একটি রিমোর্ট জয়ের গল্প

একটি রিমোর্ট জয়ের গল্প

ঝুম বৃষ্টি৷ বাইরে বেরোনোর উপায় নেই৷ আমার কলেজ যাওয়া হয়নি৷ আব্বাও অফিস যায়নি৷ আম্মা আর আপা মিলে সকাল সকাল রান্না সেরে ফেলেছে৷ সকালে নাস্তার টেবিলে আব্বা বলল,

-এত তারাতারি রান্না শেষ?” আম্মা সরাৎ সরাৎ চা টেনে বলল,
-আজকে মা-মেয়ে মিলে সারাদিন টিভি দেখবো৷”

আমি আব্বার দিকে তাকালাম একবার৷ আব্বার মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে৷ খানিক বাদে আম্মা বসলেন টিভির সামনে৷ কিছুক্ষণ বাদে যোগ দিল আপা৷ আব্বা সোফায় বসে গতকালের বাসি পত্রিকাটা পড়ছে৷ অথচ এই পত্রিকাটা আব্বা গতকাল খুটিয়ে খুটিয়ে পড়েছেন৷ কিছু বাকি রাখে নি৷ আমারও ফোন চালাতে চালাতে বিরক্ত এসে গিয়েছি৷ কাল রাতে মিতুর সাথে ঝগড়া লেগেছে ফোনে৷ এই মেয়ের সাথে বছরে ৬মাস আমার ঝগড়া লাগে৷ কাল রাতের ঝগড়ার বিষয়টা অদ্ভূত৷ আপার সাথে টিভির রুমে মারামারি বাজাইছিলাম রিমোর্ট নিয়ে৷ দিনশেষে সেই বিজয়ী৷ সেই মারামারি রেশ ধরে মিতুকে কিছুক্ষণ ভারতীয় সিরিয়ালের অপকার বোঝালাম৷ তারপর বললাম,

-বিয়ের পর আমি,তুমি আর আব্বা মিলে সারাদিন টিভিতে খেলা দেখবো৷ খেলা না থাকলে হাইলাইটস দেখবো বুঝলে!”

মিতু হা হু করে জবাব দিলো কিছুক্ষণ৷ আমি ধমকের স্বরে বললাম, হা, হু করছো কেন?” আসল বোমাটা তারপরেই ফাটালো মিতু৷ আমারও লাভ হয়েছে৷ নতুন কিছু গালি শিখে ফেলেছি এই সুযোগে৷ বাইরে যা গরম পরছে আজকাল৷ এই গরমে বিরক্ত হয়ে পাবলিক বাসের ছ্যাচড়া হেল্পারটাকে গালি দিতে দিতে গালির ভান্ডার শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ কয়েকদিন ধরে দিইনি৷ আজ মিতুর কাছ থেকে নতুন কিছুর আমদানি হয়েছে৷ সেগুলো কাজে লাগাবো৷” আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম মিতুও সিরিয়ালের ভক্ত৷ মাঝে মধ্যে আমাকে বলে, আমার শ্বাশুড়ি আর ননদের সাথে মিলবে ভালো!”

আপার সাথে মারামারি করে আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম৷” আমি সোফায় বসে আব্বার পত্রিকা পড়া দেখছি৷ খানিক বাদে পত্রিকাটা একদম ছুঁড়ে ফেলে দিল৷ তারপর বলল, দেশটা গেল রে!” আফসোস করতে করতে আব্বা চোখটা বন্ধ করবো৷ আমি পত্রিকাটা নিয়ে বিনোদনের পাতাটা উল্টালাম৷ হতাশ হলাম৷ আজ পরী মণি কিংবা দিপীকাদের ছবি নেই৷ প্রিয়াংকার ছবি দেখা যাচ্ছে৷ সেটাও তার ছোট ভাইয়ের সাথে৷ মেয়েটাকে আমার আগে ভালো লাগতো৷ ওর বিয়েটা আমি মেনে নিতে পারি নি৷ তাই নিক কে ওর ছোটভাই ভাবি আমি৷” টিভির রুম থেকে হাত তালির আওয়াজ আসছে৷ আব্বা চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

-দেখেছিস অবস্থা!” আমার আপার একটা সমস্যা আছে৷ ও নায়ক-নায়িকা জয় হলেই শব্দ করে তালি মারে৷ অবশ্য আব্বার সমস্যা এই তালি না৷ আম্মার হাত থেকে জব্দ করে রিমোর্ট নিতে না পারার বেদনায় মানুষটার ভেতরে জ্বলে যাচ্ছে৷ আমিও আফসোসের স্বরে বললাম,

-আসলে আব্বা কিছু করা দরকার৷” আব্বা বলল,
-কি করবো রে৷ আমিতো হোটেলের খাবার খেতে পারি নাহ৷

তাই কিছু বলতেও পারি না৷” আব্বার কথাটা বুঝতে আমার দু’মিনিট লেগেছে৷ ডিপ্লোম্যাটিক জবাব দিয়ে ফেলেছে৷ আমি রুমে আসলাম৷ মিতুকে ফোন দিলাম৷ ফোন বন্ধ৷ দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ৷ বাইরে বৃষ্টি বাড়ছে৷ চোখটা লেগে আসতেই দরজায় টুক টুক শব্দ৷ দরজা খুলতেই আব্বার জ্বলজ্বল করা মুখটা দেখতে পেলাম৷ কিছু বলার আগেই আমার হাত ধরে টিভির রুমে নিয়ে গেল৷ আম্মা আর আপা দু’জনই অবাক৷ আম্মা বলল,

-তুমিও সিরিয়াল দেখবা নাকি?” আব্বা “হ্যা”সূচক মাথা নাড়ালো!আম্মা মুখে মুচকি হাসি টাঙিয়ে বলল,
-যাক এতদিনে মাথা খুলেছে৷” আব্বা মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছে! আর আমি আব্বাকে দেখছি৷ মন খারাপ হল একটু৷ এতো সহজে আত্মসমর্পণ! আমি মেনে নিতে পারছি না৷ সিরিয়ালের নায়িকাকে দেখে আব্বা মিনমিন করে আমাকে বলল,

-আমাকে সাপোর্ট দিবি৷” নায়িকাকে দেখে আব্বা বলল, শুভ্র মেয়েটার নাম জানিস? ফেসবুক আছে ওর? আমাকে ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি বুঝলি৷” আব্বার নিন্জা টেকনিক দেখে আমিও পুলকিত হলাম৷ আমি সায় দিয়ে বললাম, হ্যা আব্বা চিনি৷ অবশ্যই পরিচয় করিয়ে দিবো!” আম্মার দিকে তাকালাম৷ মুখটা সুবিধার দেখা যাচ্ছে না৷ কাজ হচ্ছে৷” তারপর নায়কের খচ্চর টাইপ বাবাটাকে দেখে আব্বা বলল,

-উনাকে তোমাদের খুব পছন্দ?” আম্মা জবাব দিলো না৷ খানিক বাদে নায়িকার ননদকে দেখা গেল৷ এবার আব্বা জোরেশোরে বলল,

-আগেরটা ক্যান্সেল৷ এইটাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি বুঝলি৷” আমি বললাম,
-ওহ আব্বা৷ এইটার সাথে তো আমার আরো ক্লোজ! সুবিধায় হবে৷”

আম্মাকে দেখে বোঝা গেল, উনি জ্বলছেন৷ আর আমার আপা আম্মাকে এসব ভুয়া বলে বোঝাতে লাগলো৷ যদিও আম্মা বুঝছে বলে মনে হচ্ছে না আমার৷” এবার আম্মা সিরিয়াল পাল্টে অন্য চ্যানেলের সিরিয়ালে গেল৷ এই সিরিয়ালের নায়িকা আসতেই আব্বা আমার কাঁধ চাপড়ে বলল,

-ওমা! এটা দেখি আরো সুন্দর৷ এই এর সাথে তোর পরিচয় আছে বাপ?” আমি হো হো করে হেসে বললাম, হ্যা আব্বা এর পেইজে আমি ফলোয়ার বুঝছোনা! কমেন্টে পরিচয় করাই দিবো নে৷ আর কোনটা কোনটা পছন্দ হয় দেখেন!” অবস্থা বেগতিক দেখা যাচ্ছে৷ আম্মা টিভির দিকে না তাকিয়ে আব্বার দিকে তাকিয়ে আছে৷ আব্বা সেটা খুব বুঝতে পারছে৷ টিভির দিকে তাকিয়ে আমার হাত ধরে বলল, আরগুলা কবে আসবে?” আমি বললাম, আসবে আসবে৷ সুন্দরগুলা পরে আসে!” অন্যদিকে আমার আপামণি আম্মাকে আমাদের চাপাবাজি সম্পর্কে বোঝাচ্ছে৷ আম্মা তবুও আব্বার দিকে তাকিয়ে আছে৷ দেখে মনে হচ্ছে, রাগে-ক্ষোভে মানুষটা কেঁদে দিবে৷” তারপরই আম্মা অঘটন ঘটিয়ে দিলো৷ আমার আপাকে জোরেশোরে একটা থাপ্পর মেরে রিপোর্টটা ছুড়ে ফেলে বলল,

-আজ থেকে এই ঘরে সিরিয়াল বন্ধ৷ যত্তসব ছ্যাচড়া লোকজন৷”

হনহন করে আম্মা রুম ত্যাগ করলো৷ আমি বোনের দিকে তাকালাম৷ গালে হাত দিয়ে আব্বার দিকে তাকায় আছে৷ আব্বার চোখ এখনো টিভি পর্দায়৷ আমি বোনকে বললাম, এজন্যই বলেছি আমাদের টিমে থাকতে৷” জবাবে সে, আমাকে পরে দেখে নিবে বলে রুম ছাড়লো৷ আব্বা বলল, দরজাটা বন্ধ কর৷”

অতঃপর দরজা বন্ধ করে, আব্বা আর আমি হো হো করে হাসছি৷ হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছি৷ খানিক বাদে বাদে আব্বা হাই ফাআভ দিচ্ছে৷ আবারো হাসিতে লুটিয়ে পরছে৷ এ যেন বিশ্বজয়ের হাসি৷ মিনিট পনেরো বাদে দরজার ওপাশ থেকে আম্মা বলল, হাসো হাসো৷ দুপুরের খাওয়াটা হোটেলেই গিলবে বাপ ব্যাটা মিলে৷” আমি অসহায় মুখে আব্বার দিকে তাকালাম৷ আব্বা আবারো হেসে বলল,

-অসুস্থ হলে তোর মা আমাকে ভালো করে ফেলবে৷ চিল মাই বয়৷ চিল৷” আমি আবারো গড়িয়ে গড়িয়ে হাসছি৷ টিভির রুম জয় করার হাসি৷” একেই বলে “নিন্জা টেকনিক”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত