মা আমার হাতটা ধরে সামনে নিয়ে এসে কপালে একটা চুমু দিয়ে বললেন,
–মা’ রে মেয়ে হয়ে জন্মেছিস ঠিকই । কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণে কখনো নিজেকে ছোট মনে করবি না।মেয়েরা যে আল্লাহর কি পরিমাণ আশীর্বাদ সেটা কিছু ব্যক্তি বুঝেনা।ওদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হলেও তোকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে।তোকে লেখাপড়া শিখতে হবে। ছোট থেকেই মা আমার ভিতরে বীজ হিসেবে এই কথাগুলো রোপন করে দিয়েছিলো। আমি জন্মের পর থেকে আমার মা’কে শারিরীক এবং মানসিকভাবে অত্যাচার করা হতো।তার কারণ একটাই তিনি একজন কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছেন। যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি সেদিন থেকেই দেখতাম বাবা মা’কে কথায় কথায় চুলের মুঠি ধরে মারতেন।যেদিন মা আমাকে স্কুলে ভর্তি করানোর কথা বললেন সেদিন আমার মা’কে কি নির্মমভাবেই না মেরেছিলো আমার নিষ্ঠুর বাবা।
বাবার কেবল একটাই কথা ছিলো।আর সেটা হলো, মাইয়ারে স্কুলে কেন ভর্তি করামু ? একটা পোলা হইলে কত্ত ভালা অইতো ! বুড়া বয়সে পোলা রুজিরোজগার কইরা খাওয়াইতো। মাইয়াতো হইলো বোজা।বোজার পিছনে টাকা খরচ করার কোনো দরকার নাই। বাবার অজান্তে মা আমাকে লুকিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন।আমার মায়ের একটাই স্বপ্ন ছিলো । আমি অনেক বড় হবো।নিজের পায়ে দাঁড়াবো । মায়ের মত অন্যের অধীনে থেকে আমাকে যেন কিছুই করতে না হয়। আমিও লুকিয়ে যতটুকু সম্ভব পড়ালেখা করতাম।আমার মায়ের কষ্ট যেন বিফল না হয় সেই চেষ্টা করতাম। এভাবে আমার লেখাপড়া এগিয়ে যাচ্ছিলো । আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন বাবার কাছে ধরা পড়ে যাই।সেদিন বাবা আমাকে আর মা’কে দু’জনকে খুব মেরেছে।আমার বই পুস্তক স্কুলের পোশাক সব ছিঁড়ে ফেলেছে। সেদিন আমি মা’কে বলেছিলাম,
–মা, আমি আর পড়বো না।আমার জন্যই বাবা তোমাকে এত বেশি মারধর করে। মা অভিমানে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে,
–আমি মার খাচ্ছি নিজের জন্য।আজ যদি আমার শিক্ষা থাকতো তাহলে পড়ে পড়ে মার খাওয়ার কোনো দরকার ছিলোনা বা অন্যের উপর নির্ভর থাকারও কোনো প্রয়োজন ছিলোনা। সবসময় মনে রাখবি , তোর হাতে আমি কাঁচি তুলে দিচ্ছি।সেটা দিয়ে তোর যখন খুশি ধান কাটতে পারবি।
–কিন্তু মা , তুমি তো এভাবে মইরা যাইবা !
সেদিন মা’কে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলাম।আমার কান্না দেখে মা বাধ্য হয়ে আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। তারপর থেকে শুরু হয় আমার মায়ের জীবন নিয়ে যুদ্ধ। বাবার মাথে মা আর কখনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি।উনার ভয় ছিল, বাবা যদি এসে আমার পড়ালেখা সব নষ্ট করে দেয় ! তবে তিনি বলেছিলেন,
যখন আমি অনেক বড় হবো তখন যেন বাবা’কে নিয়ে আসি।কারণ যা কিছুই হোক তিনিতো আমার বাবা।তাকে ছাড়াতো আমি পৃথিবীতে আসতে পারতাম না। বছরের পর বছর মা নিজের জীবনের সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে আমার পিছনে পানির মত টাকা খরচ করতে লাগলেন।যে টাকাগুলো মায়ের ঘামে ভেজা ছিলো। মা অন্যের বাসা বা বাড়িতে কাজ করে আমায় মানুষ করার কাজে লেগে পড়লেন। অনেক কষ্টে আমি খুব ভালো ভাবে পড়াশোনা শেষ করি।এক পর্যায় আমার একটা ভালো চাকরীর প্রস্তাব আসে। সেদিন ছিলো আমার চাকরীর ইন্টারভিউ। আমাদের বাসা থেকে অফিসটা অনেক দূরে ছিলো।তাই ইন্টারভিউ এর আগের দিন আমি মা’কে রেখে চলে যাই এক বন্ধুর বাড়িতে । পরের দিন ইন্টারভিউ এর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। মা তখন ফোন করে বলে,
–তুলি , তুই কখনো পিছুপা হবি না মা।সবসময় এগিয়ে যাবি । কারণ আল্লাহর রহমতে তোর সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে রে মা।
এই চার পাঁচটা কথা বলে মা ফোন রেখে দেয়।জানিনা মা কেন আমায় এই কথাগুলো বলেছিলো।তবে মায়ের অনুপ্রেরণায় আজ আমি এতটা আত্মবিশ্বাস পাই। পরেরদিন যথারীতি ইন্টারভিউ দিতে চলে যাই । ইন্টারভিউ এর শেষে মা’কে অনেকবার ফোন দেই।কিন্তু মা ফোন ধরে নি।তখন পর্যন্ত আমার মনে একবারও হয়নি যে আমার মা সব কষ্টের অবসান ঘটিয়ে ফেলেছেন। বাসায় গিয়ে থমকে যাই । চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে যায় । চার পায়ের পালকি এসে আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই বলছে আমার মায়ের নাকি যাওয়ার সময় হয়ে গেছে ? আমি এক পা দু’পা করে মায়ের সামনে যাচ্ছি । আজ তো আমার মায়ের খুব খুশি হওয়ার কথা।তার মেয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর কথা।কিন্তু আমার মা’কে খুশির খবরটা আমায় মাথা নিচু করেই দিতে হলো।কারণ আমার মা যে শুয়ে আছে মাটির বিছানায় !
আমার মায়ের ভাগ্যটা কেমন সেটা একমাত্র আল্লাহ্ জানে।কারণ আমি যে কিছুই মিলাতে পারছিনা।মা কি ভাগ্যে করে কেবল কষ্টটাই নিয়ে এসেছিলো ? মায়ের ভাগ্যে কি সুখ লিখা ছিলো না ? সবাই আমার মা’কে নিয়ে গেলো।আমি কেমন হতভাগা মেয়ে ! নিজের মায়ের শেষ মুহূর্তে মায়ের কাছেই থাকতে পারলাম না !
মায়ের বলা শেষ কথাগুলো আজও কানে লাগে । মায়েরা এত নিষ্ঠুর কেন হয় ? নিজের শান্তি বিসর্জন দিয়ে কেন আমাদেরকে প্রকৃত মানুষ করে তোলে ? সব মায়ের ভাগ্যে কি আর শেষ বয়সের সুখ জোটে ? মা চলে যাওয়ার কিছুদিন পর আমি বাবার বাড়িতে যাই। যদিও বাবা আমাকে দেখে চিনেন নি কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত ছিলেন।