নিজের মেয়ের ১১ তম জন্মদিনে জানতে পারলাম এত বছর ধরে যাকে আমি নিজের মেয়ে ভেবে এসেছি সে আসলে আমার মেয়ে না। সে এক ধর্ষণের ফসল। স্ত্রীর মুখে কথাটা শুনে আমি কয়েক মুহূর্ত তব্দা খেয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হলো না। মাথায় যেন আকাশ আছরে পড়লো। আমি চুপচাপ হাসপাতালের কেভিনে আমার স্ত্রীকে রেখেই বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমার স্ত্রীর নাম শেফা। সে মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত। সে ক্যানসারে আক্রান্ত না হলে হয়তো তার জীবনের এই কঠিন সত্যটা আমার কখনই জানা হতো না। আমার নাম সাফিন। ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় ১২ বছরেরও বেশি আগের। আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমাদের পরিবার একেবারে উচ্চবিত্ত না হলেও আমাদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো ছিল। আমি এম.এ পাস করি । আমার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছিল। বাবা মা আমাকে বিয়ে করানোর জন্য প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো পাত্রীই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিল না। এক চোখ কানা একটা ছেলেকে কোন মেয়েই বা বিয়ে করতে চাইবে? ছোট বেলায় এক দুর্ঘটনায় আমার এক চোখের দৃষ্টি শক্তি আমি হারিয়ে ফেলি। তারপরেও বাবা মায়ের অনুরোধে বা মন রাখতে একের পর এক পাত্রীর বাসা ঘুরতেই থাকি। সবাই আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত এমন না। তবে যে মেয়েকেই আমি দেখতে যেতাম তার চোখ , মুখের দিকে একবার তাকালে আমার মনে হতো কেউ আমার পিঠে জোরে একটা চাবুক মারলো। তাদের চোখে আমার জন্য ভয়, করুণা, ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেতাম না। মাঝেমধ্যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছা করতো নিজের আরেকটা চোখও গেলে দেই।
এইভাবেই দিন কাটছিল। এর মধ্যেই একদিন বাবা-মা জোর করলো একটা পাত্রী দেখতে যেতেই হবে। সেদিন যে মেয়েটাকে দেখতে গিয়েছিলাম সেই আমার স্ত্রী শেফা। শেফাকে প্রথমে দেখে কয়েক মুহূর্ত আমি তার থেকে চোখই সড়াতে পারলাম না। শ্যাম বর্ণের একটা মেয়ে যে এতটা সুন্দর হতে পারে তা আমার কাছে কল্পনার অতীত ছিল। মাথা ভর্তি এক ঝাঁকড়া চুল।
কী সুন্দর চোখ জোড়া।
পাত্রী পক্ষ হয়তো আমার এই চোখের খুত জানতো না। বাবা মায়ের চাপাচাপিতেই হয়তো ঘটক তাদের থেকে এই কথাটা লুকিয়ে ছিল। পাত্রী পক্ষের অনেকেই ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ঘটকের দিকে তাকাল। হয়তো মনে মনে বলছে, পাত্র পক্ষ যেয়ে নিক। তারপর বেটা তোকে দেখাচ্ছি মজা। পাত্রের এত বড় একটা ত্রুটি তুই আমাদের বলবি না? শেফাও কী অদ্ভুত ভীত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে ছিল! কিসের এত ভয়? একটা এক চোখ কানা ছেলের বউ হয়ে যাওয়ার ভয়? কেন, যাদের এক চোখ নেই, বা অন্ধ তারা কী মানুষ না? এদের ভয় পাওয়ার কী আছে? মনে মনেই আওড়ালাম কথাগুলো। যদিও পাত্রী দেখতে গিয়ে এইরোকম অভিজ্ঞতা আমার কাছে নতুন না। বাকি সম্বন্ধ গুলোর মতো এই সম্বন্ধটাও বেশি দূর গেল না। আমি বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে প্রায় ঝেড়েই ফেলেছিলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে শেফাকে দেখতে যাওয়ার প্রায় মাস খানেক পর সেই ঘটক আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। তিনি যা বলযেন, তা শুনে নিজের অজান্তেই আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। মেয়েটা এবং তার পরিবার নাকি আমার সাথে মেয়েটার বিয়েতে রাজি। আমি পুরোই স্তম্ভিত। এত রূপবতী একটা মেয়ে পৃথিবীতে এত পুরুষ থাকতে আমাকে কেন বিয়ে করতে যাবে। সে তো চাইলেই রাজপুত্রের মতো কাউকে বিয়ে করতে পারে। যার অন্তত দুটি সুন্দর চোখ আছে। যে চোখের দিকে তাকিয়ে অন্য ভুবনে হারিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু তাহলে আমি কেন? আমার সেই অশ্রু, অনুভূতি , আবেগকে ব্যাখ্যা করার মতো ক্ষমতা করুণাময় আমায় দেননি।
মেয়ে পক্ষও চাইছিল দ্রুত যাতে বিয়েটা হয়ে যায়। আর আমার বাবা-মায়েরতো বিস্ময় আর আনন্দের কোনো সীমা নেই। বেশ আয়োজন করেই বিয়ে হয় আমাদের।
বাসরঘরে আমি শেফাকে একবার জিজ্ঞাস করেই ফেললাম শেফা, তুমি কী জানো তুমি কত সুন্দর আর ভয়ংকর রূপবতী একটা মেয়ে? তুমি আমার মতো একটা ছেলেকে কেন বিয়ে করলে? শেফা আমার বুকের ওপর তার মাথা রেখে বলল, মানুষের বাহ্যিক রূপের চাইতে ভেতরের রূপ টা বেশি সুন্দর হওয়া জরুরী। তোমায় দেখে কেন জানি মনে হলো তোমার ভেতরটা অনেক সুন্দর।
কে বলেছে দুটি চোখের সঙ্গে হারিয়ে যেতে আরও দুটি চোখ লাগে? আমিতো তার দুটি চোখের বিপরীতে একটি চোখেই হারিয়ে গেলাম অন্যভুবনে।
আমাদের সংসার জীবন শুরু হলো আনন্দময় ভাবেই। বিয়ের এক বছরের ভেতরেই আমাদের সংসারে এলো ফুটফুটে একটি মেয়ে। মেয়েটির নাম দিলাম আমিই। ,” আখি” । এই একটি শব্দের গুরুত্ব মানবজীবনে কতটা তা হয়তো আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। আমার প্রথম পৃথিবী বাবা-মা, আরেকটা আমার স্ত্রী। আর মেয়েটা হলো আমার তৃতীয় পৃথিবী। আমার জগৎ, সংসার। দেখতে দেখতে আখি এর বয়স ৪ বছর হয়ে গেল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা আরেকটা সন্তান নিব। দীর্ঘদিন চেষ্টার পরও আমরা আর নতুন কোনো সন্তানের দেখা পেলাম না। ভাবলাম ডাক্তারের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলা উচিত। যেই ভাবা সেই চলে গেলাম এক ডাক্তারের কাছে। শেফাকে যদিও কিছুই জানাই নি। ডাক্তার বললেন আপনাদের দুজনের কারও মধ্যে হয়তো সমস্যা থাকতে পারে। আপনাদের চেকআপ করা উচিত। ডাক্তার বললেন, আজতো আপনার স্ত্রীকে আনেননি। আপনার চেকআপ টা করিয়ে রাখি। আরেকদিন এসে আপনার স্ত্রীকে চেকআপ করিয়ে নিবেন।
সেদিন চেকআপ করে বাড়ি ফিরে এলাম। চেকআপ এর বিষয়ে শেফাকে কিছুই জানাইনি। যেদিন রিপোর্ট দেওয়ার কথা সেদিন আবার ডাক্তারের চেম্বারে গেলাম। ডাক্তার সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বলেছিলেন আপনার একটি মেয়ে আছে, ৪ বছর বয়স। কিন্তু এটাতো প্রায় অসম্ভব। আপনি কখনোই বাবা হতে পারবেন না। কিছু পুরুষ আছে জন্ম থেকে বন্ধ্যা। সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা তাদের থাকে না। আপনারও হচ্ছে সেই সমস্যা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এখন এর ট্রিটমেন্ট চালু হয়েছে। আপনি চাইলে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
ডাক্তার সাহেবের এই একটা কথা আমার পুরো জগৎ পাল্টে দিল। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আমি বাকরুদ্ধ, হতভম্ব হয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম। আমি আমার স্ত্রী শেফাকে সন্দেহ করতে লাগলাম। সে আমার কাছে ধীরে ধীরে এক দুশচরিত্রা নারী হয়ে উঠতে লাগলো। সাহস করে শেফার অগোচরেই আমার মেয়ের ডি.এন.এ পরীক্ষা করালাম। পরীক্ষা এর রিপোর্টে যা আসার তাই এল। আখি আমার মেয়ে না। কার পাপের ফসল এটা আমি ভাবতে লাগলাম। তবে শেফাকে এই বিষয়ে আমি কিছুই বললাম না বা তার কাছে আমি কিছুই জানতে চাইলাম না। তার জন্য মনে যতটা ভালোবাসা ছিল সব ঘৃণায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি ব্যর্থ হলাম। শেফা এবং আমার মেয়ে আখি ছাড়া আমার বেঁচে থাকা প্রায় অর্থহীন। এদের মায়া আমি কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারবো না। তাই জীবনের এই কঠিন সত্যটাকে অস্বীকার করে স্বাভাবিক একটা জীবনের দিকে ছুটলাম। আখির প্রতি আমার ভালবাসা এক বিন্দুও কমেনি। কিন্তু মাঝেমধ্যে শেফার মতো একটা মেয়ে আমাকে ধোকা দিল, এত বড় একটা কথা আমার চেয়ে লুকিয়ে রাখল, যাকে আমি আমার মেয়ে ভাবি তার শরীরে অন্য কোনো পুরুষের রক্ত বইছে ভাবতেই গা শিহরে উঠত। তারপর ভাবতাম হয়তো এটা সৃষ্টি কর্তারই ইচ্ছা। তিনি আমাকে জন্মদানের ক্ষমতা দেননি। কিন্তু পিতার সুখ থেকেও বঞ্চিত করতে চাননি।
আমার মেয়ে আখির ১০ বছর বয়স হলো। এইদিকে আমার স্ত্রী শেফা হঠাৎ ভয়ংকর রকম অসুস্থ হয়ে পড়ল। হাসপাতালে নিয়ে জানতে পারলাম তার ক্যানসার হয়েছে। আমার সুখের জীবনের ইতি ঘটল যেন। আমার পরিবার, শেফার পরিবার সবাই আমরা ভেঙে পড়লাম। দুই পরিবার মিলে শেফার চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম। চিকিৎসা হলো। কিন্তু ডাক্তার বলল শেফা আর বড়জোর ১-২ মাস বাঁচবে। আমার জীবনের মান, আনন্দ, অনুভূতি এর পরিমাণ তখন ০ এর গোড়ায়। হাসপাতালের একটা কেভিন জুড়ে এগিয়ে চলতে লাগলো আমাদের জীবন ,সংসার। এরই মধ্যে একটা দিন আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন একটা সত্য এর ব্যাখা দিল শেফা নিজেই আমায়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শেফা এই বিষয়ে আমাকে নিজে থেকে কিছু না বললে আমি কখনো তার কাছে কোনো কিছু জানতে চাব না।
শেফা প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে আমায় বলল,শাফিন, আমার এই অসুখ হচ্ছে আমার পাপের শাস্তি। আমি জীবনে তোমার সঙ্গে অনেক বড় একটা অন্যায় করেছি। তুমি জানো না এত বছর আমি ভেতরে ভেতরে কতটা পুড়েছি সেই অন্যায়ের জন্য। অনেক বার ভেবেছি তোমাকে সব সত্য কথা খুলে বলব। কিন্তু সাহসে কুলায় নি। তোমাকে , একটা সুন্দর সংসার হারিয়ে ফেলার ভয় ছিল আমার। আমি কথাটা শুনেই বুঝতে পারলাম সে কী বলতে চাইছে। তারপরও কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে জিজ্ঞাস করলাম কী বলছ তুমি, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
শেফা বলল, আমি জানি কথাটা শুনার পর হয়তো তুমি আমাকে ঘৃণা করবে। হয়তো আখিকেও দূরে ঠেলে দিবে। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে সব কিছু আমাকে বলে যেতেই হবে। কিছুটা প্রশান্তি নিয়ে মরতে তো পারবো।
শুন তুমি যেদিন আমায় দেখতে গিয়েছিলে তোমাকে দেখে আমি পুরো আৎকে উঠেছিলাম। আমি যে বিশেষ কাউকে পছন্দ করতাম তা না। কিন্তু আমার মনের মানুষ আর যাই হোক। একজন একচোখা, সাধারণ চেহারার মানুষ না। তোমাকে আমার অসম্ভব অপছন্দ হয়েছিল। আমার বাড়ির সবারও। তাই আমরা তোমাকে না করে দেই। তার ঠিক মাস খানেক পর এক রাতে আমি এক খালার বাড়ি থেকে বাসে করে ফিরছিলাম। সেদিন একটু বেশিই রাত হয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে বাসটা প্রায় খালি হয়ে যায়। লোকাল বাস টা আমি যে ষ্টেশনে নামব ঠিক তার আগের স্টেশনে হঠাৎ করে অনেকক্ষণ ধরে থেমে থাকে। বাসের বাকি যাত্রীরা নেমে যায়। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। তারপর হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে গাড়িতে কয়েকটা ছেলে উঠে মুখ চেপে ধরে আমার। কিছু বুঝে উঠার আগেই পালাক্রমে আমাকে ধর্ষণ করে। এরপর আমাকে স্টেশনে ফেলে রেখে চলে যায়। মাঝরাত তখন স্টেশন প্রায় ফাঁকা। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে কল দেই। বাবা আর ভাইয়া এসে আমাকে নিয়ে যায়।
বাড়ির সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। আমার মানসিক অবস্থা তখন ঠিক নেই। পরেরদিন মামা-খালারাও আমাদের বাসায় চলে আসেন। সবাই আমাকে নিয়ে চিন্তায় ভেঙে পড়ে। আমার সঙ্গে যে এমন একটা ভয়ংকর কান্ড ঘটেছে এটা তখনও আমার বাড়ির লোক ছাড়া আর কেউ জানে না। খালা মাকে বললেন, এদেশে ধর্ষণের বিচার হয় না। শুধু শুধু ধর্ষণের মামলা দিয়ে মেয়েটার জীবনটাকে নষ্ট করিস না। বিচারত পাবিই না। উল্টো মেয়েটাকেই সবাই নষ্ট বলবে। তখন আর মেয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করতে হবে না। ঐযে গত যেই ছেলেটা ওকে দেখতে এসেছিল ওর সঙ্গেই ওর বিয়ে টা দিয়ে দে। নতুন সংসারে গেলে আর এসব মনে থাকবে না।
আর এইসব ইনসাল্লাহ কেউ জানতেও পারবে না।
আমার তখন বলার কিছুই ছিল না। আমি ভয়ে অস্থির হয়ে ছিলাম। আমি এখন কী করব ? আত্মহত্যা? আমার এক বান্ধবীও আমার মতো পরিস্হিতি এর শিকার হয়ে ধর্ষণের মামলা করেছিল থানায়। সাথে সাথে চারদিকে ছড়িয়ে গেল খবরটা। বান্ধবী কোনো বিচার না পেয়ে নিজের গায়ে কলঙ্ক মেখে আত্মহত্যা করে। আমার সাথে কী এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে? আমার জীবনটা কী আর কখনো স্বাভাবিক হবে? তাই আমি নিজের সুখের জন্য কেবল তোমার কথা না ভেবে তোমাকে বিয়ে করি। এই ধর্ষণের কথা কেউ জানেনা। আমি জানি তুমি আমাকে এখন অনেক ঘৃণা করবে। করো।
এটাই আমার প্রাপ্য। মৃত্যুর আগে তোমার চোখে আমার জন্য ঘৃণাটাই একটু দেখে যাই। এতেই আমার সুখ।
আমি আমার চোখ মুছতে মুছতে কেভিন থেকে বেরিয়ে এলাম। একটা মেয়ে নিজের মধ্যে এতটা পাপবোধ নিয়ে এত বছর বেঁচে ছিল এটা ভাবতেই নিজেকে পাপী মনে হচ্ছে। আর আমি এত বছর ধরে ওকে একটা নষ্টা মেয়ে ভেবে এসেছি।
ওকে একটুও বুঝতে চাইনি। সেতো এইসব কিছু লুকিয়ে ছিল কেবল একটা সাধারণ, স্বাভাবিক জীবন পাওয়ার জন্য। সেটা সে পেয়েওছে। সে যদি বিয়ের প্রথম রাতেই সব কথা আমাকে খুলে বলতো, তাহলে তাকে বা তার মেয়েকে কী আমি স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারতাম। নিজের কাছেই নিজের এই উত্তর নেই।
এর ঠিক এক মাস পর আমার স্ত্রী মারা যায়। কিন্তু মারা যাওয়ার আগে সে আমাকে যেই দায়িত্বটা দিয়ে যায় সেই দায়িত্বটাই প্রতি মুহূর্ত তার কথা আমায় মনে করায় আর আমাকে পুড়ায়। শেফা মারা যাওয়ার আগে আমাকে বলে, আচ্ছা শাফিন বলতো আমরা কী জীবনে কোনো ভয়ংকর পাপ করেছি? তবুও আমাদের এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যেতে হলো কেন? একটা দুর্ঘটনায় তোমার একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেল। এতেতো তোমার কোনো দোষ নেই। তবুও তুমি শাস্তি পেলে পুরোটা জীবন ভরে। কয়েকটা ছেলে আমাকে অসহায় ভাবে পেয়ে ধর্ষণ করল। এটাতে আমার দোষটা কোথাও বলতো? আমি নিজের মধ্যে পাপবোধ নিয়ে বাকিটা জীবন পার করেছি। আমার পাপটা কোথায়? আমাদের মেয়ে নিজেও জানে না তার আসল বাবার পরিচয়। সে যে এইভাবে জন্মেছে এতে তারই বা কোনো দোষ আছে? আমরা কেউই পাপী নই। তাই আমাদের পাপবোধ থাকা উচিত না। আমাদের উচিত ছিল সুখে,শান্তিতে বসবাস করা। আমাদের মেয়ের বয়স ১১ বছর এখন। আখি এর বয়স যখন ১৮ বছর হবে তখন তাকে তুমি সমস্ত সত্যিটা খুলে বলবে। বলবে যে আমি ধর্ষিত হয়েছিলাম। সে সেই ধর্ষণের ফসল। তুমি তার আসল বাবা না। এই কঠিন সত্যটা ও জানুক। ও তারপর যদি মনে করে ও যাদের বাবা-মা ডাকে তারা পাপী, অপরাধী তাহলে চলে যাক তোমার জীবন থেকে। নাহলে তোমার সঙ্গে থাকবে।
মৃত্যুর আগে শেফার এই ধরনের পাগলামির কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই । শুধু জানি এটা শেফা এর জীবনের শেষ ইচ্ছা। সে আর কোনো দিন এই পৃথিবীতে আসবে না। তবুও তার এই ইচ্ছা আমাকে পুরণ করতেই হবে। আখি আজ রাত ১২ টার পর ১৫ তে পা রাখবে। ভয়ংকর ভাবে অপেক্ষা করছি তার ১৮ তম জন্মদিনের জন্য।
রাত তখন আনুমানিক ১০ টা বাজে। আমার মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছিল। তাই মোবাইলটা ওয়ার্ডরোবের ওপর চার্জে দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। প্রচন্ড মাথা ব্যথা আর বিরক্তিতে ঘুম আসছিল না। কয়েক মুহূর্ত পরেই হঠাৎ মোবাইলে একটা কল এল। এখন বিছানা থেকে নেমে কল ধরার কোনো মানে হয়না। ১ম কল বেজে শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবার কল বাজতে শুরু করল। তাও বিছানা থেকে নামলাম না। ৩য় বার কল বাজার পর বেশ বিরক্তি নিয়েই কলটা ধরলাম। কল ধরে হ্যালো, বলতেই ওপাশ থেকে একটা শান্ত, নম্র, করুন পুরুষ কন্ঠ ভেসে এল, ভাই একটা গল্প শুনবেন? আমার মাথা সাথে আগুন হয়ে গেল। বিশ্ৰী ভাষায় কিছু গালিগালাজ করে বললাম, সালা এত রাত্রে মজা নিস? আমার চেঁচামেচিতে লোকটার কণ্ঠের সুর পরিবর্তন হলো না। লোকটা স্বাভাবিক ভাবেই নিজের জীবনের গল্প বলে যেতে লাগল। আমি প্রথমে বিরক্ত হলেও ধীরে ধীরে লোকটার বলা গল্পের ভেতর হারিয়ে গেলাম। নিঃশব্দে তার পুরো কাহিনীটা শুনলাম। নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। গল্প বলার শেষে লোকটা বলল, তার স্ত্রী শেফার মৃত্যুর পর থেকে তার মেয়ের প্রতি জন্মদিনের আগের রাত লোকটা একা একা অনেকটা পথ হাঁটে। এরপর একটা টেলিফোন বুথ থেকে আন্দাজে এগারোটি নাম্বার চাপে। যেই নাম্বার উঠে তাকে সর্বোচ্চ তিন বার কল দেয় এর মধ্যে যদি সে কল ধরে তাহলে সে তাকে তার জীবনের কাহিনী বলে। সেইজন পুরো কাহিনী না শুনে কল কেটে দিলেও তিনি টেলিফোন কানে ধরে পুরো গল্পটাই নিজে নিজে বলে যান। সেই ভাবেই আজকে আমার কাছে কল আসে। আমি তার এই অদ্ভুত গল্প শুনে পুরোই স্তব্ধ হয়ে যাই। তিনি এর মধ্যেই কলটা রেখে দিয়েছেন। জানি আবার ঐ নাম্বারে কল দিলে আর উনাকে পাওয়া যাবে। হয়তো আর জীবনেও তার সঙ্গে আমার কথা হবে না। অন্যের জীবন নিয়ে আমার কখনোই তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ঐদিনের পর থেকে প্রায়ই ভাবতাম শাফিন সাহেব কী আসলেই তার মেয়েকে এই ভয়ঙ্কর সত্য কথাটা বলতে পারবেন? তার মেয়ের ইবা তখন কী অনুভূতি হবে। না, এই দৃশ্য এর কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। তবুও মাঝেমধ্যে ভাবি হঠাৎ আসা এই অচেনা ফোন কলের কথা। শাফিন সাহেব, শেফা বেগম আর আখি আপনাদের কারোই কোনো পাপ নেই। তবুও আপনাদের কঠিন বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। আমরা স্রষ্টার হাতের পুতুল মাত্র। আমাদের ভাগ্য, নিয়তি সবই তার হাতে। এই রহস্যময় মানুষ জগতের কতো কিছুই জানি না।