয়।

–এইভাবে কেনো বলছিস, কি বলেছে কি তোর বন্ধুরা?
— সেই এক কথা, এই যুগেও আমার হাতে কোনো দামী মোবাইল নেই, আমি নাকি ব্যাকডেটেড। আমার বাবার সামর্থ্য নেই আমাকে কিছু দেওয়ার।
–তোর বাবাকে আজ বলব তোকে একটা মোবাইল কিনে দিতে।
— না মা। বাবাকে কিছু বলো না। বাবার উপর অনেক চাপ। বাবার বেতনের সামান্য কিছু টাকায় সংসার চালানো,

আমাদের দু ভাই বোনের পড়ালেখাই ঠিক মতো চলে না, বাবাকে কিছু বলো না কেমন। শুধু শুধু চিন্তা করবে।
মেয়ে হিয়ার মুখে এই কথা শুনে অশ্রুসিক্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন হিয়ার মা। মেয়ের চোখে চোখ পড়তেই অন্যদিকে ঘুরে বসলেন। কিন্তু ততক্ষণে মায়ের চোখের জল মেয়ের চোখেও ধরা পড়ল।

–মা, তুমিও না। একদম কাঁদবে না। জানো, বাবা যে মাঝে মাঝে হাত খরচের জন্য টাকা দিতো, সেই গুলো জমিয়ে রাখতাম। ওই যে টেবিলে ছোট ব্যাগটা দেখছো, ওতে রেখেছি।আর কিছুদিন পর আমি সেই টাকায় একটা মোবাইল কিনে নেবো, কেমন। কলেজের কেউ আর এটা নিয়ে আমাকে কিছু বলতে পারবে না।

— হুম, হয়েছে। অনেক রাত হলো শুয়ে পড় কেমন।
— ঠিক আছে মা।
–আমি আসছি কেমন।
–আচ্ছা।

মেয়েকে শুইয়ে দিয়ে হিয়ার মা নিজের ঘরে চলে গেলেন। এতক্ষন দরজায় বাইরে দাঁড়িয়ে হিয়ার ছোট ভাই নীল চুপ করে কথা গুলো শুনছিলো। তার লক্ষ্য হিয়ার টাকা রাখার ব্যাগটা।মা চলে যেতেই নীলও নিজের ঘরে চলে গেলো। মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে, কি করে ব্যাগটা হাতানো যায়। যে করেই হোক ব্যাগটা তার চাই। কিন্তু কত টাকা আছে ওই ব্যাগে? ব্যাগটা নেবেই বা কি করে? এসব নানা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। দু একদিনের মদ্ধ্যেই ব্যাগটা যে করেই হোক চুরি করে ফেলতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে সে। পরদিন সকাল। হিয়া কলেজে ঢোকা মাত্রই বান্ধবী নিশার সাথে দেখা। নিশা কোটিপতি বাবার একমাত্র মেয়ে। এই অহংকারে তার মাটিতে পা ই যেনো পড়তে চায় না।

— এই হিয়া, শোন। দেখ আমার বাবা আমাকে এই মোবাইল টা দিলো।
— হুম। অনেক সুন্দর।
–তোর নিশ্চই খুব হিংসে হচ্ছে তাই না?
— আজব তো, তোর বাবা তোকে একটা মোবাইল গিফট করেছে, এতে আমার হিংসে কেনো হবে?
–হবে তো। তোর বাবার তো এরকম একটা মোবাইল কিনে দেয়ার সামর্থ্য নেই, তাই না।
–দেখ, আমার হিংসে হচ্ছে না, আর আমার বাবার সামর্থ্য নেই বলেই যে অন্যেরটা দেখে হিংসে হবে, এরকম কোনো কথা আছে?
–বড় বড় অনেক কথা বলিস দেখছি।
–আমি আসছি, ক্লাসে যেতে হবে।

হিয়া পা বাড়ালো ক্লাসের দিকে। এই কথা গুলো শুনতে তার আর ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে একটা মোবাইল কিনে ওকে দেখিয়ে দিতে যে, আমার বাবাও পারে তার মেয়েকে একটা দামী মোবাইল দিতে। কলেজ থেকে মুখ ভার করে বাড়ি ফেরে হিয়া। মা বুঝতে পারে আবার কিছু বলেছে ওর বন্ধুরা। নীল দশম শ্রেণিতে পড়ে। কিন্তু আজ সে স্কুলে যায়নি। নীলের মনের মদ্ধ্যে আনন্দের বাতাস বইছে। ওর আপুর অনুপস্থিতিতে সকালেই টাকা গুলো সরাতে পেরেছে। আপুর মন খারাপ দেখে মিটিমিটি হাসছে সে। দুপুর ২:০০ টা। হিয়া মন খারাপ করে তার ঘরে বসে আছে। রাগ হচ্ছে নিশা সহ ওইসব বন্ধুদের প্রতি, যারা কথায় কথায় খোটা দেয়। খুব ইচ্ছে করে বন্ধুদের উচিত জবাব দিয়ে দিতে। হঠাৎ টাকার ব্যাগের কথা মনে পড়ল। ব্যাগটা টেবিলেই দেখতে পেলো।

