বাসা নং-37

বাসা নং-37

মেয়েটির নাম জান্নাত। খুবই মেধাবী, চঞ্চল, রাগী এবং জেদি একটা মেয়ে। ছোটবেলা থেকে তার ইচ্ছা, সে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য বিদেশে লেখাপড়া করবে। তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর সাহস তাকে তার সেই ইচ্ছা পূরণে সহায়তা করে। সে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য নিজ পরিবার, নিজ দেশ, নিজ জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশ পানে যাত্রা করে। বিমানের মধ্যে তারই সমবয়সী একটা ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়। জান্নাত ছেলেটিকে তার নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলে, তার নাম নিরব। বাসা ঢাকাতে। আলাপচারিতা শেষে জান্নাত জানতে পারে, সে যেই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে যাচ্ছে। নিরবও সেই একই ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। যতক্ষণ তারা বিমানের মধ্যে ছিলো, ততক্ষণ তাদের দু’জনের মধ্যে খুব ভাব জমে গিয়েছিলো। কথা প্রসঙ্গে নিরব জান্নাতকে জিজ্ঞেস করে, ওখানে থাকার কী কোনো ব্যবস্থা হয়েছে। জান্নাত বলে, “না, এখনও কোনো ব্যবস্থা হয়নি। তবে ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে থাকবো বলে ভেবেছি।”

– গুড জব।
– আপনি কোথায় থাকবেন?
– আমিও আপনার মতোই ভেবেছি।

বিমান গন্তব্যে ল্যান্ড করলে তারা দু’জনে নেমে পড়ে বিমান থেকে। নেমে জান্নাত নিরবকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কোথায় যাবেন এখন? নিরব বলে, “এখানে আমার এক আত্মীয় আছেন। দেখি তার ওখানে গিয়ে উঠি।”

– ও, আচ্ছা।
– আপনি চাইলে আসতে পারেন আমার সাথে।
– নো, থ্যাংকস।

দু’জন দুই দিকে হাঁটা ধরে। একজনের গন্তব্য তার আত্মীয়ের বাসা। আর অন্যজনের হোস্টেল। ইউনিভার্সিটির হোস্টেল মানে সে যেন এক স্বপ্নপুরী। তবে সেটা শুধু বিদেশের জন্য। হোস্টেলে জান্নাতের পরিচিত একটা মেয়ে থাকে। মেয়েটি তার থেকে কয়েক বছরের বড়। জান্নাত মেয়েটির সাথে যোগাযোগ করে তার হোস্টেলে ওঠে। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয়, হোস্টেলে কোনো সিট খালি নেই। তাই সে নিরুপায় হয়ে সেই রাতটা হোস্টেলে থেকে পরদিন একটা বাসা ঠিক করে ফেলে। মেইন রোড থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে আটতালা বিশিষ্ট একটি বাসার পঞ্চম তালায় সাবলেটে একটা রুম নেয় সে। বাসাটা শহরের এক কোণে।

তবে বাসা থেকে তার ইউনিভার্সিটি বেশি দূরে নয়। বাসার মেইন ফটকে লেখা “Red of Rose, House No-37” নামটা বেশ অদ্ভূত। তবে মন্দ হয়। বাসাটাও নামের মতোই অনুপম। আবার বাসার ভাড়াটাও খুব একটা বেশি নয়। জান্নাত তার মনের মতো করে নিজের রুমটা গুছিয়ে ফেলে। দুপুরে পাশের রুম থেকে একটি মেয়ে এসে তার সাথে পরিচিত হয়। কিন্তু বিস্ময়কর একটা বিষয় হলো মেয়েটিও বাঙালী। এখানে সে তার হাজবেন্ডের সাথে থাকে। আজ ছুটির দিন বিধায় তারা বাসাতে রয়েছে। অন্য দিনগুলোতে তারা সকাল সকাল অফিসের কাজে বাসা থেকে বের হয়। আবার রাত হলে বাসায় ফেরে। মেয়েটি জান্নাতকে বলে, “দুপুরে খেয়েছেন?” জান্নাত মৃদু হেসে জবাব দেয়, “না। তবে রুমের বাকি কাজগুলো শেষ করে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসবো।”

– আচ্ছা আপনি বাকি কাজগুলো করতে থাকেন। আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে অাসছি।
– না না থাক, আমি বাইরে গিয়েই খেয়ে নেবো।
– তা কী করে হয়? আপনি থাকুন, আমি আসছি।

মেয়েটি চলে গেলো জান্নাতের রুম থেকে। মেয়েটির নামের মতো তার চেহারাটাও অনন্য, অভিন্ন। অনেক সুন্দর করে কথা বলে মেয়েটি। মেয়েটির কথার মধ্যে এক ধরনের মায়া আছে। যা কোনো মানুষকে মুহূর্তেই আকৃষ্ট করতে পারবে।

জান্নাত রুমের বাকি কাজগুলো সেরে স্নানাগারে গিয়ে স্নান সেরে নেয়। স্নানাগার থেকে বের হতেই দেখে নিঝুম অর্থ্যাৎ সেই মেয়েটি তার রুমে বসে আছে। টেবিলে হরেক রকমের খাবারের সমাহার। জান্নাত মনে মনে ভাবে, সে তো রুম বন্ধ করে গোসল করতে গিয়েছিলো। তবে নিঝুম রুমে ঢুকলো কী করে!

– জান্নাত, টেবিলে খাবার রাখা আছে। খেয়ে নিন। অনেক পরিশ্রম করেছেন আপনি। জান্নাত কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে বলে, “ধন্যবাদ আপু।”
– আর হ্যাঁ, যখন স্নান করতে যাবেন। তখন রুমটা অবশ্যই বন্ধ করে যাবেন। জান্নাত ছোট্ট করে বললো, “জ্বী আপু।”

নিঝুম তার রুম থেকে চলে যেতেই সে ভাবে, তাহলে কী সে স্নান করতে যাওয়ার আগে রুম বন্ধ করে যায়নি? হবে হয়তো! বিকেলে সে ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়। বাসার ফটক পেরোতেই একজন মধ্য বয়স্ক লোক এসে তাকে হাত নাড়িয়ে কিছু একটা বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু জান্নাত লোকটির আকার ইঙ্গিতে কিছুই বুঝতে পারে না। সে ভেবে নেয়, লোকটি হয়তো বাক প্রতিবন্ধী হবে। কেননা সে কথা বলতে পারে না।

সায়াহ্নে সে বাসায় ফেরার সময় লক্ষ্য করে কেউ একজন তাকে অনুসরণ করছে। সে বিষয়টা ভালো করে বোঝার জন্য পেছন ফিরে তাকায়। কিন্তু পেছনে তাকিয়ে দেখে কোথাও কেউ নেই। মেইন রোড থেকে সে তার বাসায় যাওয়ার রোডে পা রাখতেই হঠাৎ করে একটা লোক তার সামনে এসে দাঁড়ায়। সে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলে, “আপনি? এখানে কী হ্যাঁ? আর এটা কেমন ভদ্রতা যে, বলা নেই কওয়া নেই হুট করে সামনে এসে দাঁড়াবেন?”

জান্নাতের কথায় লোকটি মুখে কোনো জবাব না দিয়ে আবারও হাত নেড়ে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে। জান্নাত কিছু সময়ের জন্য চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। দেখা চেষ্টা করে আশেপাশে কেউ আছে কিনা! মেইন রোডে মানুষের সমাগম বেশি। তবে কেউ কারো দিকে তেমন লক্ষ্য করে না। কিন্তু বাসায় যাওয়ার এই রাস্তাটা একেবারেই ফাঁকা, জনমানবহীন, নির্জন। সে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। এই লোকটি কে? আর কেনই বা তাকে অনুসরণ করছে! সে লোকটির আকার ইঙ্গিতের দিকে কোনো প্রকার গ্রাহ্য না করে দ্রুত পায়ে বাসার দিকে হাঁটা ধরে। বাসার সামনে যেতেই সে বুঝতে পারে কেউ একজন তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে পেছনে ঘুরে দেখে কেউ নেই। সূর্যটা ততক্ষণে নিজ অস্তিত্ব বিলীন করে তার গন্তব্যে চলে গিয়েছে। চারিদিকে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। সে সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় শুনতে পায়, কেউ একজন তাকে উদ্দেশ্য করে অস্পষ্ট স্বরে বলছে, “জান্নাত তুমি এখান থেকে চলে যাও। এখানে তোমার থাকাটা শুভকর নয়।” চিকন মেয়েলি কণ্ঠস্বর। তবে অপরিচিত।

জান্নাত সেদিকে কোনো প্রকার কর্ণপাত না করে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। তার কাছে এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বেশ অস্বাভাবিক লাগছে। টেবিলের উপর পানির পাত্র ছিলো। সে সেখান থেকে এক গ্লাস পানি পান করে বৈদ্যুতিক পাখাটা ছেড়ে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। চোখে তার একটু তন্দ্রাভাব এসেছে মাত্র, ঠিক সেসময় দরজায় কেউ একজন কড়া নাড়ে। কড়া নাড়ার শব্দে সে ধড়-ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসে নিঝুমের কণ্ঠস্বর।

– জান্নাত, দরজা খোলো। সে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখলো নিঝুম খাবার হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
– আপু আপনি আবার খাবার নিয়ে এসেছেন?
– বিকেলে বাইরে বের হয়েছিলে। কোথায় কী খেয়েছো, না খেয়েছো। সেটা তো দেখিনি। তাই খাবার নিয়ে এলাম। খেয়ে নিও। আর হ্যাঁ, তুমি আমার বয়সে অনেক ছোট হবে। তাই তোমাকে ‘তুমি’ করে বললাম।
– না না, ঠিক আছে আপু। আপনি তুমি করে বললেই শুনতে ভালো লাগে।
– আচ্ছা তাহলে আমি এখন আসি। তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
– জ্বী আপু।!

জান্নাত মনে মনে ভাবছে নিঝুমকে ঐ লোকটির কথা বলবে কিনা! ভাবতেই ভাবতেই তার মুখ থেকে বের হলো, “আপু একটা কথা।”

– হ্যাঁ বলো।
– ঐ.. ঐ লোকটা…।
– কোন লোক? কার কথা বলছো তুমি?
– না না, কিছু না।
– আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে এসে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ো। আর যেকোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে। কেমন?
– জ্বী আপু।

নিঝুম চলে যায়। জান্নাত ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার খেতে বসে ভাবতে থাকে, লোকটি কে? আর লোকটি তাকে আকার ইঙ্গিতে কী-ই বা বোঝাতে চায়ছে। লোকটি তো তার পূর্ব পরিচিতও না। ঠিক সেসময় হঠাৎ করেই একটা অদ্ভূত শব্দ প্রতিধ্বনিত হয় চারিদিকে। শব্দ শোনা মাত্রই জান্নাতের হাতে থাকা গ্লাসটি পড়ে যায়। গ্লাসটা পড়ে যেতেই চারিদিকে শুনশান নিরবতা বিরাজ করে। সে গ্লাসের ভাঙা টুকরোগুলো তুলতেই আবারও সেই অদ্ভুত শব্দটা শুনতে পায়। সে শব্দটা ভালোভাবে শোনার চেষ্টা করতেই আবিষ্কার করে, কেউ একজন কোনো ব্যক্তিকে মারধর করছে। আর তারই শব্দ চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করতে সে দরজা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখে, কেউ কাউকে মারছে কিনা! কিন্তু না, বাইরে কোথাও কেউ নেই। নিঝুমদের রুমের আলোটাও নেভানো। তবে এই মারধরের শব্দ আসছে কোথা থেকে? সে কিছুক্ষণের জন্য ভাবে হয়তো সিড়ির ওদিক থেকে আসছে শব্দটা। সে এক পা দু পা করে সিড়ির দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু না, সেখানেও কেউ নেই। রুমে ফেরার জন্য যেই না সে পেছনে ঘুরেছে অমনি নিঝুম তাকে বলে ওঠো, “কী ব্যাপার? তুমি এখনও ঘুমাওনি?” জান্নাতের পুরো শরীর ভারী হয়ে আসে। সে ঘামছে প্রচুর। হঠাৎ এইভাবে এই অসময়ে নিঝুমকে সেখানে দেখে সে বেশ ভয় পেয়ে যায়। নিঝুমকে যে কিছু বলবে, সেই শক্তিটুকুও তার নেই।

– যাও রুমে যাও। আর রাত হলে কখনও রুম থেকে বাইরে বের হবে না। ঠিক আছে?

জান্নাত কোনোমতে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নেড়ে তার রুমে চলে যায়। পরদিন সকাল হতেই নিঝুম জান্নাতকে ডেকে বলে, জান্নাত অফিসে যাচ্ছি। এই খাবারগুলো রেখে দাও। দুপুরে খেয়ে নিও। জান্নাত নিঝুমের থেকে খাবারগুলো রেখে দেয়। গতরাতের সেই ঘটনাটা বারবার তার চোখের সামনে ভাসছে, “ঐ সময় নিঝুম কী করছিলো ওখানে? নাকি সেও ঐ মারধরের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলো?” দুপুরে খাবার খাওয়া শেষে জান্নাত বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস সমগ্র নিয়ে পড়তে বসে। “বঙ্কিমচন্দ্র” তার একজন প্রিয় লেখক। কেননা সে ট্রাজেডি খুব পছন্দ করে। আর বঙ্কিমচন্দ্র হলেন ট্রাজেডির গুরু। “কৃষ্ণকান্তের উইল” উপন্যাসটা তার ভীষণ প্রিয়। প্রতিদিন সে একটু একটু করে উপন্যাসটা পড়ে। বিশেষ করে রোহিণীর মায়া ভরা কথা, গোবিন্দলালের প্রতি রোহিণীর প্রেম, এই দুইটা জিনিস তার নজর কাড়ে। প্রেমের অংশটুকু সে একবার নয়, বারবার পড়তে থাকে।

বেলা তখন বারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। ঠিক সেসময় আবারও ঐ অদ্ভূত শব্দে জান্নাতের ঘোর কাঁটে। সে বই থেকে মুখ তুলে রুমের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। নাহ! কোথাও কেউ নেই। সে আবারও বইয়ের পানে মনোযোগী হতেই শব্দটা বেশ জোড়ালোভাবে ভেসে আসে। যেন কোনো পুরুষ লোক কোনো স্ত্রী লোককে বেদম প্রহার করছেন। আর স্ত্রী লোকটি ফু্ঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছেন। জান্নাত বিছানার উপর বইটা রেখে বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়। বেলকনির ওদিক থেকেই মূলত শব্দটা ভেসে আসছে। সে বেলকনি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে সবুজ অরণ্যে ভরপুর চারিদিক। কোথাও কোনো বাসা-বাড়ি নেই। নেই কোনো জনমানবের চিহ্ন। এই এলাকা একটু নির্জনই বলা চলে। কেননা এটা মেইন শহর থেকে একটু দূরে। আর এ কারণে এখানকার ভাড়াটাও অন্যান্য বাসা অপেক্ষা কম। তবে শহরে যেতে তেমন কোনো বেগ পোহাতে হয় না।

জান্নাত শব্দের সঠিক উৎস খুঁজে না পেয়ে রুমে ফিরে আসে। এখন আর তার বই পড়তে মন চায়ছে না। একাকী সময়টা বন্ধুদের সাথে কাটানোর জন্য সে ফেসবুকে লগিন করে। নিউজফিড ঘুরতে ঘুরতে একটা সংবাদের লিংকে তার চোখ আটকে যায়। সে লিংকে প্রবেশ করে যা দেখে, তাতে তার মনের সংশয়টা কিছুটা কমে। গোটা গোটা অক্ষরে সেখানে লেখা “কখনও যদি নিজেকে আপনার একাকী মনে হয়। তখন আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন, আপনার আশেপাশে অদ্ভূত কিছু ঘটছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার কোনোকিছুই ঘটছে না। আর ঐ সময়টাতে নিজের মনোবলকে সুদৃঢ় করুন। মানুষের সাথে মেশার চেষ্টা করুন। দেখবেন আপনার মধ্যে আর কোনো একাকীত্ববোধ থাকবে না। আর আপনি তখন আর ঐসব অদ্ভূত কিছুর সম্মুখীনও হবেন না।”

লেখাটা পড়ে জান্নাতের মধ্যে কিছুটা মনোবল ফিরে আসে। হয়তো তার এই একাকীত্বের জন্যই তার সাথে এমন কিছু ঘটছে। আজ রবিবার, আজ তার ভার্সিটি বন্ধ ছিলো। তাই সে বিকেলটা দারুণভাবে উপভোগ করতে বাসার ছাঁদে যায়। ছাঁদটা বেশ পরিপাটি। দেখে তার মনে হয়, কেউ একজন প্রতিদিন ছাঁদে ওঠে এবং ছোট ছোট ফুল গাছগুলোর যত্ন নেয়। সন্ধ্যার দিকে ছাঁদের পরিবেশটা হঠাৎ করেই কেমন যেন পাল্টে যায়। সে দ্রুত ছাঁদ থেকে নেমে রুমে ঢুকতেই আবার সেই মারধরের আওয়াজটা শুনতে পায়। এবার আওয়াজের স্বরটা একটু স্পষ্ট। কোনো একটা স্ত্রী কণ্ঠ বারবার বলছে “leave me, please leave me.”

আওয়াজটা আসছে বেলকনির দিক থেকে। জান্নাত বিষয়টা প্রত্যক্ষ্য করতে এগিয়ে যায় সেদিকে। বেলকনির সমীপে অবস্থান করতেই স্ত্রী কণ্ঠের সেই আর্তনাদটা থেমে যায়। জান্নাত বেলকনির পর্দাটা সরিয়ে দেখে চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। কোথাও কেউ নেই। বেলকনি থেকে রুমে আসতেই আবারও সেই মারধরের আওয়াজ শুনতে পায় সে। এই বিষয়টাকে সে প্রথম দিন “মনের ভুল” মনে করলেও এখন তার কাছে বিষয়টা বাস্তব ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে। কেননা মনের ভুল হলে তো ‘একবার দুইবার’ তা হতে পারে। কিন্তু প্রতিদিন এমন হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। হঠাৎই কেউ তার রুমের দরজায় কড়া নাড়ে। কড়া নাড়ার শব্দে সে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। ধীর পায়ে দরজা খুলতেই দেখে নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে।

– কী ব্যাপার আপু? আজ এতো দ্রুত বাসায় ফিরলেন যে?
– আজ অফিসে কাজের চাপ কম ছিলো।
– ভাইয়া এসেছেন?
– হ্যাঁ।

দু’জনের কথা বলার মাঝে আবারও রুম থেকে সেই অদ্ভূত শব্দটি ভেসে আসে। জান্নাত শব্দ শুনে পেছনে তাকায়। নিঝুমকে যখন সে সেই শব্দটার ব্যাপারে বলতে যাবে। তখন সে দেখে নিঝুম ততক্ষণে চলে গিয়েছে। জান্নাত দরজা বন্ধ করে বিছানার কাছে যেতেই আবারও দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। সে “কে? কে?” বলতে বলতে দরজা খুলে দেয়।

– জান্নাত, তোমার খাবার। নিঝুম তাকে খাবারগুলো দিয়ে চলে যায়।

রাতে ঘুমানোর পূর্বে জান্নাত একবার পুরো রুমটা ভাল করে দেখে নেয়। কোথাও কিছু আছে কিনা? সেদিন রাতে আর সে সেই অদ্ভুত মারধরের শব্দটা শুনতে পায়নি। কিন্তু সকাল হতেই একটা বিকট শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে ধড়-ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। দেখে কাচের তৈরি একটা পাত্র টেবিলের উপর থেকে নিচে পড়ে গিয়েছে। গতকাল রাতে সে পাত্রটিকে অধিক যত্নে টেবিলের উপর রেখে দিয়েছিলো। কেননা সেই পাত্রটির মধ্যে রঙিন মার্বেল পাথর রাখলে পাত্রটি অনন্য রূপ ধারণ করে।

অন্যদিনের মতো আজও সে ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়। বাসার রোডটা পেরিয়ে মেইন রোডে পা রাখতেই একটা লোক তাকে তার নাম ধরে ডাক দেয়। সে পেছনে তাকিয়ে দেখে সেদিনের সেই ‘হাত নাড়িয়ে’ কথা বলা লোকটি। লোকটি তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সে ভেবে পাচ্ছে না, লোকটি হঠাৎ করে বাকশক্তি ফিরে পেলো কিভাবে! সে এবার একটু রেগে গিয়েই বললো, “আপনি আবার এসেছেন?”

– তুমি চলে যাও ঐ বাসা থেকে।
– চলে যাবো কেন?
– যদি নিজেকে অক্ষত রাখতে চাও, তবে ঐ বাসা থেকে দ্রুত প্রস্থান করো।
– কে আপনি? আর এসব আবোল তাবোল কী সব বকছেন আপনি? যান এখান থেকে, যান বলছি। আর কখনও যেন আপনাকে না দেখি আমার চোখের সামনে।

জান্নাতের চোখের পলক পড়তেই লোকটি অদৃশ্য হয়ে যায়। জান্নাত এদিক সেদিক তাকিয়ে লোকটিকে খোঁজে কিছুক্ষণ। কিন্তু লোকটিকে সে আর কোথাও খুঁজে পায় না। সন্ধ্যায় ইউনির্ভাসিটি থেকে ফিরে সে প্রথমে নিঝুমের রুমে নক করে। কিন্তু দেখে রুমে তালা ঝুলানো। নিঝুম এবং আকাশ, তারা এখনও অফিস থেকে বাসায় ফিরেনি। জান্নাত তাদের ফেরার অপেক্ষায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে তাদের রুমের সামনে। ঘন্টা খানেক পর নিঝুম আর আকাশ বাসায় ফিরলে সে নিঝুমকে বলে ওঠে, “আপু একটা লোক আমাকে আজকে কী সব কথা বলেছে।”

– কী কথা?
– আমাকে এই বাসা থেকে চলে যেতে বললো।
– নাম কী লোকটির? আর লোকটি থাকে কোথায়?
– সেটা জানি না আপু। রাস্তায় দেখা হয়েছিলো। আমাকে কথাটা বলেই হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
– কী?
– হ্যাঁ আপু। আর আরেকটা কথা।
– কী?

– আমার রুমে মাঝে মাঝে কাউকে মারধর করার শব্দ শোনা যায়। যেন কোনো পুরুষ লোক কোনো স্ত্রী লোককে মারধর করে।
– কী বলো এসব? আমরাও তো একসময় ঐ রুমে ছিলাম। তখন তো কিছু শুনিনি।
– জানি না আপু, আমি আর ঐ রুমে থাকতে পারবো না। আমার ভয় লাগছে ভীষণ।
– আরে আরে ভয় পাওয়ার কি আছে? কিছু হবে না। তুমি রুমে যাও। এবার কোনো সমস্যা হলে আমাকে সাথে সাথে নক করবে। কেমন?
– আচ্ছা আপু।
– এবার যাও তবে। রুমে যাও, ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

জান্নাত তার রুমে চলে যায়। রাত তখন ৩টা বেজে ১৩ মিনিট। রুমের মধ্যে মারধরের আওয়াজটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। জান্নাতের ঘুম ভেঙে যায় সেই আওয়াজে। সে লক্ষ্য করে দেখে বিছানাটা ভিজে আছে। বিছানা থেকে এক পা দু পা করে সে সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে রুমের লাইটটা জ্বালাতেই দেখে রুমের মধ্যে রক্তের দাগ। যেন কাউকে মেরে টেনে হিঁচড়ে বেলকনির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিছানার কাছে যেতেই সে চমকে ওঠে। পুরো বিছানা জুড়ে রক্ত। সে চিৎকার দিয়ে ওঠে। পাশের রুম থেকে নিঝুম আর আকাশ ছুটে এসে তার রুমে নক করতে থাকে।

– কী হয়েছে জান্নাত? কী হয়েছে তোমার? জান্নাত দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
– কী হয়েছে তোমার? চিৎকার দিয়ে উঠলে যে? সে চোখ বন্ধ করে হাত দিয়ে মেঝে আর বিছানার দিকে ইশারা করে বলে, “রক্ত, রক্ত।”
– কোথায় রক্ত? কিসের রক্ত?
– ওখানে রক্ত।
– কোনখানে রক্ত?

জান্নাত এবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে কোথাও কোনো রক্ত নেই। পরিস্কার পরিপাটি চারিদিকে। সকাল হলে নিঝুম পুলিশকে খবর দেয়, সাথে বাড়িওয়ালাকেও। পুলিশ এসে জান্নাতের রুমের তল্লাসি নেয়। জান্নাত পুলিশকে বেলকনির দিকে খুঁজতে বলে। সে তাদেরকে জানায় বেলকনির দিক থেকে প্রতি রাতেই মারধরের আওয়াজ ভেসে আসে। পরে পুলিশ বেলকনির পাশে যে দেয়াল ছিলো সেটা ভেঙে ফেলে, দেখে সেখানে একটা সুরঙ্গ করা আছে। সুরঙ্গটা বেশি বড় নয়। তবে পুরো সুরঙ্গ জুড়ে কঙ্কালের সমাহার। পুলিশ বাড়িওয়ালাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, “এসব কী মিস্টার থমাস?”

থমাস তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের মধ্যে থাকা কঙ্কালের পুরো রহস্য বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন, আজ থেকে বছর ত্রিশেক আগে এখানে একটা লোক উঠেছিলো। লোকটি দেখতে উঁচু লম্বা, সুঠাম দেহের অধিকারী। উঠার সময় সে একটা স্ত্রী লোককে নিয়েই ওঠে। কিছুদিন যেতেই আমি লক্ষ্য করলাম, লোকটা প্রতিদিন একটা করে মেয়ে নিয়ে আসে। তবে পরদিন আর কোনো মেয়েকে এ বাসা থেকে বের হতে দেখা যায়নি। এভাবে চলতে থাকে কয়েক মাস। একদিন লোকটি তার কূকর্মের জন্য পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পরে জানা যায়, লোকটি মেয়েগুলোকে ভোগ করে মেরে ফেলতো। লোকটি ছিলো মেন্টাল রোগী। অবশ্য পুলিশে ধরা পড়ার পরদিনই তার মৃত্যু হয়। জেলের মধ্যে সে আত্মহত্যা করে, বলে জানা যায়। আর রুমের এই কঙ্কালগুলো হয়তো ঐসব মেয়েদের, যাদের সে প্রতিদিন এখানে নিয়ে আসতো। পুলিশ কঙ্কালগুলো নিয়ে চলে যায়। বাড়িওয়ালাও খানিক বাদে প্রস্থান করেন। সবাই চলে গেলে জান্নাত নিঝুমকে বলে, “আপু আমি আর এখানে থাকবো না।”

– কেন? এখন তো আর কোনো প্রবলেম নেই। তবে থাকবে না কেন?
– না আপু, এখানে আর ইচ্ছে করলেও থাকা সম্ভব না। আর তাছাড়া হোস্টেলের ঐ বড় আপু আমাকে গতকাল সন্ধ্যায় জানিয়েছেন, তাদের ওখানে নাকি একটা সিট খালি হয়েছে।
– ও। আচ্ছা তবে দেখে শুনে যেও, নিজের প্রতি খেয়াল রেখো। আর মাঝে মাঝে ঘুরতে এসো এখানে।
– আচ্ছা আপু।

সেদিন বিকেলে জান্নাত তার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে ইউনিভার্সিটির হোস্টেলের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়। বাসার রোডটা পেরিয়ে যখনই সে মেইন রোডে পা রাখে। তখন একটা পরিচিত কণ্ঠের ডাকে সে পেছন ফিরে তাকায়। দেখে নিরব দাঁড়িয়ে আছে। কুশল বিনিময় শেষে নিরব বলে, কোথায় যাচ্ছেন?

– হোস্টেলে একটা সিট খালি হয়েছে। সেখানেই যাচ্ছি।
– ও আচ্ছা।
– আপনি কোথায় চলেছেন?
– এইতো একটু ঘুরে দেখি চারপাশটা।

নিরবের সাথে আরও কিছু কথা বলে জান্নাত তার গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিছুদূর যেতেই সেই “হাত নাড়িয়ে” কথা বলা লোকটি তার সামনে এসে বলে, ধন্যবাদ তোমাকে। শুভ হোক তোমার “আগামীর পথচলা।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত