মেয়েটা খাটের ডান পাশে শুয়ে আছে। যাকে আমি ঘন্টা চারেক আগেও চিনতাম না। যাকে চিনি না, যার সম্পর্কে কিছু জানি না তার সাথে সারাজীবন থাকা সম্ভব কিভাবে। সূত্র নেই কোন এটার।
বিপত্তিতে পরেছি বিকেলবেলা। যখন বিকেলবেলা অফিস থেকে ফিরেই আম্মু বললো গোসল করে তৈরি হয় নে। কেন এর প্রশ্নতে আম্মু বললো কিছু কেনাকাটা করবে, তাই বাজারে যাবে। আধ-ঘন্টা পর যখন পর বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
– মিষ্টি কি করবা? (রোহান)
– একটা জায়গাতে যাবো। (আম্মু)
– কতটুকু নিবো?
– কয়েকক রকেমর কেজি খানেক নে।
– এতো রকমের মিষ্টি কি হবে?
– আরে দরকার আছে।
– টাকা দাও।
– দে টাকা দে। বেতন পাস না অফিসে?
ছোট বোন হেসে উঠলো পাশ থেকে। জানতাম এটাই হবে। ভদ্র ছেলের মতো টাকা দিয়ে মিষ্টিগুলো নিলাম। বাজার থেকে রওনা দেওয়ার প্রায় মিনিট পনেরো পর একটা বাড়ির সামনে আসলাম। বাড়ি দেখে বুঝলাম অবস্থা বেশ ভালো বাড়িওয়ালাদের। আমি বলে বসলাম..
– এটা কার বাড়ি?
– আমার এক পরিচিতর বাড়ি।
– বাড়ি বিক্রি করবে নাকি? বাড়ি দেখতে আসছো সেইজন্য এতো মিষ্টি নিয়ে আসা লাগবে?
– বেশি কথা বলিস কেন?
বাড়ির সামনে মিনিট খানেক দাড়িয়ে থাকার পর দেখি কোথায় থেকে মামা খালা চলে আসলো। এদের আসা দেখে নিজের কাছে খটকা লাগলো। কারো কি বিয়ে ঠিক করছে নাকি? করতেও পারে আমার খালাতো ভাই নাহিদ যে জিনিস। হেতি করবো বিয়া আর এতো টাকা দিয়ে আমাকে দিয়ে কেনালো মিষ্টি। কপালটাই খারাপ আজকে। যাইহোক ভেতরে প্রবেশ করতেই সেই পরিমান খাতির দেখিয়ে বসতে বললো। দেখলাম সবার সাথে সবার সেই পরিমান গল্প চলছে আমিও গল্প শুনছি আর আশপাশ তাকিয়ে দেখছি। বেশ সাজানো গোছানো বাড়ি। বড্ড ক্ষুধাও লেগেছিলো। তাই তো টেবিলের সামনে সদ্য রেখে যাওয়া খাবার তুলে মুখে যেই দিবো তখনি আম্মুর তাকানো দেখে ফু দিয়ে রেখে দিতে দিতে বললাম..
– না, আসলে দেখছিলাম।
– না না। কোন সমস্যা নেই। আপনাদের জন্যই এতো কিছুর আয়োজন। বাবা তুমি খাও।
নাহ্ অান্কেলটা ভদ্র আছে অবশ্য।
– তা ভাই সাহেব মেয়েকে ডাকুন। (মামা)
– হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।
কিছুক্ষনের মধ্যে মাঝ বয়সি মহিলা ঘোমটা পরিহিত এক মেয়েকে নিয়ে হাজির। শুনলাম এটা নাকি মেয়ের মা। আম্মু, মামা, খালা মিলে ফিস ফিস করে কথা বলে আম্মু বললো…
– ভাই মেয়ে আমাদের পছন্দ।
– আলহামদুলিল্লাহ। এটাতো খুশির কথা। ছেলেকেও আমাদের পছন্দ হয়েছে।
– তাহলে কথামতো আজকেই বিয়েটা হয়ে যাক।
– আমাদের কোন আপত্তি নাই।
– আম্মু বিয়েটা কার? নাহিদের নাকি? কিন্তু সে কই? (ফিস ফিস করে আম্মুর কানে বললাম)
– নাহিদের না বাবা। তোমার বিয়ের কথা চলছে এখানে।
কিছুক্ষনের জন্য স্ট্যাচু হয়ে আম্মুকে বললাম..
– কথা আছে ওদিকে চলো।
– পরে।
– এখনি।
– কি বল?
– এইসব কি?
– কিসের?
– আমাকে না জানিয়ে এইসব কি?
– কই তোকে না জানিয়ে? তোর সামনেই তো সব কথা বললাম।
– কিন্তু আম্মু তুমি তো জানো আমার বিয়ে করার ইচ্ছা আমার নাই। আর চেনা নেই জানা নেই একজনকে এভাবে বিয়ে করা তো সম্ভব না।
– দেখ বাবা মেয়েটা দেখতে কত সুন্দর। খুব সুন্দর মানাবে তোর সাথে। আর এখন দুইজন আলাদা করে কথা বলে নে তাহলেই হবে। আর মেয়ে তোকে পছন্দ করেছে দেখেই আমরা মেয়ে দেখতে আসছি।
– কিন্তু!
– আর কিন্তু না বাবা। তুইতো আমার অসুখের কথা জানিস। কখন আছি কখন নেই। মরার আগে নাতি নাতিনদের মুখটা দেখতে দিবি না? চল বাবা আর দ্বিমত করিস না।
হ্যাঁ কাজ হয়ে গেল। ঘন্টাখানেক ধরে একটা রুমে বসে আছি। কই থেকে কে কে এসে হাজির এই বাসায়। হয়তো ইনাদের আত্নীয় হবে।
– কিরে কি খবর চলছে গুরু? (নাহিদ)
– তোরে না বলছি গুরু টুরু বলবি না আমাকে।
– না বলে কি আর পারি? বয়সে তোর এক সপ্তাহের ছোট। তাহলে সপ্তাহখানেক পর তো আমার বিয়ে হওয়া উচিত। যাই বল না কেন, ভাবি দেখতে সেই সুন্দর।
– তোর পছন্দ। তাহলে তুই বিয়ে করে নে।
– আরে ধুর। ভাবির ছোটবোন দেখতে সেই সুন্দর। ওর সাথে একটু আলাপ জমিয়ে আসি।
রাত্রি সোয়া এগারোটার নাগাদ নিজের ঘরে ঢুকলাম। দেখি মেয়েটা খাটের মাঝখানে বসে আছে। এতোদিন ভেবে এসেছি কি আর আজ হলো কি। ধ্যাত সকালে কার মুখ দেখে যে উঠেছিলাম। আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে মেয়েটা খাট থেকে ওঠে এসে সালাম করতে লাগলো।
– না না এইসব করেন না। পায়ে হাত দেওয়া উচিত না।
– ঠিক আছে।
– দুঃখিত আমি আপনার নাম জানি না।
– আমি রাত্রি। এবার অনার্স তৃতীয় বর্ষে।
– রাত তো অনেক হলো আপনি ঘুমিয়ে পরেন।
– ঠিক আছে।
তারপর আর কি, সেই ঘটনা। বিছানায় পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি। মেয়েটা দেখতে অনেক সুন্দর। কিন্তু তাকে তো চিনি না কিংবা জানিও না। যতটুকু সে বললো ততোটুকুই জানি।
পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলো বোনের ডাকে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে বললো। নানা আয়োজন নাকি আছে। সব অনুষ্ঠাস শেষ।
সপ্তাহ দুয়েক পার হল। কিন্তু কেন জানি রাত্রিকে নিজের করে নিতে পারি না। সিগারেটের বদ অভ্যাস আছে। রাতে ছাদে দাড়িয়ে সিগারেট জ্বালিয়েছি। ভাবছি, কারো প্রতি তো কোন অনুভূতি নেই। তাহলে এই মেয়েটার প্রতি আমার অবহেলা কেন। আসলে মেয়েটার প্রতিই আমার অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে এই কয়েকদিনে। যার সাথে তেমন কথা বলি না, যার খেয়াল রাখি না, যাকে ভালোবাসি কিনা জানি না। কিন্তু সে এই অল্প দিনে সবাইকে আপন করে নিয়েছে। আর আমার ব্যাপারে তার কথা না ভাবলাম। আকাশে হালকা মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হলেও মন্দ হবে না। যদিও শীতের সময়। ভালোই ঠান্ডা পরেছে। কুয়াশাতে কিছুটা আন্দাজ করা যাচ্ছে মেঘের অস্তিত্ব। পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলাম। রাত্রি দাড়িয়ে আছে। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই বলে উঠলো।
– কিছু কথা বলতাম। (রাত্রি)
– বলেন।
– ডিভোর্স দিবেন কি?
– হঠাৎ এই কথা?
– বলেন।
– নাহ্।
– কাওকে পছন্দ বা ভালোবাসেন?
– কেন?
– এমনি জিজ্ঞেস করলাম। কাওকে ভালোবাসলে বলেন। আমি নিজ থেকেই চলে যাবো।
– এমনটা না।
– তাহলে?
-……………… (চুপ)
– আমাকে আপনার পছন্দ না। তাই না?
– তা না। আমি একটু সময় নিয়ে ছিলাম।
– হুম।
– কি?
– আসলে অনেক কয়েকটা দিন তো পার হলো। এর মাঝে আপনি আমার সাথে কথাও তেমন বলেন নাতো তাই। আচ্ছা ঘুমাতে আসেন।
– আপনি যান। আমি যাচ্ছি।
মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি রাতটা অনেক হয়েছে। দেড়টা পার হয়ে ০১ঃ৩২ মিনিট। ছাদের রেলিংএ বসে নীল সাদার জগৎ ফেসবুকে ঢুকলাম। নিজের আইডি থেকে রাত্রির প্রোফাইলে গেলাম। নিজের কোন ছবিই তার আইডিতে নাই। শুধু বিয়ের দিনের তার আর আমার একসাথে তোলা একটা ছবি কভার ফটো আছে। ছবিতে মেয়েটা নিচের দিকে তাকিয়ে অাছে আর আমি তার দিকে। সিদ্ধান্ত নিলাম রাত্রিকে আর কষ্ট দেওয়া যাবে না। বিনা কারনে কাওকে কষ্ট দেওয়া আর সম্ভব না আমার পক্ষে। রুমে গিয়ে দেখি মেয়েটি ঘুমিয়েছে। টেবিল ল্যাম্পের হালাকা আলোতে তার মুখটা দেখে নিজের কাছেই অপরাধি মনে হচ্ছে। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে একটা প্যাকেট বের করে রাত্রির পাশে গিয়ে দাড়ালাম। ভাবলাম ডাক দিবো। কিন্তু না ডাক দিলাম না। ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে আছি। মেয়েটা নড়ে চড়ে বসলো। আমাকে দাড়িয়ে থাকা দেখে বিছানা থেকে ওঠে দাড়ালো।
– কিছু লাগবে আপনার? (রাত্রি)
– হুম। (আমি)
– ক্ষুধা লেগেছে কি আপনার? আপনি একটু বসেন আমি কিছু বানিয়ে আনি।
– না ক্ষুধা লাগে নি।
– তাহলে?
– এটা আপনার জন্য।
– কি এটা?
– এক জোড়া রূপার পায়েল আছে।
– হঠাৎ? কবে কিনেছেন? অনেক সুন্দর দেখতে।
– কোন এক শীতের দিনে ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে বাসায় আসার সময় স্বর্নকারের দোকানে দেখেছিলাম। ভালো লেগেছিল তাই কিনেছিলাম। যাকে ভালোবাসবো তাকে নিজ হাতে পরিয়ে দিবো ভেবেছিলাম।
– তাহলে পরিয়ে দিন।
মাথা নিচে নামিয়ে ভীতুস্বরে বলে উঠলো রাত্রি। আমিও আর কিছু না ভেবে বিছানাতে বসে তার পায়ে পায়েল জোড়া পরাতে লাগলাম।
– ভালোবাসেন? (রাত্রি)
-…………….
– নিজে পরিয়ে দিলেন যে?
– ভালোবাসি। অনেক আগেই ভালোবেসে ফেলেছি। শুধু সময় নিচ্ছিলাম আপনাকে কষ্ট দিয়ে।
মেয়েটার চোঁখ লাল হয়ে গিয়েছে। চোঁখের কোনে পানিও জমেছে। কিন্তু বের হতে দিচ্ছে না। আচমকা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলো রাত্রি। বাধা দিলাম না। কান্না করুক, কান্না করে নিজেকে হালকা করুক। টি-শার্টের ডান পাশটা ভিজিয়ে দিয়েছে কান্না করে। ভিজুক!