–আচ্ছা এতে ঠিক কতো টাকা হয়েছে, কখনও গোনাই হয়নি, একটু গুনে নেই। ব্যাগটা হাতে নিয়ে হিয়া যেটা দেখল, সেটা দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। একটা টাকাও নেই।কই গেলো টাকা গুলো???

–ওমা, মা। কোথায় তুমি শুনছো?? মেয়ের ডাকে হিয়ার মা দৌড়ে আসলেন।
— কি হয়েছে, এই ভাবে কেনো ডাকছিস?
— মা, ব্যাগে টাকা গুলো নেই।
–কি বলছিস, ভালো করে খোঁজ।
–মা সত্যিই কোথাও নেই। নীল, এই নীল, শুনছিস তুই? নীল ভয়ে হিয়ার ঘরে এসে দাঁড়ালো।
–আপু ডাকছিস আমায়??
–এই ব্যাগে কিছু টাকা ছিলো দেখেছিস??
–ওই গুলো আমি নিয়েছি।

–তুই নিয়েছিস?? কেনো?? দে, টাকা গুলো ফেরত দে আগে।
–আপু টাকা গুলো তো নেই।
–নেই মানে?? কি করেছিস তুই টাকা গুলো??
–আপু টাকা গুলো খরচ হয়ে গেছে।
–নীল, দেখ, মজা করিস না, দে না টাকা গুলো।
–আপু সত্যিই নেই।
— কি করেছিস কি টাকা গুলো দিয়ে?( রেগে)
–সেটা এখন বলতে পারব না।

হিয়া ঠাস করে ওর ছোট ভাইয়ের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো। নীল চড় খেয়ে চুপ হয়ে গেলো, মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল। হিয়ার মা স্তব্ধ হয়ে গেছে। ভাই বোনের কথা গুলো শুধু শুনে যাচ্ছেন তিনি। হিয়া বলতে শুরু করল..

–কত কষ্ট করে কত দিন ধরে টাকা গুলো জমিয়ে ছিলাম। আর তুই একদিনে টাকা গুলো শেষ করে ফেললি, ছি। কি করেছিস টাকা গুলো?? বল। একটুও লজ্জা নেই তোর তাইনা? টাকা গুলো খরচ করতে তোর হাত কাঁপলো না একটুও? তোর টাকা লাগলে আমাকে বলতে পারতিস।আমি কি এর আগে তোকে টাকা দেই নি?? তুই পারলি এটা করতে?? শেষে তুই চুরি করলি?? মা, নীল দুজনেই খুব কাঁদছে। কেউ কিছু বলছে না দেখে হিয়া আবার বলতে শুরু করল..

–মা, তোমার ছেলেকে আমার চোখের সামনে থেকে যেতে বলো তো?

নীল চুপ করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। মাও তার পিছু পিছু দরজা অবধি গিয়ে ফিরে আসল। হিয়া নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে কান্না করতে লাগল। এতো দিন নীলের সব আবদার, সব চাওয়া পাওয়া গুলোকে সে যতটা সম্ভব মেটানোর চেষ্টা করছে। ভাই কে আগলে আগলে রেখেছে। আর সেই ভাই কিনা শেষে ওরই টাকা চুরি করল? খুব কষ্ট হচ্ছিলো ওর। হঠাৎ হিয়ার চোখ পড়ল বালিশের দিকে। ওখানে ছোট করে একটা কাগজে লেখা, “বালিশের নিচে অপমানের জবাব রাখা আছে।” চোখ আটকে গেলো লেখাটার উপর। এটা তো ভাই এর লেখা। বালিশ টা উঁচু করতেই হিয়া দেখতে পেলো, বালিশের তলায় একটা সুন্দর মোড়কে আটকানো একটা গিফট। মোড়ক টা খুলতেই বেড়িয়ে এলো একটা মোবাইল। হিয়া অবাক হয়ে গেলো। ভিতরে একটা চিরকুট দেখতে পেলো।চিরকুটের ভাঁজ খুলে লেখাটা পড়তে শুরু করল,

প্রিয় আপু,
পত্রের শুরুতে আমার একশোটা স্যরি নিস। কারন তোকে না জানিয়েই তোর টাকা গুলো নিয়েছিলাম। জানি কাজটা ঠিক করি নি। কিন্তু তোকে স্যারপ্রাইজ দেওয়ার লোভটা সামলাতে পারলাম না। জানিস আপু, তুই যখন তোর কলেজের বন্ধুদের বলা কথা গুলো মায়ের সাথে শেয়ার করতিস, তখন আমি সে গুলো চুপ করে শুনতাম। আমার খুব খারাপ লাগত। কিন্তু আমার তো আর সামর্থ্য নেই, যে তোকে একটা মোবাইল কিনে দেবো। তাই তোরই টাকা চুরি করলাম। আপু মোবাইলটার দাম ১৩০০০ টাকা। তোর ব্যাগে ৯০৫০ টাকা ছিলো। জানি তুই অনেক দিন ধরে টাকা জমিয়েছিস। কিন্তু আমিও তোর ভাই। বাবা আমাকে যে মাঝে মাঝে টাকা দিতো, সেগুলো আমিও জমা করতাম। অনেক আগে থেকেই। তোর থেকেই শেখা অবশ্য। ৯০৫০ টাকার সাথে আমার টাকা গুলো ভরে আমার এক বন্ধুর সাহায্য নিয়ে, আজ সকালে এই মোবাইল টা তোর জন্য কিনেছি। আপু এবার তুই তোর বন্ধুদের বলবি, তোর বাবারও তোকে কিছু দেয়ার সামর্থ্য আছে। আপু আবারও স্যরি, তোকে এসব জানাই নি বলে। কিন্তু তুই রাগ করিস না কেমন। আপু তুই কিন্তু অনেক ভালো। অবশ্য দেখতে হবে না, আপুটা কার।

ইতি
তোর ভাই
নীল

চিরকুটটা নিজের অজান্তেই হাত থেকে ফেলে দিলো হিয়া। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে চলে গেলো। হিয়ার মা মনখারাপ করে বসেছিলো। মেয়েকে এই ভাবে কাঁদতে দেখে সে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,

— কি হলো, এই ভাবে কাঁদছিস কেনো?
–পরে বলব। আগে বলো নীল কই??
–দেখলি তো, কোথাও একটা চলে গেলো। রাগ পড়ে গেলে আবার ঠিক চলে আসবে।
–না মা, ওকে এখুনি চাই। মা আমি আসছি।

বলেই দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে এলো হিয়া। নীল কে আশে পাশে খুজতে লাগল। পাশের খেলার মাঠে গিয়ে দেখল, সেখানেও নীল নেই। খুজতে খুজতে হয়রান হয়ে গেলো। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। হিয়া প্রায় ভিজেই যাচ্ছিলো। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। কোথায় খুঁজবে সে নীলকে? হঠাৎ মনে পড়ল, নদীর পাশে বকুল গাছের কথা। আগে নীলের মন খারাপ হলেই ওখানে গিয়ে বসে থাকত। হিয়া জলদি নদীর পাড়ে চলে এলো। দেখল নীল বসে আছে। বৃষ্টিতে বসে বসে ভিজছে। কাছে গিয়ে ডাকল..

–নীল। নীল ওর আপু কে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালো। হিয়া বুঝতে পারল নীল কান্না করছিলো। হিয়ারও কান্না করছিলো। কিন্তু বৃষ্টির জলের ফোঁটা দুজনের চোখের নোনা জলকে ঢেকে রেখেছিলো।

–খুব বড় হয়ে গেছিস, তাই না?? একবারো বলতে পারলি না যে, টাকা গুলো দিয়ে তুই আমার জন্য মোবাইল কিনেছিস। নীল মাথা নিচু করে উত্তর দিলো..

— তোকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।
–তাই বলে এই ভাবে!!! এর পর আবার এরকম করিস, তোর একদিন কি আমার একদিন।
–স্যরি আপু।
–একদম স্যরি বলবি না। এইবার বাসায় চল। সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে। মা চিন্তা করছে।
–তুই মাফ করেছিস তো আমায়??
–আর একটা কথা বলবি তো, দশটা চড় লাগিয়ে দেবো। তোর সারপ্রাইজটা আমার জীবনের সেরা সারপ্রাইজ নীল। চল বাসায়, চল।
— চল।( হাসি মুখে)

তারপর দুই ভাই বোন হাত ধরে, বাড়ির পথে পা বাড়ালো। পেছনে পড়ে রইল একটা নদী, তার পাড়, একটা বকুল গাছ, আর আকাশের বৃষ্টি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত