মা

মা

সাবরিনা’র আজ বিয়ে। 

যতোটুকু সম্ভব খুব ধুমধামের সাথেই বিয়ে হচ্ছে।

বর, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ননদ সবাই ভীষণ পছন্দ করেই বউ করে নিয়ে যাচ্ছে সাবরিনাকে।

বাইশ বছর বয়সী সাবরিনা দেখতে পছন্দ করার মতোই। চেহারা মায়ায় ভরা, গায়ের রঙ উজ্জ্বল, লম্বাও ঠিক আছে। তাছাড়া ভীষণ সুন্দর ব্যবহার তার, খুব মিশুক স্বভাব। দুইমিনিটে যে কাউকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা রাখে সে।

বিয়ে হলো সাবরিনা’র। খুব সুখি একটি পরিবার পেলো সে।

শ্বাশুড়ি, ননদ সবাই নতুন এই মানুষটাকে আগলিয়ে রাখে ভালোবেসে। সব সময় সব ব্যাপারে শতভাগ সহযোগিতা করেন।

কিন্তু পাঁচমাস, ছয়মাস, বছর পেরিয়ে যায়,তাদের ঘরে নতুন মেহমান আসার কোনো লক্ষণই নেই।

মনে মনে চিন্তিত হয়ে পড়েন সকলে। সাবরিনাও। বর শাহেদ তাকে সান্ত্বনা দেন,

-এক বছর একটা সময় হলো? মানুষ ইচ্ছে করেও তো দুই চার বছর বাচ্চা নেয় না।

-তবুও আমার ভয় করছে।

-ভয় কিসের?

-যদি আমার কোনোদিন বাচ্চা না হয়!

-না হলে না হবে, সবার ভাগ্যে সবকিছু থাকেনা। আর তুমি ভয় পাচ্ছো কেনো?

সমস্যা আমারও থাকতে পারে।

-চলো আমরা ডাক্তার দেখায়।

-হুম, দেখাবো।

ডাক্তার এতোগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা দেন দুইজনকেই। কোনো সমস্যা নেই কারো।

নিশ্চিত হয় তারা।

এরপরও তিনি কিছু ওষুধপত্র দেন, নিয়মিত খেতে বলেন।

এখন শুধু সময়ের, আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা রাখা ছাড়া কিছুই করার নেই কারো।

বছরের পর বছর যায়, পাঁচ, ছয়, সাত করে সতেরো বছর!!

শাহেদ জানে, কারো সমস্যা নেই, ঘরের সবাইও জানে। এরপরও সবার মুখ অন্ধকার। কেউ কাউকে কিছু বলেনা। তবুও চুপচাপই যেন অনেক কিছু বলা হয়ে যায়, হাহাকার এর শব্দ শুনা যায় চারদিকে।

এদিকে ননদেরও বিয়ে হয়ে যায় অনেক আগে।

শ্বাশুড়ি অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।শেষসময়ে তার দুইচোখে কতো আকুতি ছিলো একটা নাত নাতনীর জন্য!

পুরো ঘর খালি। শ্বশুর একা একা, বিরক্তিকর সময় কাটান। মাঝেমধ্যে তার কাশির শব্দটাই শুধু ঘরকে শব্দময় করে তুলে। এই শব্দও ভালো লাগে সবার, প্রাণ আছে মনে হয় ।

সাবরিনা শাহেদ এর জীবনও যেন রসকষ হীন একগুঁয়ে পানসে হয়ে পড়েছে। 

কেউ কাউকে দোষ দেয়না। ভালোবাসা শতভাগ আছে এখনো, তবুও যেন কিছু নেই, কিছু নেই মনে হয়।

কিন্তু আশেপাশে প্রতিবেশিরা আত্মীয়পরিজন সবাই সাবরিনা’র দোষ খুঁজে বেড়ায়।

“মেয়ে বন্ধ্যা বাজা…!”

“তোর বাচ্চা হচ্ছেনা তো কি, ঐ বেচারাদের কেনো বাবা দাদা ডাক শুনতে দিচ্ছিসনা?
এতো স্বার্থপরতা!”

“ছিঃ আমার বর হলে কবেই বিয়ে করিয়ে দিতাম!”

কতোকিছুই যে বলেন তারা!

বাচ্চা না হবার চার পাঁচ বছরের মাথায়  সাবরিনা অবশ্য শাহেদ আর তার  শ্বাশুড়িকে বলেছিলো,

-মা, আপনার ছেলেকে না হয় আরেকটা বিয়ে করান। আমার হয়তো আর বাচ্চা হবেনা।

-এসব কি বলছো বউমা! বাচ্চাকাচ্চা সব আল্লাহ’র হাতে। তিনি চাইলে দিবেন, না দিলে নাই। আমি জেনেশুনে তোমাকে কিভাবে সতীন এনে দিই!
শাশুড়ি বলেন।

-শোন, সাবরিনা, এসব ফালতু কথা কখনো বললে আমি কিন্তু ঘরদোর ছেড়ে চলে যাবো। লাগবেনা আমাদের বাচ্চাকাচ্চা ।

শাহেদ এই জবাব দিয়ে রাগ করে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে। পুকুরঘাটে বসে থাকে একা।

সাবরিনা ওখানে যায়। তার কাঁধে হাত রাখে।

-স্যরি শাহেদ। একটা বাচ্চার জন্য আমার মনটাও কেমন করে। মা ডাক শুনার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়ে আছে। তোমারও নিশ্চয় বাবা ডাক শুনতে ইচ্ছে করে। মা বাবারও নিশ্চয় দাদা দাদি হতে মন চায়। একটা দুইটা বাচ্চা সারা ঘরময় হৈহৈ করে ছুটে বেড়াবে, খেলবে, কাঁদবে হাসবে কতো সুখ না?

-হুম, আমারও এমন ভাবতে কল্পনা করতে ইচ্ছে করে। তাই বলে বিয়ে!

তুমি তো বন্ধ্যা নও। আমি আরেকটা বিয়ে করলে বাচ্চা হবে তার কি গ্যারান্টি?

-তাহলে আমরা একটা বাচ্চা দত্তক নিই না কেনো?

-না, আমি তোমার থেকেই বেবি চাই, তাও প্রাকৃতিকভাবে। আর সবার মতো। প্রয়োজনে বারবার ডাঃ দেখাবো।

-তাহলে স্বপ্ন দেখতে থাকো। আমার মনে হয়, এই জীবনে আমার আর বাচ্চা হবেনা।

-হুম, তোমাকে বলেছে। মাত্র বিয়ের পাঁঁচবছর হলো। আরো হাজার বছর বাকি। তোমার বয়সী মেয়েদের আজও বিয়েই হয়নি, আর তুমি পাগলি সতীন এনে আমাকে পর করতে চাও…

-আচ্ছা হয়েছে, প্রেম সব তো পুকুর পাড়েই করবে দেখছি। অনেক রাত হচ্ছে, চলো বাসায়। মা কি ভাবছেন, আল্লাহ জানে!

প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব যখন যে যেটা করতে বলেছেন, যেতে বলেছেন, তাবিজ, কবজ, সাধু, পীর সব করেছে সাবরিনা। শাহেদ বারবার বিরক্ত হয়েছে এসবে। কিন্তু সাবরিনা ধৈর্যহারা হতোনা। বলতো,

-ওরা কেউ আমাদের দুষমন নয়, ভালোই চায়। আর কখন কার দোয়া লেগে যায়, বলা যায়!

এই বলে সে সবার সাথেসাথে নিজেকেও যেন সান্ত্বনা দিতো।

এখন, সাবরিনা আর বাইশ বছর বয়সী মেয়ে নেই। উনচল্লিশ বছরের মহিলা হয়ে গেছে। তার মায়ের মতো তার শরীরেও ডায়াবেটিস রোগ বাসা বেধেছে, সাথে উচ্চ রক্তচাপ! অনেকটা অল্প বয়সেই বুড়ি বুড়ি ভাব।

হঠাৎ একদিন মাথা ঘুরে চোখে অন্ধকার দেখে সে। ডায়াবেটিস নীল হয়েছে ভেবে শাহেদ তাড়াতাড়ি ডাঃ এর কাছে নিয়ে যান। ডাঃ পরীক্ষা করে বলেন,

-সুখবর!

-মানে?

-আপনার স্ত্রী মা হতে চলেছেন।

-কি বলেন!

শাহেদ সাবরিনা খুশি হবার কথায় যেন ভুলে যায়, আকষ্মিক এই খবরে।

-কিন্তু…
ডাঃ বলেন।

-কি?

-উনার ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, সমস্যা হতে পারে, আর যথেষ্ট বয়সও হয়েছে। খুব সাবধানে থাকতে হবে।

-হ্যাঁ, আমি তার দেখাশোনা ভালোভাবে করবো, প্রয়োজনে কাজকর্ম বাদ দেবো।

খুব খুশি শাহেদ, যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। চাঁদই তো, এতো বছর অপেক্ষার ফল!

শাহেদ একটু সরলেই, সাবরিনা ডাঃ এর সাথে কথা বলে।

-ডাঃ প্লিজ ওকে কোনো ভয় দেখাবেন না আর। এই বাচ্চা আমার চাইই। সতেরো বছর পর আমি প্রথমবার মা হতে চলেছি। যেকোনো মূল্যে আমি তাকে চাই।

-আপনার বিপদ হতে পারে বোন।

-হলে হোক। প্লিজ আপনি চিকিৎসা শুরু করুন।

সাবরিনা তার গর্ভকালীন প্রতিটি সময় উপভোগ করছে।  শ্বশুর সাহেবও যেন জোয়ান হয়ে গেছেন হঠৎ করে। খুশির ছুটে কাশি কমে গেছে,সেখানে রাত দিন হাসি।

কিছুক্ষণ পর পর জানতে চান,

-বউমা, কি খাবে বলো, বাজারে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি বলো, সব শেষ হয়ে যাবে।

শাহেদ তাকে বিছানা থেকেও নামতে দেয়না।

-বাথরুমে যাবে? হাত ধরো দেখি, এবার আস্তে আস্তে নামো।

-এখনো আমি পারছিতো, মাত্র তিনমাস চলছে !

-বেশি বাড়াবাড়ি করবেনা।

-ডায়াবেটিস বেড়ে যাবে তো শুয়ে বসে বসে।

-বাড়বেনা, আমি পাশে আছি। প্রয়োজনে তিতা কড়লার জুস খাইয়ে দিবো।

-কি! ইয়াক…

-তা বউসোনা এখন কি খাবে? খিদে লেগেছে?

-হুম,মুহূর্তেমুহূর্তে এতো খিদে লাগে এখন, তোমাকে বলতেও লজ্জা করে।

-লজ্জার কিছু নেই, তোমার দুইজনের খাবার খেতে হবে।

-হুম.. আর আমি বারবার বাথরুম গিয়ে মরি, কি অসুখ যে আল্লাহ দিলেন!

আজকাল সাবরিনা যা পায়, তাই তার অমৃত মনে হয় খিদে পেটে। সারাক্ষণ খিদে আর সারাক্ষণ এটা ওটা গোগ্রাসে খেতে এতো ভালো লাগছে তার।

শাহেদ বসে বসে মুগ্ধ হয়ে তার খাবার খাওয়া দেখে। সতেরো বছরে এভাবে সামান্য খাবার এতো মজা করে, তৃপ্তি নিয়ে খেতে দেখেনি তাকে।

দুইজন চোখাচোখি হলে সাবরিনা লজ্জা পেয়ে যায়, ধীরেধীরে খায় তখন ।

প্রতিটি মুহূর্ত তারা দুইজনই উপভোগ করতে চায়, কিন্তু সময় খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে মনে হয়, দুইজনেরই। শাহেদও বাচ্চা হয়ে যায় যেন। প্রথম বাচ্চা হবে বলে কথা। সাবরিনা’র পেটে কান রেখে বেবি’র সাথে কথা বলে সে। 

খুশিতে সাবরিনার চোখ জলে ভরে যায়। এতো সুখ তার কপালে লেখা ছিলো! সতেরো বছরের অপ্রাপ্তি সব ভুলে যায় তারা।

বাচ্চার নাম নিয়েও ঝগড়া করে নতুন দম্পতির মতো।

-দেখো, আমাদের ছেলে হবে। 

-না, মেয়ে হবে, দেখো তুমি। বলে শাহেদ।

-আমার মাথায় সব ছেলের নাম ঘুরছে।

-আমার মাথায় সব মেয়ের নাম ঘুরছে।

-আচ্ছা যাই হয় হোক, সুস্থ হলেই হবে।

-হুম, এটাই। ছেলে মেয়ে একটা হলেই হবে, তবে সে যেন সুস্থ হয়, ভালো ভাবে পৃথিবীতে আসে।

-ইনশাআল্লাহ ভালোভাবেই আসবে।

-ইনশাআল্লাহ! 

সময় শেষ হয়ে আসে। নয়মাসে পড়ে। সাবরিনা হাঁটাচলাও করতে পারছেনা একেবারে। 

পায়ে পানি এসে একেবারে ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। প্রেশারও বাড়তি সবসময়। একসপ্তাহ আগেই ডাঃ তাকে ভর্তি হয়ে যেতে বলেছেন। তার অবস্থা খুব শোচনীয়।

নির্দিষ্ট সময়ে তার ব্যথা উঠে কিন্তু কিছুতেই বাচ্চা আসেনা। সাবরিনার উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়। সে যতোটুকু দরকার শক্তি ব্যয় করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। জড়ায়ুর মুখও খুলেনা।

ডাঃ রা পানি ভেঙে অপেক্ষা করেন, তবুও যেন বাচ্চা আসবেনা বলে পণ করেছে।

পেটে বাচ্চা দূর্বল হয়ে পড়ছে আর সাথে সাবরিনাও।

এখন সিজার করা ছাড়া আর কোনো গতি নেই, নইলে বাচ্চার জন্য ক্ষতি হতে পারে। আর সিজার করলে সাবরিনার। না করলে দুইজনেরই। কি করবে, কেমন করবে সব ভেবে টেবে সিদ্ধান্ত হয় সিজার করতেই হবে।

শাহেদ আর তার বাপ জায়নামাজ নিয়ে কেবিনেই বসে পড়েছেন।। আল্লাহ’র কাছে কেঁদে কেঁদে দোয়া করে।

“বাচ্চা না বাঁচলে নাই, ভেবে নেবো রিজিকে ছিলোনা। হে আল্লাহ, সাবরিনাকে বাঁচিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও মৃত্যুর পথ থেকে…”

ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তান আসে। ওয়া ওয়া করে কেঁদে কেঁদে সে তার আগমনী সুর শুনিয়ে দেয় । 

তখনো সাবরিনা’র হুশ ছিলো। বাচ্চার মুখ দেখে ঠোঁটে একচিলতে হাসিও ফুটেছিলো।ঐ হাসি নিয়েই সে পৃথিবীকে বিদায় জানায়। হাসিটার অর্থ হয়তো,

“এই দেখো পৃথিবীবাসি, আমি পেরেছি। আমি সত্যিই মা হয়ে দেখিয়েছি, আমি বন্ধ্যা ছিলামনা….”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত