বেঁধেছি আমার প্রাণ

বেঁধেছি আমার প্রাণ

মুহিন খুব ধীরে দরজা খুলতে যাবে এমন সময় রুম থেকে দুপ-দাপ শব্দ কানে এলো। দুপ-দাপ শব্দের কারণ তার স্ত্রী নিনু। নিনু কখনও আস্তে-ধীরে হাঁটতে পারে না। সে সাধারণভাবে হাঁটলেও মনে হয় ফ্লোর কাঁপছে। এসব কথা তাকে বলা যায় না। সেদিনও সে খাট থেকে বাচ্চাদের মত লাফ দিয়ে নেমেছে। অথচ লাফঝাঁপের কোন প্রয়োজন ছিল না। শারীরিক গঠনগত দিক থেকে সে যথেষ্ট উন্নতি করেছে, কিন্তু মানসিক উন্নতি এখনও কিশোরী পর্যায়ে রয়েছে। এত জোরে পা ফেলে শরীর দুলিয়ে হাঁটাহাঁটি ওর মত সন্তানসম্ভবা নারীর জন্য ঠিক না, এই সাধারণ নির্দেশনাও তার মনে থাকে না।

মুহিন দরজা খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। নিনু হাই তুলতে তুলতে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
“কী ব্যাপার, তুমি দেখি চোরের মত অফিসে যাচ্ছ! আমাকে ডাকোনি কেন?”

আজ ভোর হতেই মুহিন প্রায় নিঃশব্দে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল। সম্ভব হলে এক্সিসরিজ মার্কেট’টা একবার ঘুরে যেতে হবে। ভোর হতেই সাপ্লায়ার রেজাউল মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েছে। অতীব জরুরী মেসেজ। মুহিন এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে অপ্রস্তুত স্বরে উত্তর দিলো।

“আজ একটু তাড়া আছে। তুমি ঘুমাও, তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন।”
“আমার সাথে ফাজলামো করবা না। বউয়ের উপর এত আলগা দরদ দেখাতে হবে না। সাতসকালে খালি মুখে বের হতে তোমাকে কে বলেছে, হু? চেয়ারে বসো, একটা ডিম পোচ হতে এক যুগ সময় লাগে না। খেয়ে তারপর পা’ নাড়াবা!”
নিনু আবার আগের মত মেঝে কাঁপিয়ে রান্না ঘরের দিকে পা’ বাড়াল।

মুহিনের সংসার-ধর্ম শুরু থেকেই বেশ আজব টাইপের ভালোলাগার মধ্য দিয়ে কাটছে। বিয়ের আগে মুহিন লোক-মুখে শুনত, বিয়ের কনে না কি হাত দেড়েক ঘোমটা টেনে দিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। লজ্জা-রাঙা মুখে শুধু হু-হা গোছের উত্তর দেয়। অথচ নিনু এসবের ধারে কাছেও যায়নি। সে ঘোমটা ফেলে হাসি মুখে বসে ছিল। ছোটোখাটো কথোপকথনের এক পর্যায়ে নিনু জানতে চাইলো,

“এই যে স্বামীদেব! আমি ইনিয়ে বিনিয়ে আপনি-আপনি করে ডাকতে পারবো না। তুমি করে ডাকবো, কোন সমস্যা আছে?”
“না, কোন সমস্যা নেই।”

“গুড। আপাতত আমার হক বুঝিয়ে দেও। পঞ্চাশ হাজার এক টাকা আমার হাতে রাখো। বাকি কথা পরে হবে।”

মুহিন কিছুটা চমকে উঠে হেসে ফেললো। সে অবশ্য মনে মনে স্ত্রীর উপর বেশ কৃতজ্ঞ। নিনু আগেই জানতো মুহিন পাত্র হিসেবে দরিদ্র শ্রেণীর। বর্তমান বিয়ের বাজারে দেনমোহরানা মানে হচ্ছে পাঁচ-দশলাখের ঘরে বসে টানাটানি করা। নিনুর ইচ্ছে অনুযায়ী তার পরিবার ওসব টানাটানির মধ্যে যায়নি। আড়ম্বরহীন ঘরোয়া বিয়ে। নিনুর পরিবার বলতে তার মা, ছোট ভাই আর দূর সম্পর্কের এক মামা ছিলেন বিয়ের সময়। বাবা খাদ্য বিভাগের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। কী এক ঝামেলায় বছর দশেকের জেল হয়েছে তাঁর। নিনু গোড়া থেকেই তার বাবার ব্যাপারে কোনরূপ উৎসাহ দেখায়নি। মুহিনও কখনও তার স্ত্রীকে বিব্রত করেনি। দেনমোহর শেষ পর্যন্ত সামান্য কিছু গয়না উসুল সহ নগদ পঞ্চাশ হাজার এক টাকায় রফা হয়েছে। মুহিন এতেই খুশি। তার নিজের ক্ষমতা এর চেয়ে মোটেই বেশি নয়। সে যা হোক, তাই বলে বাসর ঘরের নববধূ এই সুরে কথা বলে? কপালে আর কী অপেক্ষা করছে কে জানে! মুহিন কৌতুকভঙ্গীতে বলতে চাইলো,

“টাকা আমার কাছেই আছে – উড়ে যাওয়ার তো আর পথ নেই। হাহা… সকাল হলেই তোমার হাতে দিবো।”
“উঁহু, ওসব ভুং-ভাং আমার সাথে চলবে না। ফেলো কড়ি, মাখ তেল!”

মুহিনের আর কিছুই করার ছিল না। কড়ি ফেলেই তেল মাখতে হয়েছে। এবং সেই প্রথম রাত থেকেই সে আবিষ্কার করেছে, এই অতি চঞ্চল শ্যামা মেয়েটি গতানুগতিক ধারার কোন মেয়ে নয়। কেমন একটু ক্ষ্যাপাটে গোছের, যে মেয়েটি প্রতিনিয়ত সৎসাহসিকতার একটা স্পষ্ট অটল পর্বত হিমালয়ের মত বুকের গভীরে ধারণ করে!

মুহিনের সামনে দুই স্লাইস পারুটি, সাথে একটা অর্ধ সিদ্ধ ডিম রাখা। ঝড়ের বেগে কাজ গুছিয়ে নেয়ার ক্ষমতা আছে নিনুর। মেয়েটি সারারাত এক ফোটা ঘুমাতে পারেনি। শেষ রাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। বেশ ঠান্ডা-ঠান্ডা ভাব ছিল। মুহিন ইচ্ছে করেই সদ্য ঘুমন্ত স্ত্রীকে ডেকে তুলতে চায়নি। ভোর হতেই এঁটো রান্নাঘর পরিষ্কার করে নাস্তা বানিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা নানান ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার। সকালের নাস্তা তো ফুটপাথে দাঁড়িয়ে সারা যায়। এসব সোজা হিসেব এ মেয়েটি বুঝতে চায় না। আপাতত কিছুটা বিশ্রাম নিনুর জন্য খুবই দরকার। এত তাড়াতাড়ি সন্তান নেয়ার ইচ্ছে তাদের ছিল না। হঠাৎ দুর্ঘটনা হয়ে গেলো। শেষে নিনুর চাপাচাপিতে মেনে নিতে হলো। পৃথিবীতে কেউ যদি এক পা দিয়েই ফেলে, তাকে রুখে দেয়ার ক্ষমতা কারও থাকা উচিৎ না।

ডিমের কুসুমের একটা অংশ মুহিনের ঠোঁটের কোনা ঘেঁষে লেগে ছিল, নিনু আঁচলের প্রান্তদেশ দিয়ে মুছে দিয়ে বলল,
“তোমার কাছে কি খুব বড় কিছু চেয়েছি কখনও?”
“না।”
“তাহলে যে কাজটি আমি গত এগারো মাস যাবত করে আসছি তা আজ আমাকে করতে দাওনি কেন?”
মুহিন দ্রুত পানি খেয়ে নিয়ে জানতে চাইলো,
“আমি আবার কী করলাম?”
“কী করলাম মানে কী? তুমি বাবু না যে, আমি তোমার প্যান্ট-শার্ট পরিয়ে দেবো। কিন্তু
আমার সাহায্য ছাড়া একদিন ভালোমতো শার্টটাও তো ইন করা হয় না তোমার, ভুলে গেছো?”
“নিনু প্লিজ, দেরী হয়ে যাচ্ছে আমার!”
“কথা কম। উঠে দাঁড়াও। শার্ট ইন করেছো, দেখাচ্ছে ভলভো-বাসের কন্ডাক্টরের মত!”

মুহিন রোবটের মত উঠে দাঁড়িয়ে আছে। বছর গড়াতে চলল নিনুর সাথে তার সংসার। কত ঘনিষ্ঠ হয়ে মিশেছে একে অপরের সাথে। তবু অদ্ভুত কারণে নিনুর এই কাজটি মুহিনের কাছে বেশ অস্বস্তিকর আর খুঁতখুঁতে মনে হয়। প্যান্টের উপরিভাগ খুলে ফেলে তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেয় সে। তারপর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকে সেই হাত। শার্ট গুঁজে দেয়া শেষ হলে নিনু দূর থেকে নিরিখ করে দেখে – ইন ঠিক হয়েছে কি-না। এটা নিনুর বহুদিনের পুরনো অভ্যাস। তার আরও একটা অভ্যাস আছে। অভ্যাসটা স্বাভাবিক হলেও হঠাৎ-হঠাৎ ভয়ঙ্কর দ্বিধায় ফেলে দেয় মুহিনকে। নিনু জায়গা-অজায়গায় হুঠহাট আবদার করে বসে,
“আমাকে একটু কোলে নেও তো। উঁহু, ঠিক কোলে না, পাঁজাকোলা করে উঠাতে বলছি। হা’ করে তাকিয়ে থেকো না। কুইক, কুইক, গেট মি আপ!”

