আমার মা

আমার মা

পাঁচ ইঞ্চি উচু হাই হিল আর পাতলা জরজেট শাড়ি পরে যখন আসিফের সাথে ওর বিজনেস পার্টি তে যাই তখন মনের মাঝে কিছুটা খুতখুত থাকলেও সেটা আর গায়ে মাখি না। যখন আসিফের বন্ধুরা আমাকে দেখে আসিফের পছন্দের প্রশংসা করে তখন ভালো ই লাগে এই বেশে। এসব পার্টি অনুষ্টান থেকে আসতে আসতে রাত অনেক হয়ে যেত। কখনো রাত তিনটা চারটা অনায়াশে বেজে যেত। যখন বাসায় ঢুকতাম তখন আমার শাশুড়িকে পেতাম তাহাজ্জুদের নামায পরছেন। কিছু বলতেন না আমাকে আমার সাথে তো আসিফও থাকে।

আয়ান আর ধ্রুবকে ঘুম পারিয়ে দিতেন আমার শ্বাশুড়ি। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পরতাম আমরা। সকালে উঠতাম ৯:৩০ বা ১০ টায়। বুয়া নাস্তা রেডি করে ডাক দিত। আমি আয়ান কে স্কুলের জন্য রেডি করে টিফিন দিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে আসিফ কে ডাক দিতাম অফিসের জন্য। সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমি আমার শ্বাশুড়িকে চা বানিয়ে নিয়ে যেতাম উনার রুমে। উনি খুব সকাল উঠে পরতেন। আমার হাতের চা ছাড়া আর কারো হাতের খান না। অনেক সময় বিরক্ত লাগে। কি এমন হয় বুয়ার হাতের চা খেলে। তাও মুখে কিছু বলতাম না। চা নিয়ে উনার পাশে বসলে, অনেক কথা শুরু করেন এদিকে আমার মোবাইলের মেসেন্জারে টুংটাং আওয়াজ বেজে ই চলত। অনেক সময় আমি নিজে কিছু বলে উঠে আসতাম না হলে উনি বলতেন, যাও হয়ত দরকারি কিছু আছে দেখ গিয়ে।

ধ্রুব কে সাথে নিয়ে শপিং এটা ওটা সারাদিন করতাম। আজ আসিফের পার্টি কাল আমার কোনো বান্ধবীর জন্মদিন বা এনিভারসারি এগুলো নিয়ে আমাদের চলছে। আয়ান আর ধ্রুব কে হুম টিউটর এর কাছে সন্ধ্যায় পড়তে বসিয়ে আসিফের বসের পার্টি তে চলে গেলাম আমরা। মা কে বললাম শুধু আসতে একটু দেরি হবে। উনি মাথা ঝাকালেন শুধু। আয়ান আর ধ্রুব কে নিয়ে টেনশন নেই ওরা ওদের দাদুর কাছে ই ভালো থাকে আমার থেকে।
আজ পার্টির থিম ছিল ওয়েস্টার্ন ড্রেস। হালকা নিল রং এর ড্রেস নিচের দিক কিছুটা কাটা এরকম একটা ড্রেস পরলাম।

যেহেতু ওয়েস্টার্ন কালচার অনুযায়ি পার্টি তাই অনেক আলাদা কিছু ছিল সেখানে সাথে ছিল রেড ওয়াইন। অনেক জোরাজুরি তে আমাদের এসব খেতে হল। খেয়ে নিলাম। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তো চলতে হবে।
বাসায় আসতে আসতে সারে চারটা। শ্বাশুড়ি মা দরজা খুলে দিয়ে সামনে দাড়িয়ে রইলেন। উনি ঠিক বুঝতে পেরেছেন আমাদের অবস্থা। যতই হোক তখনকার সময়ের শিক্ষিত মহিলা। কিছু না বলে ভিতরে চলে গেলেন। অনেক বার আগে এসবের জন্য মানা করতেন কিন্তু আসিফ কি শুনে কারো কথা। সকালে উঠে রাতের জন্য মন কেমন কেমন করছিল। তাই চা নিয়ে মায়ের ঘরে গেলাম। মাকে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হলাম, এই সময় উনি তেলওয়াত করেন। শরীর খারাপ কি না জিজ্ঞাস করলাম। নাহ এমন কিছু না। চুপচাপ চা খাচ্ছেন। আমি মোবাইলে ব্যস্ত। হঠাৎ মা বললেন,

— বউমা আজকে পার্লার থেকে আসার সময় আমার জন্য বাজার হতে মুলতানি মাটি আর এলোভ্যারা নিয়ে এসো।
কথাগুলো শুনে কেমন জানি লাগল।

কিছু না বলে চলে আসলাম। বিকেলে ধ্রুব কে দিয়ে এসব পাঠালাম। আমি আমার জন্য আনা ফেইসপ্যাক নিয়ে মুখে লাগালাম। এরকম ই কাটল দিন। ঠিক রাত আটটায়, আমার শ্বাশুড়ি নতুন শাড়ি, চুড়ি কিছুটা গয়না পরে কোথায় যেন বের হলেন। আমি কিছু ই বললাম না। শুধু বললেন উনার কোনো এক আত্মিয়ের বাসা যাচ্ছেন। ফিরলেন রাত ঠিক একটায়। আসিফ দেখেও কিছু বলল না।

গত দুদিন আসিফের জ্বর থাকায় কোথায় যায় নি, আশ্চর্যের বিষয় হলো মা একটি বারও আসিফকে দেখতে আসেন নি। দরজায় একটু উকি মেরে চলে যান। এভাবে তিনদিন পার হল। আমার শ্বাশুড়ি মা কি সব উনাদের কিট্টি পার্টি, বারবি পার্টি তে যান। আর আমরা আমাদের মত কিন্তু ফিরতাম তাড়াতারি। বাসায় আয়ান ধ্রুব একা থাকত। আসিফ কিছু বলত না, সে খুশি সময়ের সাথে তালমিলিয়ে যখন তিনি চলতে শুরু করেছেন। তার বাধা নেই।

আসিফ কয়েক মাসের জন্য দেশের বাইরে যায়। আমি একা হয়ে পরি। পুরনো সব ফ্রেন্ড নিয়ে সময় কাটানো তে আমি মত্ত। এসব করতে করতে কখন যে আমি আসিফের অনুপস্থিতে অন্যকারো সাথে জড়িয়ে পরেছি বুঝতে পারিনি। আমার দু দুটো সন্তান থাকা সত্ত্বেও এসব আমার খেয়াল নেই। আগে বাসায় একটু হলেও ভয় লজ্জা লাগত কিন্তু এখন সেটাও নেই শ্বাশুড়িও উনি উনার মত চলেন। আমার এই বিষয় টা ঠিক ই আমার শ্বাশুড়ি খেয়াল করেছেন। আসিফ আমার নাম্বার বিজি পায় প্রায়।

ঠিক এর সপ্তাহ খানিক পর আমার এক বান্ধবী মেসেজ দিল। আমার শ্বাশুড়ি নাকি অনলাইনে ওকে নক করেছেন। বিভিন্ন কালাফুল ছবি দিয়ে ভরা। সে নাকি দেখেছে উনি কিসব জায়গায়ও যান। আমি কি বলব বুঝতে পারছি না।
অন্যদিকে আসিফ জানাল ওর কোনো এক বন্ধুর কাছে নাকি টাকা চেয়েছেন। কিরকম লজ্জাকর অবস্থা। একজন না তাও পর দিন কয়েকজন এর কাছে অনেক অজুহাতে! এসবের জন্য আসিফ সময়ের আগে ই চলে আসে। এসে ই মায়ের সামনাসামনি দাড়ায়। একজন সন্তান হয়ে মায়ের এরকম আচরণ কিভাবে মেনে নিব সে জানতে চায়।

তখন আমার শ্বাশুড়ি মা বলেন, তোমাদের যে দুটো ছেলে আছে সে খেয়াল আছে? তোমাদের এক এক জনের এরকম আচরণ এ যে তাদের কি হয় বুঝ তোমরা। আমি অনেক বাধা দিয়েছি শুননি। আর বলিনি। কিন্তু আমার নাতি যখন এসব নিয়ে মন খারাপ করে আমার কলজা টা ছিড়ে যায়। তোমরা ভুলে যাচ্ছ তারাও বড় হচ্ছে। তাই এসব করা।
এখন তোমাদের ইচ্ছা। তোমাদের দোষ টা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে এসব করলাম। আর কিছু না। আসিফ ক্ষমা চাইল। আমিও।

রাতে মায়ের রুমে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম যে পাপ করতে চলেছিলাম তার জন্য। মা বললেন, তোমাদের মত তোমাদের সময় টা পার করেছ কিন্তু এখন সন্তানদের কথা ভাব। আমি তোমাকে নিজের মেয়ের মত মনে করি সবসময় আর কিছু বলব না মা, সংসার টা তোমার মত সাজিয়ে নাও আমি ছুটি নেই। অনেক কান্না করলাম মাকে জড়িয়ে ধরে। রাত শেষের দিকে তাহাজ্জুদ এর নামাজ পরে তিলওয়াত এ বসলাম এক অন্যরকম সুখ পেলাম মনে।
সংসার কি এই গত কয়টা দিনে বুঝলাম আসিফ পাল্টে গেছে। স্বামী সন্তান শাশুড়ি নিয়ে ভালো ই আছি। পরদিন সকালে আমার মা কে আর খোঁজে পেলাম না এই দুনিয়ায়। চলে গেলেন সব ছেড়ে। মা কি জিনিষ বুঝিনি ছোট বেলায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু এই মানুষ টা কে মা ডাকতে কখনো কার্পন্য করিনি।

শাশুড়ি যে এমন মা হতে পাররেন জানতাম না, মা বললেই ঐ মানুষটার কথা মনে ভেসে উঠে। আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। এক সংসারি মা আমার মধ্য গেঁথে দিয়ে সব মানুষ পৃথিবীতে এক হয় না এমন মানুষ জীবনে বার বার আসেন না..

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত