আজ বাবা আমাদের সবাইকে বসার ঘরে ডাকলেন। উনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দ্বিতীয় বিবাহ করবেন, আমাদের সবার মতামত জানতে চাইলেন। আমার বড় ভাইয়া-ভাবি একসাথে আকাশ থেকে পড়ল, ভাবির চোখ প্রায় কঠোর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।দুলাভাই আর আপা রইল ধরণী দ্বিধা হওয়ার অপেক্ষায় !
ভাইয়া প্রায় চিৎকার করেই বলল, ‘আব্বা, এই বয়সে আবার বিয়ে? আপনি কি বলছেন বুঝে বলছেন তো?’ আম্মাকে আপনি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন?’ আপা রাগ সামলাতে না পেরে বলেই বসল, ‘আব্বা, এখন কি আপনার বিয়ে করার বয়স? চোখের সামনে তুলি বসা, ওর বিয়ের কথা চিন্তা না করে আপনি নিজের সুখের কথা ভাবছেন? আপনি এই বয়সে বিয়ে করলে ওর তো আর বিয়ে হবে না।’
আমি বাবার অপরাধী মুখটার দিকে তাকিয়ে। ভাইয়া বাবাকে কতখানি আঘাত করল তা বোঝার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা ওকে দেননি। আমার বাবা-মা’র ভালবাসার উদাহরণ টেনে অনেকেই কথা বলেন। বাবার রাজ্যে যত গল্প ছিল সবটুকু তিনি মা’কে শুনিয়েছেন। একবার দু’বার না, পান চিবিয়ে দুজন একই গল্প অসংখ্যবার করেছেন। এমন নির্ভেজাল সহজ ভালবাসা খুব কম স্বামীস্ত্রীর মধ্যে থাকে। এরকম একজন সঙ্গী হঠাৎ করে অসময়ে চলে গেলে অন্যজন কেমন অন্ধকারে দিশাহীন পাখির মত ডানা ঝাপটায় তা আমি বাবাকে দেখে বুঝেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বারান্দায় বসে আকাশের দিকে চেয়ে কাঁদতে দেখেছি। বাবার অশ্রুহীন কান্না দেখার চোখ ওদের কারোর নেই।
মা মারা যাওয়ার প্রায় আট বছর চলে, বড় ভাইয়া-ভাবি বাবার সাথেই থাকে। ছোট ভাইয়া কুয়েতে থাকে, মাঝে মাঝে আসতো, মা চলে যাওয়ার পর এখন প্রায় আর আসেই না। আপা থাকে বাসাবো তে, আজকে বাবার ডাকে এসেছে। নাহলে কমই এমুখো হয়।আমি, তুলি। একটা স্কুলে চাকরি করি আর সন্ধ্যায় এমবিএ করি। ভাবি বলল,’অ্যাই তুলি, তুমি চুপ করে আছ কেন? সারাক্ষণ আব্বা আব্বা কর, এখন দ্যাখো, শেষ বয়সে তোমাদের জন্য সৎ মা আনার বুদ্ধি করেছেন।’
সবকটা চোখ এখন আমার দিকে। আমি বললাম, ‘ভাবি, তোমার তো খুশি হওয়া উচিত। আব্বার বন্ধুরা আসলে তোমার আর কষ্ট করে চা বানাতে হবেনা। প্রায়ই ওনারা গল্প করতে আসেন, তোমার অনেক কষ্ট হয়ে যায়। তখন না উনিই করবেন। চায়ের সাথে ডায়াবেটিক বিস্কিটও দিতে পারবে’ আপা ধমক কষাল,’অ্যাই তুলি, তুই এইসব কি বলিস? উনি মানে কি? সব কি ঠিক হয়ে গেছে নাকি?’
বাবার হয়ে আমাকেই গলা ফাটাতে হচ্ছে,’আব্বা, যখন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে।খেয়াল করে দ্যাখো তো আমরা কতটুকু সময় বাবাকে দিতে পারি। এই বাড়িটা আব্বার, আমরা তার সাথে থাকি অথচ তার কাছে যখন কেউ দেখা করতে আসে ভাইয়া ভাবীর অসুবিধা হয়। আব্বা যেন জড় পদার্থ, দুটো খাবেন আর নিজের ঘরে মুখে কুলূপ এঁটে বসে থাকবেন। ভাইয়া তুই এই বাড়িতে থেকে শেষ কবে আব্বার সাথে বসে আড্ডা দিয়েছিস মনে আছে? সবার একদিন এইদিন আসবে ভাইয়া’ ভাইয়া ফুঁসে উঠল, ‘আমি কি বসে বাতাস খাই? আর দেখাশোনা করার জন্য বিয়ে করতে হবে কেন? আব্বার জন্য একটা লোক রেখে দিলেই তো হয়।’
খুব সত্যি, আমার বাবার ভরা সংসারে আমরা সবাই ব্যাস্ত। ভাইয়া অফিস নিয়ে, ভাবি বাচ্চাদের স্কুল, পড়াশুনা আর সংসার দেখাশোনায়, আমি চাকরি আর পড়াশুনা নিয়ে। এত মানুষের মাঝে শুধু বাবা থাকেন এক বুক হাহাকার নিয়ে। যত দিন গড়াচ্ছে ততই যেন বাবাকে সবাই বাতিলের খাতায় ফেলে দিচ্ছে। বুটের ডাল খেয়ে বাবার সেদিন একটু পেটটা নরম হয়েছিল। কাজে সাহায্যকারী মেয়েটা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘খালুজান,কি ছাইপাশ খাইয়া বাথরুম ভরাইয়া ফালাইছেন, এখন একটু বুইঝা খাইবেন তো।’ আমাকে দেখে চুপ হয়ে গেল। ভাবি ওকে কিছু বলল না ।তবে প্রায়ই কানে আসে, এই সংসারে আর বেশিদিন ভাবি থাকতে চায় না।এপর্যন্ত ঠিক ছিল, মানুষ রাগ করে কত কথাই তো বলে।যেদিন শুনলাম ছেলেমেয়েদের জন্য ভাইয়া নিজেদের রুমটা ছেড়ে দিয়ে ওরা বাবার রুমে থাকতে চায় আর বাবাকে আবদারের সুরে বলল বাচ্চাদের রুমে থাকতে, মাথা গরম গেল। মানুষ এত নির্লজ্জ স্বার্থপর কিভাবে হতে পারে!
মা আর বাবা তিল তিল করে এ বাড়িটা করেছেন। তাদের দুজনেররুমটা মা’র পছন্দে সাজিয়েছেন। ওখানে মা’র কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে! মা’র হাতের ছোঁয়া আছে এমন একটি জিনিসও বাবা সরাতে দেননি।ভাইয়া জেনে বুঝে যখন এমন কথা বলতে পেরেছে তখন বাসায় জায়গার অভাবে বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমেও ফেলে আসতে পারবে।
বছরখানেক ধরে আমিই বাবাকে বুঝিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছি। কবির চাচার এক বিধবা বোন আছে, দুই ছেলে যার যার কর্মক্ষেত্রে চলে যাওয়ায় একলাই থাকেন। সবচেয়ে বড় কথা ভদ্রমহিলা খুব মাতৃসুলভ, এত কষ্টের মাঝেও ওনার মুখে হাসির রেখা মিলিয়ে যায় নি। দুজনের বয়সে ফারাক সাত-আট বছরের মধ্যেই হবে। মায়ের শূন্যস্থান আমরা কেউ পূরণ করতে পারবেনা কিন্তু বাবাকে ভালবাসবে, দুজন-দুজনের কথা শুনে কুটকুট হাসবে, নিজেদের ছোট ছোট ব্যাপারগুলো যত্ন নিয়ে খেয়াল করবে এরকম একটা মানুষ পাশে থাকলে আমাদের অসুবিধা হওয়া উচিত না।
এতক্ষণ পর আমার বিজ্ঞ দুলাভাই হিসাবের কথা বলল, ‘তুলি, তুমি ছোট মানুষ । অনেক বিষয় না ভেবেই কথা বলছ। তাই তুমি আম্মার জায়গায় আর জনকে বসাতে চাইছ। তাছাড়া, আব্বা বিয়ে করলে সম্পত্তি কিন্তু অন্যজনের কাছে চলে যাবে। আব্বা, আপনি কি এই বিষয়ে ভেবেছেন?’
কষ্টে বাবার চোখে পানি চলে এলো, আঁধারে ছেয়ে যাওয়া মুখটা তুলে বলল ,’হুম, আমি সব ঠিক করে যাব। তোমরা কেউ ঠকবে না। আর তুলি ওর মায়ের জায়গায় কাউকে বসাচ্ছে না, কেউ কি চাইলেই কারো জায়গা নিতে পারে, আসাদ? তোমরা খাওয়া দাওয়া করে যেও’ বলেই বাবা তার রুমে চলে গেলেন আর আমি সবার চোখের আগুনে ভস্ম হতে থাকলাম। বাবার বিয়েটা অনাড়ম্বর ভাবেই হল। মনে মনে ঠিক করেছি ওকে আমি বউমনি বলে ডাকব।
বিয়ের আগেই ভাড়াটে বিদায় করে তিন-তলায় দুটা ফ্ল্যাট খালি করে বাবা একটা ভাইয়াকে আর একটা আপাকে লিখে দিলেন। ওরা তড়িঘড়ি করে উঠে গেল, আপাও বাসাবো থেকে এসে এখানে উঠল, পাছে হাতে আসা ধন অন্যের দখলে চলে যায়। ছোট ভাইয়া এলে চারতলায় একটা ফ্ল্যাট পাবে। বাসা ভাড়া গুলো দিয়েই বাবা নিজের খরচ চালান, ছেলেদের কাছে তার হাত পাততে হয়না। বাবার বুকের উপর দাঁড়িয়ে সম্পত্তি বুঝে নিতে ওদের একটুও বাধল না। আমি কিছু নিতে চাইলাম না দেখে ওরা আর কথা বাড়াল না। মনে মনে আমাকে গাধার বাচ্চা বলছে এটা নিশ্চিত। আমি জানি বাবার কিছু হয়ে গেলে ওরা বউমনিকে ঘাড় ধরে বের করে দেবে, তাই বাবাকে বলেছি বউমনির নামে কিছু লেখাপড়া করে রাখতে। আমার নতুন মাকে বললাম, তোমাকে আমি আম্মা না ডেকে যদি বউমনি ডাকি তুমি মন খারাপ করবে?’
উনি মিষ্টি হেসে বললেন, ‘বউমনি” কি মিষ্টি নাম, একদম তোমার মত! তুমি হলে তোমার বাবার মা, আর আজ থেকে আমারও । মন খারাপ করব কেন বোকা মেয়ে।’ ছ’মাসে কেউ এ বাড়িতে এলো না। তবে বাবা-বউমনির মাঝে একটু একটু করে নিজেদের দূরত্ব কমল। এখন বাবা আবার তার বন্ধুদের বাসায় যায়।বাবার বন্ধুরা আড্ডা দিতে এলে তিনি আর অস্বস্তিতে কুঁকড়ে যাননা। সেদিন বিকেলে বাসায় ফিরে দেখি বাবা কুটুর কুটুর গল্প করছে আর বউমনি সেই গল্প শুনে শরীর কাঁপিয়ে হাসছে। ওদের দেখতে আমার ভালই লাগে। আজ বউমনির হাতে মা’র লাল শালটা দেখে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।কিছু বললাম না, দেখলাম বাবা সোফায় ঘুমিয়ে পরেছিলেন, শালটা দিয়ে বাবাকে খুব যত্ন করে ঢেকে দিলেন। ধীর পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।মার কথা খুব মনে পরছে। অযথাই কান্না পাচ্ছে।
একমাস পর আমার বিয়ে। মনটা ভাল নেই, বুকের ভেতর নিঃশ্বাস চেপে আছে। বাবাকে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। বারান্দায় আমার পেছনে কখন বউমনি এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। কাছে এসে আলতো করে আমার হাত ধরে বাবার রুমে নিয়ে গেলেন। তারপর নিজের গহনা গুলো আর হাল্কা বেগুনি রঙের একটা কাতান আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এগুলো পরে নাও মা, এগুলো এখন থেকে তোমার। নিলয় আসছে তোমাকে নিয়ে বাইরে খেতে যেতে চায়। আমি আসতে বলেছি’। আমি আঁতকে উঠলাম, ‘না না, গহনা লাগবে না। এগুলো তোমার বিপদের দিনের সঙ্গী, বউমনি। ’
আমাকে কাছে টেনে বলল, ‘তোমার মত মেয়ে যার আছে তার আবার বিপদ কি? তোমার বাবাকে বলে লিখিয়ে নিয়েছি আমাদের দুজনের মৃত্যুর পরে তিনটা ফ্ল্যাট বাদে সম্পূর্ণ বাড়িটা তোমার নামে হয়ে যাবে। কেউ ভাগ বসাতে পারবে না।’ আমার বাড়ি লাগবে না বউমনি, তুমি আমার বাবাকে দেখে রেখো। মানুষটা খুব নরম, একটুতেই কষ্ট পায়। এই বয়সে মানুষ টাকা পয়সা চায় না, সময় চায়, ভালবাসা চায়। আমার নিজের ভাইবোনই বাবার অনুভূতি বোঝে না। তোমাকে আমি অনেক ভরসা করে পছন্দ করেছি। আমার গলা ধরে গেল আর বেশি কিছু বলতে পারলাম না।
আমি জানি আমি ভুল করিনি।আমার বিশ্বাস বউমনি আর বাবা দুজন-দুজনের শেষ বিকেলের আলো হয়ে থাকবে।সমাজ যেন ওদের নিজেদের মত করে ভাল থাকতে দেয়।বউমনি আমাকে শক্ত করে বুকের ভেতর চেপে ধরল,ওরও নিশ্চয়ই অনেক চাপা কষ্ট আছে, বাবা যেন ওর সব ক্ষতগুলো মিলিয়ে দেয়।আমরা দুজনই নিঃশব্দে কাঁদছি, বাঁধ ভাঙ্গা কান্না। অনেক বছরের জমানো অশ্রু, এ সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না।