ভাতের প্লেটটা সামনে নিয়ে বসলেন রহমান মিয়া। প্রথম লোকমা মুখে দিতে গিয়ে থেমে যান। ছেলে আকিবকে ছাড়া একা একা খাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই তার। আকিবের রুমের দিকে পা বাড়ান ভাতের প্লেটটা টেবিলে রেখেই। রুমে ঢুকে দেখেন আকিব ঘুমে বিভোর। রহমান মিয়া আকিবের মাথার কাছে বসে কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর আস্তে আস্তে জাগানোর চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণ পর আকিব জেগে উঠে। বাবাকে ডাকতে দেখে বলেঃ
– ‘এত সকালে কি কেউ ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়?’
– ‘বাবা, আয়! তোর সাথে খাওয়ার জন্য আমি না খেয়ে বসে আছি। তুই ফ্রেশ হয়ে নে। আমি খাবার রেডি করি।’
– ‘আমি খাব না। তুমি খাও। তুমি এখন যাও, আমি ঘুমাব।’
রহমান মিয়া একটা কথা ও বললেন না। সোজা রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। মনে মনে বলতে লাগলেন- “আজ যদি আকিবের মা বেঁচে থাকত তাহলে ছেলেটা আমার সাথে এমন করত না। মা মারা যাওয়ার পর থেকে কেমন জানি হয়ে গেল! হে আল্লাহ, তুমি আমার ছেলেকে দয়া কর।” খাবারের টেবিলে এসে ভাতের প্লেটটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেন রহমত মিয়া। হাত দিয়ে ভাতগুলো নাড়াতে লাগলেন। কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর প্লেইটটা নিয়ে বাইরে চলে যান। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াতে থাকা কুকুরকে খাবার গুলো দিয়ে বাসায় ঢুকলেন। রহমত মিয়া বসে বসে পত্রিকা পড়ছেন। এমন সময় আকিব এসে বললঃ
– ‘বাবা, টাকা দাও।’
– ‘কালকেই না টাকা নিলি।’
– ‘আমি রেস্টুরেন্টে খেতে যাব। টাকা দাও।’
– ‘বাসায় তো রান্না করা আছে। তুই খেয়ে নিলেই তো পারিস।’
– ‘খাব না। তুমি কি টাকা দিবা নাকি দিবা না?’
– ‘বাবা, দেখ! আমার রিটায়ারমেন্টের টাকায় আর কয়দিন চলে? তুই তো অনার্স কমপ্লিট করলি। পড়াশুনার পাশাপাশি একটা কিছু কর।’
– ‘ওইটা পরে দেখব। এখন পাঁচশ টাকা দাও।’
– ‘এই নে। এই দুইশ রাখ।’
– ‘না। লাগবে না আমার।’
– ‘রাগ করিস না বাবা। নে আরো একশ টাকা।’
– ‘দাও।’
তিনশ টাকা পকেটে ঢুকিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় আকিব। তার গার্লফ্রেন্ড মাহি কে কল দিয়ে জানিয়ে দিল রেস্টুরেন্টে আসতে। সে নিজে ও হাঁটতে থাকে সেই রেস্টুরেন্টের দিকে। রেস্টুরেন্টে পাশাপাশি বসে আছে আকিব ও মাহি। তাদের মাঝে কথোপকথন চলছে। মাহি বললঃ
– ‘এই বাবু, কয়েকদিন পরেই তো ভালোবাসা দিবস।’
– ‘হ্যাঁ, জানি তো।’
– ‘আমার বান্ধবী শিলাকে নাকি ওর বয়ফ্রেন্ড আট হাজার টাকা দামের জামা নিয়ে দিচ্ছে।’
– ‘তাতে আমার কি? আমি তো তোমাকে দশ হাজার টাকা দামের জামা নিয়ে দিব।’
– ‘আমি আগেই জানতাম। আমার বাবুটা কত্ত ভালো!’
– ‘হুম।’
– ‘তাইতো তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’
– ‘আমি ও।’
– ‘এই, আমি তোমাকে একটা একশ টাকা দামের ঘড়ি গিফট করব।’
– ‘আচ্ছা।’
তের’ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যাবেলা আকিব তার বাবা রহমত মিয়ার কাছে গিয়ে বলেঃ
– ‘বাবা, আমার বেশ কিছু টাকা লাগবে।’
– ‘কত টাকা বাবা?’
– ‘দশ হাজার টাকা হলে চলবে।’
– ‘এত টাকা! আমি কোথায় পাব?’
– ‘তুমি একটু ব্যাবস্থা করে দেখ।’
– ‘এত টাকা দিয়ে তুই কি করবি?’
– ‘আমি একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। সেটাতে আমি টিকেছি। এখন কিছু টাকা দিলেই চাকরিটা হয়ে যাচ্ছে।’
ছেলের চাকরির খবর শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান রহমত মিয়া। আলমারি থেকে একটি টাকার বান্ডিল বের করে আকিবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন- ‘এই টাকাটা আমার চিকিৎসার জন্য রেখেছিলাম। নে, এই টাকাগুলো নে। চাকরি করে টাকা জমিয়ে আমার চিকিৎসা করাবি। ঠিক আছে?’ কথাটা বলেই একটা হাঁসি দিলেন তিনি। আকিব টাকাগুলো নিয়ে বাড়ি থেকে সোজা মার্কেটের দিকে চলে যায়। মার্কেটে ঢুকে দশ হাজার টাকা দিয়ে একটি জামা কিনল মাহির জন্য। আকিব মনে মনে ভাবল- জামাটা দেখালে মাহি চমকে যাবে।
চৌদ্দ’ই ফেব্রুয়ারি খুব সকালবেলা মাহির জন্য নেওয়া কাপড়টা সাথে নিয়ে মাহির সাথে দেখা করতে চলে যায় আকিব। মাহির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। দুই ঘন্টা অপেক্ষা করার পর মাহি পৌঁছল। মাহির হাতে জামাটা দিতেই মাহি খুশি হল। মাহি ব্যাগ থেকে একটি ঘড়ি বের করে আকিবের হাতে ধরিয়ে দিল।
রহমান মিয়ার বুকের ভিতর কেমন জানি করতেছে। এই বুঝি পড়ে যাবেন। শোয়া থেকে উঠতে পারছেন না। ঔষধগুলোর নাগাল পাচ্ছেন না। আকিবকে কয়েকবার ডাকার পর ও সাড়া না পেয়ে নীরব হয়ে যান। উঠে বসার মত শক্তিটা শরীর থেকে ফুরিয়ে গেছে। এক পর্যায়ে পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে খাটের উপর শুয়ে থাকা অবস্থায় চিরতরে চোখ বন্ধ করেন।
সারাদিন গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঘুরাঘুরির পর রাত করে বাসায় আসল আকিব। ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই চোখ বেয়ে নেমে এল ঘুম। পুরো বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা। বাড়ির দুইজনই ঘুমিয়ে আছে। একজনের ঘুম ক্ষণস্থায়ী হলে ও অন্যজনের ঘুম চিরতরে; কেউ কারো খবর জানে না।
সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই একটা অদ্ভুত রকমের গন্ধ আবিরের নাক ছুঁয়ে যায়। গন্ধের সূত্র ধরে সে বাবার রুমের দিকে হাঁটে। যতই বাবার রুমের কাছে যাচ্ছে ততই গন্ধটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। রুমে ঢুকে বুঝতে পারে গন্ধটা বাবার শরীর থেকেই উঠছে। নাকে হাত দিয়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ডাকতে থাকে – ‘বাবা, বাবা, উঠ’ বলে। কিন্তু বাবার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। চোখ দুটো নড়ছে না। একটি হাত তখনো পিঠের নিচে চাপা পরে আছে। আকিবের চোখ দিয়ে তখন জগতের অশ্রুকণা পতিত হচ্ছে এক বিশাল ঝর্ণার ন্যায়।