মুহিন এদিক-সেদিক অসহায় দৃষ্টি বুলিয়ে স্ত্রীকে কপট রেগে মৃদু ধমকে দেয়। সহসা নিনুর দুষ্টুমি মাখা মুখে টোল পড়া হাসি আরও বিস্তৃত হয়ে পড়ে। নিনু মাঝেমধ্যে ভরা মজলিশে এই হাস্যকর আবদার অনায়াসে করে বসে, কখনও কখনও ব্যস্ত সড়ক পার হতে গিয়েও তার এই কাজ করার রেকর্ড আছে। বেশীরভাগ সময়ই বোঝার কোন উপায় থাকে না, এটা তার উচ্চমার্গের আদুরে টাইপের মজা করার ছল মাত্র। কবে যে ও একটু শুধরাবে!

মুহিনের বিশ্বাস, স্ত্রী বা প্রেমিকা গোষ্ঠীর এসব আহ্বান প্রত্যেক পুরুষ বেশ আগ্রহ নিয়েই করে থাকে। সেও করে, তবে ইদানীং নিনুর এই ছেলেমানুষি শখ আর পূরণ করা যাচ্ছে না। গত ছয় মাসে সে অস্বাভাবিক মুটিয়ে গেছে। পাঁচ ফিট চার ইঞ্চি উচ্চতার একজন নারীর ওজন সত্তর কেজি কম কথা না। তাছাড়া সে এখন একা নয়, তাকে ঘিরে আরও একজন সন্তর্পণে বেড়ে উঠছে। এসব পরিবর্তন নিনুর চোখে পড়ে না।

এই আকস্মিক ওজন বৃদ্ধি নিয়েও কম ঝামেলা হয়নি। ভণিতা করে কথা বলার অভ্যাস মুহিনের কোনকালেই ছিল না। স্ত্রীকে খুশি করার জন্য সে মাঝেমাঝে সচেতনভাবেই কিছু ঢং করার চেষ্টা করে। অধিকাংশ সময় সেই ঢং সফল হয় না। উলটো কৈফিয়ত দিতে দিতে প্রাণ যায় অবস্থা। গত সপ্তাহে একবার এমন হলো। মুহিন অফিস ডেস্কে বসে গভীর মনোযোগ নিয়ে একটা হিসেব কষছে। ইতিমধ্যে নিনু ফোন দিয়ে আদুরে গলায় কথা বলা শুরু করেছে,

“আচ্ছা, তুমি আমাকে আগের মত আর আদর করো না কেন?”
মুহিন চরম অস্বস্তি নিয়ে ফাঁকা কনফারেন্স রুমে গিয়ে নিচু গলায় অনুরোধ করেছিলো,
“নিনু, এখন অফিসে রাশ-আওয়ার চলছে। পরে কথা বলি, লক্ষ্মী সোনা?”
“আচ্ছা তাহলে একবার আদর করে ডাকো। হিহি”
মুহিন গলা আরও নীচে নামিয়ে বলল,
“তুমি আমার কুটু, আমার পুটু, আমার মুটু, আমার………”
মুহিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই নিনুর চিৎকার শোনা গেলো।
“ইউ ডাম্ব, আমাকে কি চালের বস্তা মনে হয়, হু? আমাকে তুমি এখনই মুটু বলা শুরু করেছো, আরও তো জীবন পড়ে আছে! তুমি আমার সাথে আর কথা বলবা না।”

কথাবার্তার এ পর্যায়ে দুম করে কল কেটে দেয়া হলো। ঝড় শুরু হলো রাতে। সারারাত নিনু মুহিনের সাথে আর কথা বলেনি। স্ত্রীর মুখ থেকে কথা বের করার একটা উপায় বের করেছিল মুহিন। সহজ উপায়। কোন এক ফাঁকে সুযোগ বুঝে শুধু রান্না ঘরে গিয়ে লবণ রাখা বয়ামের মুখ আচ্ছামত টাইট করে আঁটকে রাখা। কোথায় যাবে ঘুঘু! আঁটকে রাখা মুখ খুলতে হলে তোমার মুখও খুলতে হবে। হাহা… মুহিন ভোর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আর নিজ মনে হাসে। কিন্তু এখানেও বিধিবাম। সকাল বেলা দেখা যায় নিনু দিব্যি মুখ ভার করে নাস্তা বানাচ্ছে। কথা বলছে না। মুহিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন তার স্ত্রী তাকে ডেকে বলবে,
“ওগো, লবণ রাখা বয়ামের মুখটা এত টাইট হয়ে আঁটকে আছে, খুলতে পারছি না। খুলে দেও না প্লিজ!”

মুহিন বিরাট ভাব নিয়ে বসে থাকবে। তারচেয়ে বেশি ভাব নিয়ে গম্ভীর হয়ে নিনুকে আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার করবে।
কিন্তু ঘটনা তা ঘটে না। কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, মুহিন চা’এর কাপ সামনে নিয়ে চিনি রাখা বয়ামের মুখ খুলতে ব্যস্ত। রাতের অন্ধকারে সে ভুল করে লবণের পরিবর্তে চিনির বয়ামে এই কাজ করেছিলো। নিনু শুধু লিকার খায়। সুতরাং চিনি ঘটিত সমস্যা তার নেই। বয়াম নিয়ে স্বামীর ধ্বস্তাধস্তি দেখে নিনু রান্ন ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে আর মুখ টিপে হাসে। একসময় এগিয়ে এসে বলে,
“বুঝেছি তোমার অনেক বুদ্ধি। তুমি অফিসের জন্য তৈরি হও, আমি দেখছি কী করা যায়। আর হ্যাঁ, আমাকে কিছু বুদ্ধি ধার দিও তো। হিহিহি”

ব্যস, কথোপকথন শুরু হয়ে যায় আবার। মুহিন এসব ভেবে মাঝেমধ্যে নিজে নিজেই হেসে ফেলে। সব কিছু মিলিয়ে এই টুনা-টুনির সংসার তার কাছে স্বর্গের এক টুকরো ক্ষুদ্র সংস্করণের মতই মনে হয়!

মুহিন রাস্তায় নামতেই বাসা থেকে একটা মেসেজ পেয়েছে। তাতে লেখা “আজ একটু কেমন কেমন লাগছে। তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো কিন্তু!”

এই কেমন-কেমনের অর্থ মুহিনের না বোঝার কথা নয়। এমন স্পর্শকাতর সময়ে নিনুর পাশে একজন সার্বক্ষণিক মানুষের সঙ্গ প্রয়োজন। গত দু’মাসে তার মা আর শাশুড়ি রুটিন করে কিছুদিন থেকে গেছেন, কিন্তু কেউ-ই বেশীদিন স্থায়ী হতে পারেননি। ছয়তলার চিলেকোটার বাসায় তাঁদের না কি দম বন্ধ হয়ে আসে। চলে যাওয়ার দিন তার শাশুড়ি কী যেন একটা বিড়বিড় করে বললেন। মুহিন নিনুর কাছে এগিয়ে হেসে জানতে চাইলো,
“নিনু, আম্মাজান মনে হয় কিছু একটা বলেছেন। আমি বুঝতে পারিনি। মাথার উপর দিয়ে গেছে!”
নিনু আরও কাছে এসে কৌতুক মিশিয়ে বলল,
“ওরে আমার চিলেকোটার মানব! এত উঁচুতে থেকেও কথা মাথার উপর দিয়ে যায় কিভাবে, হুম? মা বলছেন, বাসা পালটে নিচ তলায় নিতে। আমার এ অবস্থায় সিঁড়ি ভাঙা ঠিক না।”

মুহিন মাথা দোলায়। কী করবে ভেবে পায় না। কিছু একটা করা উচিৎ। চাইলেই তো হয় না। নিচ তলায় ভাড়া বেশি। এই বাস্তবতা তার স্ত্রীও বেশ বোঝে। এ কারণেই হয়ত সে তার মা’কে থাকার জন্য খুব একটা জোর জবরদস্তী করে না কখনও।
মুহিন আনমনে মাথা চুলকাতে চুলকাতে রাস্তা বেয়ে হাঁটে। অফিসের হাতে গোনা টাকায় সংসার চালাতে হয়। নাগরিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশের অপর নাম একটা রেফ্রিজারেটর। অথচ এই সামান্য জিনিষটাই এখন পর্যন্ত কেনা হয়নি।

এই সেদিনকার ঘটনা। মুহিন রাতে অফিস থেকে ফিরেছে। নিনু কোনোমতে দরজা খুলেই রান্না ঘরে গিয়ে গামলাভর্তি পানিতে আঙুল চুবিয়ে নিয়ে বসে ছিল। কারণ সে আঙুলে ব্যথা পেয়েছে। আঙুল ফুলে লাল হয়ে আছে। একপাশ থেঁতলে আছে। ড্রয়ার বন্ধ করতে গিয়ে এই দুর্ঘটনা। শেষে সামান্য এক টুকরো বরফ নিচের ফ্লাট থেকে চেয়ে আনতে হয়েছে মুহিনের। অথচ এই দিন তার দেখতে হত না। অফিসে উপরি আয়ের বেশ ভালো ব্যবস্থা আছে। প্রায় সবাই ঝোপ বুঝে কোপ মেরে যাচ্ছে। কেবল সে-ই এখানে নিরুপায়। নিনুর কড়াকড়ি নিষেধ আছে। বাবা থাকতেও এই একটি কারণে সে পিতৃস্নেহ থেকে বছরের পর বছর বঞ্চিত হয়েছে। এজন্য অবশ্য সে তার নিজের মাকেই বেশি দায়ী করে। তার মতে, প্রতিটি ঘরে যদি একজন সুসভ্য সদস্য থাকে তবে অবৈধ পয়সা ঠেকানোর জন্য সরকারের দুদক-এর প্রয়োজন হয় না। হয়ত হারাম উপার্জনের শুরুটা হয় ব্যক্তিগত লোভের মধ্য দিয়ে। একসময় তা আর ব্যক্তিগত থাকে না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সেই লোভ ডালপালা মেলে পারিবারিক নিষ্ক্রিয়তা এবং নির্লজ্জ নীরব সমর্থনে। নিনুর মত স্ত্রীর স্বামী হয়ে স্বপ্নেও উপরি আয়ের চিন্তা করা সম্ভব না। ভাবতে ভাবতে মুহিন হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। অফিসে আগেভাগে পৌঁছাতে হবে।

আজ অফিসে ঢোকার আগ মুহূর্ত থেকেই মুহিনের ভেতরে এক অভূতপূর্ব তোলপাড় শুরু হয়েছে। ছকে বাঁধা কাজগুলি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে নয়টায় অফিসে এসেছে। কিন্তু অফিসিয়াল টাইমার মেশিনে চেক-ইন পাঞ্চ করা হয়নি। ভুল ভেঙ্গেছে যখন, তখন ঘড়িতে বেলা প্রায় এগারোটা। আধ ঘণ্টা আগে এসেও উলটো দেড় ঘণ্টা লেট রেকর্ড! মুহিনের মেজাজটাই খিঁচরে আছে। একটু পরপর গলা-বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। গত দুঘণ্টায় সে টানা ছয় গ্লাস পানি খেয়েছে। পানি খেয়ে খুব একটা কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। আবারও গলা শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে যাচ্ছে। হাতের তালু ঘামছে। তার কি নার্ভাস ব্রেক-ডাউন হচ্ছে? না, উদ্বেগ প্রশ্রয় দেয়ার কোন মানেই হয় না। তাকে ঠিক থাকতে হবে। মিজান সাহেব কোথায় কে জানে। তার কাছ থেকে কিছু পরামর্শ নিতে হবে। মিজান সাহেবকে অবশ্য খুঁজতে যেতে হলো না, তিনি নিজেই চোখে-মুখে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে নিয়ে মুহিনের সামনে রাখা চেয়ারে বসলেন।
“খাম পাইছেন, মুহিন সাব?”
“জি।”
“শুনেন, ঘরের বউরে সব কিছু বলতে নাই। এরা মেয়েছেলে মানুষ। বুঝে বেশি। রেজাউল সাপ্লায়ার হিসাবে খারাপ না। আমার পুরাণ লোক। এই রাস্তায় আপনে নতুন মানুষ। জোয়ারের নায় পাল তুলতে হয়। বৈঠা বাইয়া আজাইরা শইলের শক্তি ক্ষয় করনের কোন মানে নাই। আপনে পাল উড়ায়া বইসা থাকেন। বাকিটা আমি দেখুম নে। গান শুনেন নাই, নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে। আব্বাস উদ্দিনের খুবই দামী গান। গীতিকারের নাম গিরীণ চক্রবর্তী। এই গান নিয়া আমার একটা হাসির স্মৃতি আছে। শুনেন, একদিন আমি……………………

মিজান সাহেব বক-বক করে যাচ্ছেন। এই সময়টা তার ব্যস্থ থাকার কথা। অথচ তার ব্যস্ততা নেই। তিনি গুনগুনিয়ে গানে টান দিচ্ছেন, আর এর-তার ডেস্কে উঁকিঝুঁকি মারছেন। মুহিনের ডান পকেটে একটি মুখবন্ধ খাম রাখা আছে। পেট-মোটা খাম। খামটি সাপ্লায়ার রেজাউলের কাছ থেকে সালামী হিসেবে পেয়েছে সে। কৌশলে রেজাউলকে কিছু পারচেজিং অর্ডার দেয়াই যায়। কোম্পানিতে এসব হরহামেশা ঘটছে। নিনুর পুঁথিগত সস্তা আবেগে আর কান দেয়া যাবে না। মাতৃত্বজনিত জটিলতা কম না। বাচ্চা প্রসবের আগে থেকেই এখনকার ডাক্তার’রা ছুরী-কাঁচি ধার দেয়া শুরু করে। অবস্থা যেমন হোক, সিজার ছাড়া গতি থাকে না। তারপর থেকে শুরু হয় টাকার নগ্ন খেলা। এ খেলাতে মুহিনের মত ছা’ পোষা ক্ষুদ্র চাকরিজীবী একসময় খেই হারিয়ে ফেলে। তাই আগেই প্রস্তুত থাকা দরকার।

মুহিন এক নিঃশ্বাসে এক লিটারের পানির বোতল অর্ধেকটা খালি করে ফেললো। নিনু কল দিয়েছে। শরীরটা আগের চেয়ে খারাপ করলো কি না কে জানে। মুহিন বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে ফোন কানে রাখল।
“হ্যালো নিনু, তুমি ভালো আছো তো?”
নিনু কুশল বিনিময়ের ধারেকাছেও গেলো না। শীতল কণ্ঠে জানতে চাইলো,
“রেজাউল সাহেবের টাকাটা কি তোমার পকেটে?”
মুহিনের শরীর একটি উচ্চ মাত্রার শক-ওয়েবের ঝাঁকুনি খেলো মনে হয়। এ কোনভাবেই হতে পারে না। অফিসের গোপন কারসাজি ঘরের মানুষের জানার কথা না।

নিনু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল,
“তোমার মোবাইলের মেসেজ আমার চোখে পড়েছে। কেন ভুলে যাও, সংসারটা তোমার একার না। ঘরের পুরুষ যদি সংসারের রাস্তা তৈরিতে দিন-রাত খেটে মরতে পারে, তবে ঘরের নারী হিসেবে সেই রাস্তা মসৃণ রাখার অধিকারও আমার আছে। ভুল পথের মোহ যদি তোমার হাতে বাঁশ ধরিয়ে দিতে চায়, স্ত্রী হিসেবে আমারও ক্ষমতা আছে সেই বাঁশে দু-চারটা ফুটো করে বাঁশি বানিয়ে বাজানোর। তুমি কী করেছো তা আমি জানতে চাইবো না। আমি এক কাপড়ে বেরিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস রাখি, শুধু এটাই জানিয়ে রাখলাম। আমার সন্তান হারাম রক্ত নিয়ে পৃথিবীতে ঘুরবে, তা আমি কখনও-ই হতে দিবো না।”

লাঞ্চ-ব্রেক-এর আগ পর্যন্ত মুহিন অনেকগুলো কাজ করে ফেললো। সাপ্লায়ার রেজাউলের টাকা ফেরত দেয়া হলো। চেয়ারম্যান স্যার-এর কাছে গিয়ে সব ফাইল হালনাগাদ করা হলো। এক ফাঁকে মিজান সাহেবের কাছ থেকে তার স্ত্রীকে নিয়ে করা হাস্যকর এক গল্পও হজম করলো। কেউ নিজের স্ত্রীকে নিয়ে এমন গল্প করতে পারে, এটা মুহিনের জানা ছিল না। মিজান সাহেব মহা উৎসাহে রসিয়ে-রসিয়ে বললেন,

“শুনেন মুহিন সাব। আমার বউ আবার আপনেরজনের মত না। টেকা-পয়সা কাগজের মত উড়ায়। তুই হইলি গিয়া কিউসি’র বউ, এত ফরফরানি আসে কইত্থে! দুই ছেলেমেয়ের মা। এখনও মাসে মাসে পার্লারে যাওয়া লাগে তার। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, একটা না একটা বার্ষিকী তো লাইগাই আছে সবসময়। বিরাট খরচান্ত ব্যাপার। সেইদিন রাইতে ভ্রু-প্লাক কইরা আসছে। সকালে উইঠা দেখে ভ্রূর মাঝের অংশ নাই। রাইতে তেলাপোকায় খাইছে মনে হয়! এখন বউরে আমি তেলিবেগম বইলা ডাকি। হাহাহা……………”

বিকেল গড়াতেই অফিসের পরিবেশ পালটে গেলো। মুহিন ভেবেছিল অফিস-কলিগ মিজান সাহেবের গানের যন্ত্রণা এবার কিছুটা কমবে। যন্ত্রণা কমেনি, বরং বেড়েছে। একটু পরপর তিনি গুনগুনিয়ে গানে টান দিচ্ছেন। দুঃখের গান নয় – আনন্দের গান। গান একটা শেষ হলে আরেকটা ধরছেন। বেশ অবাক হয়ে মুহিন তার কর্মকাণ্ড দেখছে। সঙ্গীত চর্চা কোন সমস্যা নয়, সমস্যা অন্য জায়গায়। একটু আগে তাকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করা হয়ছে। এ ব্যাপারে তাকে মোটেই চিন্তিত মনে হচ্ছে না। বরং আনন্দিত মনে হচ্ছে। গান টেনশন কমানোর একটা ভাল মাধ্যম। এটা একটা কারন হতে পারে।

এই মুহূর্তে মিজান সাহেব দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তাঁর ডেস্ক-ড্রয়ার টেনে খোলার চেষ্টা করছেন। ড্রয়ার খুলছে না। তিনি ড্রয়ার টানাটানির মধ্যেই একটু পর-পর গুনগুনিয়ে গানে টান দিচ্ছেন, “মনটা যদি খোলা যেত, সিন্দুকেরই মত!…হেঁইয়ো……” হেঁইয়ো শব্দটা অবশ্য গানের অংশ নয়।

মিজান সাহেব এমনিতেই বেশ আমুদে টাইপের। অদ্ভুত কারনে তিনি মুহিনকে অতিরিক্ত পছন্দ করেন। পদবী যাই হোক, একে অপরকে ভাই সম্বোধনে ডাকা হয় অফিসে। মিজান সাহেব দুই সন্তানের জনক। এখানকার কোয়ালিটি সেকশনে আছেন। আছেন মানে ছিলেন। তাঁর উপরে পড়া সাসপেন্সন অর্ডার, চাকরী চলে যাওয়া পর্যন্ত গড়াতে পারে। স্বয়ং চেয়ারম্যান স্যার (আড়ালে তাঁকে মেক সেন্স স্যার নামে ডাকা হয়। কারণ তিনি মেক সেন্স কথাটি ছাড়া বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারেন না) সবাইকে নিয়ে মিটিং কল করেছিলেন। তাঁর মতে, আজকের মিটিং এর বক্তব্য সকলের জন্য শিক্ষণীয় হওয়ার কথা। সেখানে তিনি বেশ সিরিয়াস ভঙ্গীতে বক্তব্য দিয়েছেন।

“আমার বায়িং হাউজটা ছোট এবং নতুন। আপাতত এখানে ভুল করার কোন সুযোগ নেই। মিঃ মিজান, ইউ আর সাসপেন্ডেড আনটিল উই রিয়েলাইজ ইউর ফল্ট ইজ মাইনর। মেক সেন্স?”
মিজান সাহেব কাটগড়ায় থাকা আসামীর মত বলেছেন,
“কিন্তু স্যার ভুল তো হইতে পারে। আরেকবার সুযোগ দেন। চেষ্টা করি। কবি বলেছেন, একবার না পারিলে দেখ শতবার।”
এই কথা শুনে স্যার চোখ বড় করে বিরাট এক লেকচার ঝেড়ে দিলেন,

“আমার অফিস বিজ্ঞানের – এসো নিজে করি টাইপের ল্যাবরেটরি না। শতবার চেষ্টা অন্য কোথাও করেন, এখানে না। এত কথা আপনাকে বলার দরকারও ছিল না আমার। এই উপলক্ষে আমি জাস্ট সবাইকে এলার্ট করতে চাচ্ছিলাম।”
বক্তব্যের এই অংশে এসে স্যার থামলেন। পাশে রাখা পানির গ্লাস একটা চুমুক দিয়ে মিজান সাহেবের দিকে সোজা দৃষ্টি দিয়ে বললেন,

“আপনি কিছু অসৎ মানুষের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন। কাজে কর্মেও সিরিয়াস না। আপনি পুরনো স্টাফ। অতীতে অনেকবার এলার্ট করা হয়েছে – শোধরানো যায়নি। যদি আপনি একবার করে না পারেন, তবে চেষ্টা করুন, না হলে আবারও করুন। তারপরও না হলে বাদ দিন। একই ব্যর্থতার পর বারবার চেষ্টা করে নিজেকে ছাগল প্রমাণের দরকার কী! এটা আমার কথা না, কথাটা ফিল্ডস সাহেবের। অবশ্য ছাগল শব্দটা আমার বানানো, উনি বলেছেন ফুল। মানে বোকা। আমার কাছে বোকা আর ছাগল একই। আমি এই কথা মেনে চলি। মেক সেন্স?”

অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে। বাইরে জোরেশোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নিনুর শরীরটা কেমন আছে কে জানে। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরুতে হবে। মিজান সাহেব নিনি-নিনি সুর তুলে মুহিনের ডেস্কের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
“মুহিন সাব, বাইরে বৃষ্টি। যাইবেন ক্যামনে? একটু বসেন, ভাল একটা গান শোনাই।”

“ভাল গান শোনার সময় নেই ভাই। বেরোতে হবে, কাজ আছে। আপনার ভাবী বাসায় একা।” – মুহিন ডেস্ক গোছাতে গোছাতে হাসি দিয়ে জানালো। মিজান সাহেব তার আরেকটু গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন,
“কাজ নিয়া এত পাগল হওয়ার কী আছে? দুনিয়া বড়ই আজব জায়গা। মাঝেমইধ্যে এমুন হবে যে, আপনে কাজ চান, কিন্তু কাজ আপনেরে চায় না। ব্যাপক কপালের ব্যাপার আছে।”

কথাটা বলেই তিনি একটা হেড ফোন মুহিনের কানে গুঁজে দিয়ে বললেন,
“গানটা শুনেন, বৃষ্টি দিনের গান। এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না। শিল্পী রুনা লায়লা। আমার জন্মের আগের ছবি। ছবির নাম নরম গরম। সাল ঊনিশ’শ বিরাশি।”
“আপনি তো দেখছি বাংলা সিনেমা-গানের জীবন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া!”

কথাবার্তার এই পর্যায়ে এইচ আর ডিপার্টমেন্ট থেকে তার কাছে একটা খাম এসে পৌঁছুল। মিজান সাহেব খাম নিয়ে নিজের ডেস্কে চলে যাওয়ার আগে মুহিনের কানে-কানে বললেন,
“জীবনে লোভে পইড়া বউয়ের ইন্দনে বহু অপরাধ করছি। আপনে কখনও করবেন না আমি জানি। ঘরের বউ একটা বিরাট ব্যাপার। রেজাউলের খাম ফেরত দিয়া ভাল করছেন। এখন চিন্তায় আছি, আমার বেগমরে একটা সেলাই মেশিন কিন্যা দিমু। লোভের ফল আমি একা খামু ক্যান? কথা ঠিক কইছি না? হাহা……………”

মিজান সাহেব হাসতে হাসতে চলে গেলেন। মুহিন এই আপাত রহস্যময় রসিক মানুষটির কাছ থেকে একটা জিনিষ শিখেছে। তা হলো, জীবনে কষ্টের মুহূর্তগুলোকেও কিভাবে হাসি দিয়ে ঢেকে রাখা যায়!

মুহিনের মনের মধ্যেও একধরনের অস্বস্তি কাজ করছে। ইদানীং অনেকেরই হুট-হাট চাকরী চলে যাচ্ছে। গত মাসেও একজনকে বিদায় জানানো হয়েছে। গুলশানের হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলা হওয়ার পর ইতালীর দু’টো মাদার বায়ার হারিয়েছে অফিস। রেভিন্যু কমে গিয়েছে। কোম্পানি মালিকের মাথা ঠিক নেই।

রাত দশটায় আধা ভেজা হয়ে বাসায় ফিরেছে মুহিন। ছয় তলার সিঁড়ি বেয়ে হাঁফ ধরে গেছে। নিনু বেড রুম অন্ধকার করে শুয়ে ছিল। বাইরের খোলা ছাদের পাশটায় একটা বৃহৎ জানালা। জানালা থেকে শুক্লা তিথির মিহি আলো খাটের একপাশ আবছা আলোকিত করে রেখেছে। মুহিনকে আসতে দেখে নিনু ইশারায় পাশে বসতে বলল। মুহিন স্ত্রীর শিয়রে বসে মুখ খোলার আগেই নিনু থামিয়ে দিলো। বলল,
“আমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি তোমাকে চিনি। এই পরিচিত মুখটি মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েই যেন মরতে পারি, আর কিছু চাই না। তোমার মনে আছে মার্চেন্ট অফ ভেনিসের শাইলকের মত তোমার কাছে থেকে আমার দেনমোহরের টাকা আদায় করেছিলাম?”

“ছিঃ শাইলকের মত বলছ কেন? ওটা তোমার প্রাপ্য ছিল।”

“হুম, তা ঠিক। আমি জানতাম তোমার কাছে টাকা-পয়সা খুব একটা থাকবে না। বিপদে-আপদে তালগোল পাকিয়ে ফেলবে। টাকাটা আমার মায়ের কাছে আমানত স্বরূপ রাখা আছে। প্রয়োজনের সময় যেন কাজে লাগাতে পারো। আমার হক, আমার সন্তানের জন্য খরচ করতেই পারি, তাই না? পরে শোধ দিয়ে দিও। হাহা ”

নিনু আবারও তার ভুবন ভোলানো হাসিতে ফেটে পড়তে চাইছে। শরীর খারাপ থাকায় হেসে সুবিধা করতে পারছে না। একটুতেই ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে হাফাচ্ছে। মুহিন স্ত্রীর ডান হাতের তালু নিজের কোলে টেনে নিয়ে তাতে আঙ্গুল ঘষতে ঘষতে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো – বলতে পারলো না। তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, সে তার প্রচণ্ড আবেগপূর্ণ ভালোবাসা কারও কাছে ঠিক মত প্রকাশ করতে পারে না।

মুহিন স্ত্রীর কপালে হাত রেখে চমকে উঠলো।
“কী ব্যাপার! গা’ দেখি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! আমাকে জানাওনি কেন?”
“তুমি ভেজা কাপড় ছেড়ে আসো। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। সেরে যাবে। ওষুধ খেয়েছি।”
মুহিন পোশাক বদলে নিনুর পাশে ঘাড় গুঁজে বসলো। নিনু জ্বরাক্রান্ত ভারী স্বরে বাচ্চাদের মত হেসে ফেলে বলল,
“তোমার মনে আছে, রাঙামাটির পাহাড়ি পথে তুমি আমাকে প্রথম কোলে নিয়ে হেঁটেছিলে। তখন তো আমার ওজন কম ছিল, তাই না?”
মুহিন হেসে দিলো। বলল,
“ওজন নিয়ে এত চিন্তা করো না তো। ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমার চিন্তা অন্য কারণে। তুমি বুঝবে না। আজ দুপুরে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছি, জানো?”
মুহিন মজার ছলে বলল,
“সুন্দর স্বপ্নে আমি কি ছিলাম?”
“কী আশ্চর্য! তুমি ছাড়া স্বপ্ন পূর্ণ হবে কী করে? জানো, মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার গর্ভের সন্তানটি মেয়ে হবে।”
“এটাও স্বপ্নে পেয়েছ?”
“হুম, দেখলাম তোমাকে আর আমকে ঘিরে একটা মেয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। মাথার দুপাশে দু’টো ঝুঁটি বেঁধে দেয়া। দেখতে অবিকল তোমার মত, শুধু হাসিটা আমার পেয়েছে।”
“টোল পড়ে?”
“হুম। বাইরে সুন্দর চাঁদ উঠেছে। একটা রিকুয়েস্ট করবো, রাখবে?”
” বলো। ”
“আমাকে একটু দাঁড়াতে সাহায্য করো। খোলা ছাদে গিয়ে একটু চাঁদের মিহি আলো মাখি। আমি চাই, আমার সন্তান যাতে চাঁদের রুপ নিয়ে আসে পৃথিবীতে। আইডিয়া খারাপ না, তাই না? হিহিহি”

নিনু হাসছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহিন তার বলিষ্ঠ বাহু বাড়িয়ে স্ত্রীকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো। যা হবার হবে। আজ সে চাইলে পুরো একটা পাহাড় এক নিঃশ্বাসে উঠিয়ে নিয়ে হাঁটতে পারবে। অন্য কোন সময় হলে নিনু আনন্দে চিৎকার করে উঠত। ঘটনার আকস্মিকতায় সে আজ চিৎকারের সময় পায়নি। সে অসম্ভব অবর্ণনীয় এক আনন্দে স্বামীর প্রশস্ত বুক আঁকড়ে ধরে আছে। তার চোখ ভরা চন্দ্র ধোয়া আনন্দ গলে গলে অমৃত-জল হয়ে থেকে থেকে সেই প্রসস্ত বুকটি ভিজিয়ে দিচ্ছে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত