স্মৃতিচারণ

স্মৃতিচারণ

সেদিন ছিল রবিবার আমার ছুটির দিন। সকালবেলা ঘুমাচ্ছিলাম, হঠাৎ ছোট বোনটা এসে বলল, এই দাদা উঠ পাশের বাসার আন্টি তর সাথে কথা বলতে এসেছে। খুবই বিরক্তিকর অবস্থা ছিল, ছুটির দিন সারাদিন ঘুমাবো তাও শান্তি নাই। বিরক্তি ভাব নিয়ে আন্টির সামনে যাওয়ার পর তিনি অতি বিনয়ী ভঙ্গিতে বললেন, বাবা আমার সাথে একটু কোর্টে যাবে। বেশি না দু’ঘন্টা সময় লাগবে। আমি বললাম,জি আচ্ছা।

আন্টি চলে যাওয়ার পর তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, কি মা ছুটির দিনটাও শান্তিতে ঘুমোতে দিবে না? মা বললেন, উনি অসুস্থ মানুষ কোথাও কোন দূর্ঘটনা ঘটলে দেখার কেউ নেই। তুই তো ফ্রি আছিস চলে যা বাবা। নিরুপায় হয়ে সেদিন আন্টির সাথে গিয়েছিলাম। আন্টির গাড়িতে করে যাওয়ার সময় লক্ষ করলাম,উনি খুব উদাস ভাবে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন। চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, যেন এখনি কেঁদে দিবেন। সাথে দুটো বড় বড় টিফিন বাটি। এগুলো কিসের জন্য তা জিঙ্গেস করার সাহস পেলাম না। কোর্টে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, উনার ছেলে মামুন এলাকার নামকরা রাজনীতিবিদ। দুঃখের বিষয় উনার দলের লোকই উনাকে এক হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে কোর্টে চালান করেছে যার কারণে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ানো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কোর্টের সামনে নেমে আন্টি একটি ফাইল নিয়ে এগিয়ে গেলেন। সকালবেলাও কোর্টে মানুষের প্রচন্ড ভীড়। আন্টি বললেন, তুমি থাক এখানে আমি কাজ সেরে আসছি। আমি বললাম, আন্টি আমাকে বলুন কি করতে হবে? দেখছেনই ত কত বড় লাইন। আন্টি বললেন বাবা কোর্টের কাজটা আমাকেই করতে হবে তুমি বসো আমি আসছি। নিরুপায় হয়ে চায়ের দোকান বসে চা খাচ্ছিলাম।

হঠাৎ করে সেনাবাহিনীর এক সৈনিক আসলেন। উনার হাতেও একটা ফাইল। সবার সাথে এসে লাইনে দাঁড়ালেন। এটা দেখে এত লম্বা লাইনের সবাই নিজের জায়গা ছেড়ে দিলেন। তা দেখে আমি এগিয়ে গেলাম। তারপর তারা সৈনিক’কে বললেন, স্যার আপনি আগে যান। সৈনিক অবাক হয়ে বললেন, কেন আমি আগে যাব কেন? আমি ত সবার পরে আসলাম। এসেই অপেক্ষামান এত মানুষের আগেই কাজ সারবো!! কারণ কি? আমি সেনাবাহিনীর লোক বলে? সবাই চুপ করে রইলো।

তারপর তিনি বললেন, আপনারা যেমন কষ্ট করে এই কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে আছেন ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের কাজটা শেষ করার জন্য তেমনি আমারও উচিত সবার সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে কাজ শেষ করা। যদিও আমার কাজটা অনেক জরুরী তবুও আমি লাইনে দাঁড়িয়েই কমপ্লিট করবো। আমরা সবাই ত মানুষ শুধু আমার গায়ের পোশাকটা আমাকে আলাদা করেছে। এসন শুনে সবাই হাততালি দিল। সৈনিক মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, চাচা আমরা সেনাবাহিনী বলে সবাইকে শাস্তি দেই না। যারা খারাপ তাদেরকেই শাস্তি দেই। সবাই একসাথে হেসে উঠল। সেদিন থেকে আমার মনে সেনাবাহিনীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান জেগেছিল। যাই হোক, সেখান থেকে বের হয়ে আমরা জেলখানায় গেলাম। দেখা করার জন্য আমাদের ৫মিনিট সময় দেওয়া হল। মামুন ভাই এসেই বললেন,

– মা ভালো আছ?
– হু তুই কেমন আছিস বাবা?
– হে খুব ভালো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি’রে কেমন আছিস? আমি হুম বলে উনার দিকে বোকার মত তাকিয়ে রইলাম।

মামুন ভাই টিফিন বক্স দেখে বললেন,দুটো টিফিন কেন? মা আমি কি আর আগের মত রাক্ষস ভোজন করতে পারি? বলেই কেঁদে দিলেন। মামুন ভাই কেঁদে কেঁদে বললেন, মা তোমার কসম আমি কাউকে মারিনি। সব মিথ্যা মামলা। ওরা আমার সাথে এমন করবে তা ভাবিনি কখনো। প্লিজ ভুল বুঝ না আমায় । আন্টি ও কেঁদে দিলেন…

– আন্টি বললেন,না রে বাবা আমি জানি ত আমার ছেলে কেমন। তুই চিন্তা করিস না। যেভাবেই হোক আমি তকে বের করে আনবোই।
– মা আমি আর কখনোই তোমার অবাধ্য হব না। সবকিছু ছেড়ে দিব।

আন্টি কেঁদেই চলেছেন। এরই মধ্যে একজন কনস্টেবল এসে বলল, এই ভাই সময় শেষ তাড়াতাড়ি বের হোন। বলেই একরকম জোর করেই আমাদের বের করে দিযেছিল। আন্টি গাড়িতে বসেই আমার শার্ট ভিজিয়ে দিলেন। পুরোটা রাস্তা কেঁদে ভাসিয়েছিলেন। উনার সাথে সাথে আমার চোখেও কখন জল আসলো তা বুঝতেই পারিনি। তবে, সেদিনই বুঝেছিলাম, মায়ের ভালোবাসার চেয়ে মধুর অন্য কিছু হতেই পারে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত