বিয়ের পরদিন,
বাসরঘরে কবির আর রুবি বসে আছে। দু’জনই প্রায় অপরিচিত।
ছেলে মেয়ে দেখাদেখির সময় একবার মাত্র দেখা হয়েছে। লজ্জায় ভালোভাবে কবিরের মুখও দেখেনি রুবি, আকদের এক সপ্তাহ পরই বিয়ের অনুষ্টান।
ফোনেও যোগাযোগ হয়নি তাদের, ফোন অতো এভেলএবেল ছিলোনা তখন। বিয়ের দিন দু’জনকে একসাথে একরুমে রাখা হয়নি। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো, রুমও নাকি গোছানো হয়নি, তাই। গাড়িতে পাশে বসা রুবি’র সাথে সামান্যই কথা হয় কবিরের। পেছনের সিটে দুই দুলাভাই দারোয়ান হয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন, অদম্য ইচ্ছে দমন করে প্রায় চুপচাপই পথ অতিক্রম করে তারা। নইলে পরবর্তীতে দেখিয়ে দিতে পারে, শ্যালক সাহেব কি পরিমাণ নির্লজ্জ!
আজ তাদের বিশেষ রাত।
কবির বলে,
“আজ থেকে আমার সবকিছুই তোমার, জানো তো?”
রুবি জবাব দেয়, ‘হুম।”
“আচ্ছা, কিছু চাও আমার কাছে। তোমাকে তো কিছু গিফট দেয়া দরকার।”
“অনেক কিছুই তো দিয়েছেন!” রুবি বলে।
“ধ্যাৎ, ওসব তো ধরা বাঁধা জিনিস।
আজ আমাদের বিশেষ একটি রাত, দু’জন দু’জনকে এই প্রথম চিনবো, জানবো। একটু তো স্মরণীয় করে রাখা দরকার। কি বলো?”
এই বলে কবির তার হাতের এক ভরি ওজনের সুন্দর ব্রেসলেট টা রুপিকে পরিয়ে দেয়।
“আপনার হাত তো খালি হয়ে গেলো!
এখন আমি আপনাকে কি দিবো? আমার কাছে তো দেয়ার মতো কিছুই নেই, সব মেয়েলি অর্নামেন্ট!”
“তোমাকে কিছুই দিতে হবেনা, আমাকে একটু ভালোবাসলেই হবে। আর তুমি তো উপার্জন করোনা, কিছু দেয়ার প্রশ্নই আসেনা। তাইনা? ”
“হুম।”
“কি, ভালোবাসবে তো?” কবির প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকে।
রুবি লাজুক হাসে।
পরদিন রুবি’র বাপের বাড়ি’র অনেকে তাকে দেখতে আসে। সুন্দর ব্রেসলেট দেখে খুশি হয়। বুঝে নেয়, মেয়ে সুখে আছে স্বামীর ভালোবাসায়।
সারাদিন ব্যস্ততায় শ্বাশুড়ী রুবিকে তেমন খেয়াল করেন না। সন্ধ্যায় রুবি’র হাতে ছেলের হাতের দামি ব্রেসলেট দেখে ওনার ভালো লাগেনা। একরাতেই এতো আপন হয়ে গেলো পরের এই মেয়েটি ! উনার বুকটা ভারী হয়ে থাকে।
“এটা কোত্থেকে ?” জানতে চান তিনি।
“আপনার ছেলে দিয়েছেন..”
লজ্জানত হয়ে রুবি জবাব দেয় ।
“হুম ,আচ্ছা।”
ওনার মন কচকচ করতেই থাকে অজানা এক ব্যথায়।
রাতে ছেলেকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করেন,
“তোর হাত খালি কেন! ব্রেসলেট কই?”
“আছে, খুলে রেখেছি।”
কবির লজ্জায় বলতে পারেনা, ওটা সে রুবিকে দিয়েছে।
“তোর পরতে ভালো না লাগলে, ওটা আমাকে দিস। আমি একটি গয়না বানাতে দিবো।”
“আচ্ছা মা, দেবো।”
ছেলের জবাবে মা এবার মনে শান্তি পান, না ছেলে এখনো পর হয়নি!
আর কবির দু:শ্চিন্তায় ভূগে, কিভাবে রুবিকে তা ফেরত দিতে বলবে! তার সম্পর্কে কি মনে করবে নতুন আসা এই মেয়েটি!
শুতে যায় সবাই।
কবির রুবিও।
কবির বলে,
“রুবি একটা কথা বলবো, প্লিজ রাগ করোনা তুমি। ”
“জ্বি বলেন, রাগ করবোনা। ”
“আগে তুমি করে বলো, আপনি সম্বোধন পর পর লাগে।” কবির সহজ হতে চায়।
“আচ্ছা বলবো।”
“এখনই বলো।”
রুবি হেসে বলে, “তোমার কথাটা বলো।”
“মা ব্রেসলেট টা দিয়ে গয়না বানাতে চেয়েছেন। ওটা আমি একইরকম আরেকটি তোমার জন্য কিনে আনবো। আসলে উনি জানেন না , ওটা আমি তোমাকে দিয়েছি। আমিও লজ্জায় বলতে পারিনি।”
এক নি:শ্বাসে কবির সব বলে ফেলে।
রুবি অবাক হয়। কারণ, সে শ্বাশুড়ীকে ইতিমধ্যেই তা বলেছে। কিন্তু সেকথা কবিরকে বলেনা। একদিন হয়েছে মাত্র এই ঘরে এসেছে। এখন যদি সে শ্বাশুড়ীর কথাটা বলে দেয় , তাহলে রুবি সম্পর্কে কবিরের বাজে ধারণা হতে পারে। মায়ের প্রতিও বিরুপ মনোভাবও আসতে পারে।
“না, না, ছিঃ কি ভাববো! আসলে এটা আমার হাতে বড় হয়েছে। মানাচ্ছিল না। তুমি রাগ করবে বলেই পরে আছি। আর বানিয়ে দিতে হবেনা। এতো গয়না দিয়ে কি করবো আমি !”
রুবি হাত থেকে খুলে দেয়।
“আসলে মা হাতে দেখেনি তো, হারিয়ে ফেলবো তাই!” কৈফিয়তের সুরে বলে যেন সে।
“না, ঠিক আছে তো।”
কবিরের মনটাই খারাপ হয়ে যায়। ভালোবেসে দেয়া জিনিষটা চেয়ে নিতে হলো!
কবির তার গলায় পরা চেইনটা খুলে রুবির গলায় পরিয়ে দেয়।
“হায় হায় কি করেন! আমার গলায় একটা আছে তো।”
“তোমার থাক , এটা আমার পক্ষ হতে।”
রুবি মনে মনে হাসে আর মনে মনেই বলে, দেখো ,এটাও তোমার মায়ের চোখে পড়ে কিনা!
কিন্তু মুখে ধন্যবাদ জানায়।
কয়েকদিনপর ঠিকই তিনি গলার চেইন খেয়াল করেন।
“এটা কবিরের চেইন না?”
“জ্বি।” রুবি জবাব দেয়।
‘অহ..”
আর কিছু বলেন না তিনি ।
দশবছর পর।
বউ শ্বাশুড়ী আর অপরিচিত নেই। দুইজনই দু’জনের সুখ দু:খে পাশে থেকেছে।
একদিন শাশুড়ি রুবিকে কাছে ডাকেন,
“অ বউ , এদিকে আয়।”
“কি মা?”
“আয়, এটা গলায় পরে দেখতো, কেমন লাগে দেখি।”
রুবিকে তিনি নিজ হাতেই একটি স্বর্ণালংকার পরিয়ে দেন।
“বাহ্ , তোকে তো বেশ মানিয়েছে! এটা গলায় পরে থাক। কবিরের ব্রেসলেট টা দিয়ে বানিয়েছিলাম।”
“মা, এটা কিন্তু আপনাকে অনেক সুন্দর লাগে। আপনি রেখে দিন তো।”
“না, তুই রাখ। ভালোবেসে কিছু দিলে ফেরত দিতে হয়না, বুঝলি?”
রুবি আর তার শ্বাশুড়ী দুই মহিলা একে অপরের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় নত হয়।