সম্পর্ক ছিন্ন করার আজ চার বছর পূর্ণ হলো। একেবারে কাটায় কাটায় মিলে পূর্ণ। খুব যত্ন করেই প্রত্যেকটা মুহূর্ত অনুভব করেছি এই চার বছরের।কোনো ফাঁকি নেই।কোনো আলসেমি বা কোনো প্রকার কষ্টের অজুহাতে ভুলতে যাইনি তাকে। ভুল কে কখনো ভুলতে নেই।
হাতব্যাগ টা নিয়ে আয়নায় আরেকবার চোখ বুলালাম। ইদানিং রাতের পর রাত জেগে আছি।চোখের নিচে কড়া ডার্ক সার্কেল পুরো চোখকেই ঝাপসা করে রেখেছে।বিচ্ছিরি লাগছে। কড়া ঘুমের ওষুধ কাজে দিচ্ছেনা,প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে বিরক্তি আসছে।হ্যালুসিনেশন এ ভুগছি প্রায় ই যেটা আমি নিজেই টের পাচ্ছি ভালো। সামান্য সেলারির জব,আমার অনিয়মের দিন,ছুটে যেতে যেতেও যাচ্ছেনা।অথচ আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই যে এরপর কি? ঘরে অসুস্থ বাবা,ছোট ছোট দুটো ভাই বোনের দায়িত্ব,আমার প্রস্তর বিষাদ। এসব নিয়ে কি হবে? চারটা বছর তো কেটেছে কিছু বাহানায়,শান্তনায়,বা ভুলে যাওয়ার অভিনয়ে।তবে আজ কেন?
চারটা বছরে যাকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলাম নিজের যাবতীয় থেকে,তাকে মাঝরাস্তার ব্যস্ত ভীড়ে এক পলক দেখেই কেন এমন ভাঙচুর? কেন? আমি নিরুত্তর হয়ে বসে থাকি।সে আমার সামনে আসে,কথা বলে, অজুহাত দেয়,কাঁদায়। আমি কেঁদে কেঁদেই কতক রাত্রির বুকে ভোর নামাই,সে নেই কোথাও নাই সে তখন।এ কেমন প্রতিশোধ? তাকে ভুলতে না পারার?
এইতো সেদিন ঘর অন্ধকার করে ঘুমোলাম।অথচ হুশ এলো দিন তিনেক পর। ছোট ভাইবোন দুটোর সে কি কান্না।অথচ আমি নির্বিকার হেসে ফেললাম।বেঁচে আছি তো।কেউ কি কারো বিষাদে মরে যায়? যায় কি? হয়তো তার বেঁচে থাকার রসদ ফুরিয়ে যায়,তীব্র যে একটা আশা থাকে সেটা নিভে যায়,নতুন করে নিজেকে সাজাতে ভুলে যায়,হাজারটা প্রেম বুকের কাছে এসে লুটিপুটি খায়, তাচ্ছিল্য পায়,ইচ্ছে জেগে উঠে বলেনা চল আরেকবার,প্লিজ আরেকবার শুরু কর।এভাবেই তো দিন যায়,মরে তো যায়না। এইবার নিজেকে শক্ত করলাম খুব।
ডাক্তারের চেম্বারে এসে বসে আছি এক ঘন্টা যাবত।প্রতিটি রোগীর জন্য নির্ধারিত সময় শেষ হলে একেক করে বের হচ্ছে।রাতুল আমার হাত চেপে বসে আছে। চোখ মুখে কিঞ্চিৎ চিন্তার রেখা।আমি মাঝেমধ্যে বুঝে উঠতে পারিনা কার জন্য মানুষ এর এরকম চিন্তিত হওয়া মানানসই। আমি তো রাতুলের সেরকম কেউ নই,হ্যাঁ, সে আমার বন্ধু হতে পেরেছে খানিক টা।সে আমাকে চায় আমি জানি।অনৈতিক ইচ্ছা বলুন তো? কে কাকে কবে কথা দিয়ে কথা রেখেছিলো? চার বছর আগেও একজন রাখেনি,রাতুল ও রাখেনি।সে শুধু বন্ধুত্ব চেয়েছিলো,অথচ পাড়ি দিতে চাচ্ছে তার ও অধিক।
পাতলা ফ্রেমের চশমা, তার ওপাশে দুটো চিরচেনা চোখ।নির্বাক,নিষ্পলক, জিজ্ঞাসু হয়ে তাকিয়ে। কি অদ্ভুত! হ্যালুসিনেট হচ্ছে নাকি আবার ও? ঘোর কাটলো রাতুলের শব্দে। পরিচয় করিয়ে দেয়ার আগেই বুঝলাম ইনিই সেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। মনে মনে হাসছি আর ভাবছি কোনো অপরাধী কি তার কৃতকর্মের জন্য নিজেকে শাস্তি দেয়? সর্বোচ্চ পালিয়ে বেড়ায়।কিন্তু এ তো এমন হলো যে হাতেনাতে ধরা পড়া।রাতুল বাইরে বসেছে,ঘড়ির কাটা খট খট করে ঘুরছে,ডাক্তার আবিদের ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে।আমরা নিশ্চুপ, আমাদের কোনো কথা বলার ব্যাকরণ নাই,আমরা শুধু কিছু অনুভূতির তিক্ততা জানান দিচ্ছি নিরবে।
“কেমন আছো?
” এইতো বেশ,দিব্যি কাটছে।
“এখানে আশা করিনি তোমায়,এভাবে তাও।
” আমিও করিনি,জানলে তোমার গ্লানি বাড়াতে চাইতাম না।রাতুল জোর করায়..
“বিয়ে করেছো কবে?
” বিয়ে?
“তোমার হাজবেন্ড নিশ্চয়ই?
হাসলাম।কিছু মানুষ এর এই এক সমস্যা,অযৌক্তিক ব্যাপারে কৌতুহল।
” হাসছো। কি হয়েছে তোমার?
“রোগ।
” হু,সেটা কি? কেমন সমস্যা হচ্ছে?
“তুমি।তুমি বড্ড বেশি সমস্যা করছো ইদানিং। আমি ঘুমাতে পারিনা,শান্তি মিলেনা কিছুতে।তুমি আমার পিছু ছাড়ছো না কেন আবিদ? আমাকে আগাতে দিচ্ছোনা।
” পানি খাবে?
“না
” কি হচ্ছে প্লিজ বলো।তুমি অনেক শক্ত মনের আমি জানি,এতদিন পর কেন এসব?
“চার বছর আবিদ,চার!
” তুমি জানতে সব, আমাকে সব ছাড়তে হয়েছে আজকের এই আমি হয়ে উঠতে। আমি কোনো পিছুটান রাখতে চাইনি তাই।
“পিছুটান টা পেছনেই ছাড়তে হয় আবিদ,সামনে এলেই কুকড়ে যাওয়ার ভয়।তুমি কেন বারবার আমার কাছে আসো?
” শান্ত হও প্লিজ। তোমার কিছুই হয়নি,বাড়তি ডিপ্রেশনে ডুবে আছো কেন এভাবে? বেরিয়ে এসো সব ঝেড়ে।
“চার বছর আগেই তো ঝেড়েছি, সব ক্ষত কি দাগ মিলিয়ে আসে?
” আমার কথা শুনো..
“আমাকে আপনি করে বলুন,একজন রোগীর জন্য এটাই সম্মানীয়।
আবিদের মলিন চেহারা,তার হিসেবের গন্ডগোল। যারা প্রিয়জনের হাত প্রয়োজনের অজুহাতে ছেড়ে যায় মাঝরাস্তায়,তারা কি কখনো ভাবে একবার,পিছিয়ে পড়া অতীত কতদূর এগিয়েছে? নাকি এখনো সেই ঠায় দাঁড়িয়ে? তারা কি অপরাধের গ্লানিতে জর্জরিত হয়েছে? আবিদ ও হয়তো ভাবেনি আমাকে এভাবেই দেখবে আবার।
আমাদের কথা শেষ, আর ও বার দুয়েক রুটিনমাফিক দেখা করতে বলা হলো।
আমার নিজেকে বড় হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে কতক বদ্ধ প্রশ্নের জবাব মিলে গেছে,যে প্রশ্নউত্তর গুলো এত বছর বুকে কাটছে কুট কুট করে।আজ এক সাক্ষাৎ এ সব ঢেউ চেপে আসা জলের মতন ধুয়ে গেলো।বিচ্ছেদ ও কি একেকটা অসমাপ্ত চিঠির মতোই? সব নিংড়ে দেয়ার পরেও কিছু কথা থেকে যায়।যেনো অবশেষে পুনশ্চঃ হওয়ার জন্যই। তবে কি আমার এখনো সেটুক বাকি রয়ে গেলো, আমার ও কি তবে সেটুক লিখাই লাগবে।
বেরিয়ে আসতেই রাতুলের আগ্রহী চোখ মুখ।কি বললেন ডাক্তার? কিছুই না,আমি ভালো ই আছি।তোমাদের ই যত আদিখ্যেতা।
খুব সন্তুষ্ট হয়নি রাতুল,প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে দেখলো কিছু টেস্ট দেয়া।আমাকে এবার সেগুলোর ঝামেলা পোহাতে হবে।অথচ প্রতিদিন আমার মতই কতটা হৃদয়ে ভূমিধস নামছে,কারা করছে সেগুলোর তদারকি? প্রতিদিন কত প্রাচীন ব্যাথার নতুন করে দেখাসাক্ষাৎ চলে,তোলপাড় চলে,কারা রাখছে সেসবের খোঁজ?
এতগুলো রিপোর্ট দেখে রাতুলের চিন্তা আরও বেড়েছে।সে আবার আমাকে আবিদের কাছে নিবেই নিবে।আমাকে তার সুস্থই করা চাই।
প্রায়ই মন নারাজ করে পাশে বসে বসেই এসব বলে।আমি হেসে ফেলি। মানুষ বড় অদ্ভুত আশাবাদী। যা পাওয়ার নয় তার জন্যই হাপিত্যেশ করে করে সুখ নষ্ট করে।
“রাতুল,তুই আমাকে মানুষ ভাবিস?
” অবশ্যই
“ভালোবাসিস খুব তাইনা?কথা ছিলো পাশে থাকার।
”
“আমার একটা অতীত আছে জানিস তুই।
” জানি
“সেই অতীত কতটা তরতাজা এখনো, কতটা দগদগে ক্ষত সেখানে তা জানিস না নিশ্চয়ই। শুনবি?
” প্লিজ না।
“শুন একবার তুই
” কি শুনাবি আর?
“আমার…
” আমি শুনেছি সব।সেই লোকটা ওই ডাক্তার ই। অথচ দেখ সে চারবছরে কতটা সফল।আর তুই?
“সবাই কি পা বাড়াতে পারে আবার? সবার অনুভূতির দেয়াল কি একই রকম শক্তপোক্ত হয়?
” তুই একটা বার চেষ্টা কর, আমি সব গুছিয়ে নিবো দেখিস।একবার শুধু।
“আমি হাজারবার এগিয়ে পিছিয়ে পড়েছি রাতুল।আমার আর শক্তি কই।আমি হাল ছেড়ে দেয়ার দলে,জীবন আমাকে যতক্ষণ নাড়াতে পারে, আমারে দেখতে চাই শুধু।
” তুই আমার জন্য পারিস না একবার উঠে দাড়াতে?
“অপেক্ষা বড় ছোঁয়াছে রাতুল,এতে হাত বাড়াস নে।
” আমি সেই কবেই বাড়িয়েছি নিজেকে,বল আর কত অপেক্ষা? আমি ঠিক দাড়িয়ে থাকবো।
“পৃথিবীতে কেউ কারো জন্য দাড়িয়ে থাকেনা রাতুল যতক্ষণ না তার নতুন পথ জানা হয়।
” তবে তুই কেন আছিস তাহলে?আমি তো একটা পথ হতেই এসেছিলাম একদিন।
“আমি? এ প্রশ্নের উত্তর তো জানা হয়নি।জানলে বলবো।
রাতুলকে পিছনে ফেলে হাটছি।যে প্রেম রক্তে মিশে যায় সে প্রেমে বিষ ধরলেও তাতে নতুন কোন ওষুধী প্রয়োগ বাতুলতা। আমি কখনো রাতুল কে ওষুধী বানাতে চাইনা।সে একটা স্বতন্ত্র মায়া,তাকে আমি স্বতন্ত্রই রাখলাম।সে একটা স্বতন্ত্র পরিষ্কার জীবন,যেখানে দম বন্ধ হয়ে আসলে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়া যায়।
: স্বপ্ন দেখেন?
– হু,,জেগে জেগে।
:লাইফের মটো কি?
– একজন ভীষণ রকম প্রেমিকা হওয়া।
: উপযুক্ত কারণ?
– অহেতুকতা বলা যায়।
: শেষ কবে ভালোলাগা পেয়েছিলেন?
– প্রেমিকের প্রথম চুমুতে।
আবিদ সাহেব অবাক নজরে তাকালেন।তিনি হয়তো এমন টা শুনতে চান নি।অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।তাকে অস্বস্তি তে দেখার অভ্যেস আমার নতুন নয়। আচ্ছা তিনি কি প্রশ্ন করবেন,প্রেমিকের নাম?সাহস আছে?
চশমাটা নাকের আরো উপরে ঠেলে আবার বললেন,
:কষ্ট পান খুব অল্পতেই?
:চার বছর একটা সম্পর্কের স্মৃতি আগলে রাখা, এটা কে অল্প না বেশি বলে জানা নেই।
:অযৌক্তিক বৈকি।
:অসম্ভব নয়।
: শেষ কবে এরকম অযৌক্তিক কষ্ট পেলেন?
– শেষ? উমম যেদিন বাবার চাকরি টা চলে গেলো।
আবিদ সাহেব কয়েক মুহুর্ত চুপ থাকলেন।তিনি নিশ্চয় আমার মত ভাবলেশহীন নয়।তবুও তিনি ভাবনায় পড়ে গেলেন। তার নির্মল চোখ জিজ্ঞাসু হয়ে তাকিয়ে।
: জীবন সঙী খুঁজেননি?
– ইচ্ছে হয়নি।
-কেনো।
:প্রয়োজন এর অজুহাত পাইনি হয়তো।
আবিদ সাহেব কলম টা রেখে বড় সড় রুমটাতে দুটা চক্কর দিলেন।উত্তরের জানালার পাতলা পর্দাকে জোর করে সরিয়ে কিছু অনাহুত বাতাস আমার শরীর ছুঁয়েছে।মস্তিস্
কের এক কোণে তালাবন্ধি অতীত আমাকে বারংবার সাবধান করছে…
: আচ্ছা আপ্নি কবে সত্যিকার হেসেছিলেন?
– যেদিন বুঝেছিলাম আমি একটা জঞ্জাল সময়ের কাছে।
:কাঁদেন এখনো?
– তখন ই সব কান্না নিলাম হয়েছে।ভালোবাসা টা দাফন হবার দিন থেকে আর হয়ে উঠেনি।
ডাক্তার সাহেব নড়েছড়ে বসলেন এবার।অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন তিনি।চোখে তার অপরাধবোধের পীড়া।ডাক্তার দের নিশ্চয় এমন মানায় না।
: এমন টা কখনো আশা করিনি।
– স্বাভাবিক নয় কি?
: অভিশাপ বা অভিযোগ জমা হয়নি?
– মোটেই না।জানি,মুক্তি সবার ই প্রাপ্য।
:আপ্নি নিশ্চয় এটাও জানেন আপ্নি মোটামুটি একজন মানসিক রোগী?
– জ্বি জানি
: স্বাভাবিক হতে চান না?
– এর থেকে সুখের জীবন হবেনা হয়তো সেটা।
: ইচ্ছে করেই ভুলিয়ে রাখছেন?
-বাধ্য আমি।
আবিদ সাহেব প্রশ্নহীন।আমার জন্য বরাদ্দ সময় অতিক্রমের পূর্বেই তার প্রশ্ন ফুরিয়ে এসেছে।তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেও বর্তমানের আমিকে চিনতে পারছেন না।তিনি বুঝে গেছেন অতীত কে ধরে রাখার যথার্থ কারণ বা পন্থা কিছুই তার হাতে নেই।
– আমি আসি তবে?
: অহ,,হু।ভালো থাকুন তবে।
আমি উঠলাম।আবিদ সাহেব তাকিয়ে আছেন।তার চেম্বারে এই প্রথম না আমি।তৃতীয় বার,হয়তো এটাই শেষ।বিলেত ফেরত এই লোক বড্ড অচেনা আমার কাছে।আমি চিনাতে চাইনা তাকে আমার আমিকে।তিনি তৃতীয় বারের মত আমার রিপোর্ট হাতে বসে আছেন।আর এই প্রথম বার তিনি আমাকে কোন উপদেশ দেন নি।তাকে অন্যমনস্ক লাগছে ভীষন।অপরাধবোধ তাকে হয়তো প্রশ্নবন্ধি করছে।কিছু মানুষ কে দ্বিধাগ্রস্থ দেখতে ভালো লাগে আমার।
-আবিদ সাহেব
:হু
– আপনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তাইনা?
: হু।
– মনের খেয়াল রাখবেন আজ থেকে।আর হ্যা,আমি ভালো থাকবো এবার।
দ্রুত চলতে চেয়েও পারছিনা।সস্তা জুতোজোড়া ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম।
পেছনে আমার প্রশস্ত জেগে ওঠা অতীত,পাশে একজন রাতুল,সামনে বিচ্ছিন্ন জীবন।হাটতে হবে আমাকে।ছেড়া জুতোটা সারাতে হবে আবার।এখনো অনেক পথ বাকি।