ভুল থেকে শিক্ষা

ভুল থেকে শিক্ষা

“ভাইয়া আমাকে একটু রাস্তাটা পাড় করে দিবেন” খুব করুণ দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে কথাটা বললো সাত বছরের ছোট্ট একটা শিশু! হাতে কিছু ঔষধের প্যাকেট। লোকটা কথাটা শুনে বেশ বিরক্ত হলো। অফিসের অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট এদিক ওদিক হলে অফিসে বকা শুনতে হয়। প্রায় তার এমন দেরি হয়। কখন না জানি চাকরিটাই চলে যায়। এখন কি আর এই ছেলেটাকে রাস্তা পাড় করে দেয়ার সময় আছে! হাটা দিয়ে চলে গেলো অন্য রাস্তায়। তার উদ্দেশ্য অফিস। লোকটা চলে যাচ্ছে আর পিছন থেকে ছোট্ট ছেলেটি অপলক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। মা বলেছে একা একা রাস্তা না পাড় হতে। সামনে যাকে পায় তাকে যেন বলে রাস্তাটা পাড় করে দিতে। কেউ না কেউ তো একজন দিবেই। কিন্তু কোথায় কেউ তো দিচ্ছে না রাস্তা পাড় করে।

এই শহরে সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত। কারোর কি একটু সময় হয় না! কথা গুলো ভাবছে আর আশেপাশে তাঁকাচ্ছে, আর কাকে বলা যায়। সাদা শার্ট পড়া একটা লোক এদিক আসছে হেঁটে হেঁটে। দেখতে একদম ছোট মামা’র মতো। কতদিন হলো মামা’র সাথে দেখা হয় না। অনেক ভালোবাসতো মামা। এই লোকটাকে বললে হয়তো কাজ হবে! লোকটা সামনে দিয়ে যেতে লাগলো। ঠিক তখই তার। হাত ধরে বললো, “মামা আমাকে একটু রাস্তাটা পাড় করে দিবেন!” লোকটা একটা ঝাড়ি দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। “তোর তো সাহস কম না, হাত ধরে টানছিস! একটা চড় মেরে কান পাঁকিয়ে দিবো। বেয়াদব কোথাকার। যত্ত সব ফকিন্নির দল!” কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে বলে লোকটা চলে গেলো।

বাচ্চা ছেলেটি নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটার ঝাড়ি শুনে বেশ ভয় পেয়েছে। হাত পা কাঁপছে। একটু সামনে এগিয়ে যেয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়লো। গাড়ির ভির কমছেই না। একবার ভাবলো সে নিজেই একা একা রাস্তা পাড়ি দিবে। কিন্তু মায়ের কথাটা কানে বাজতেই থেমে গেলো। অনেক সময় হয়ে গেছে বাসা থেকে বের হয়েছে। ঘরে মা অসুস্থ খুব। মাথা ব্যথায় উঠে বসতেও পারে না। এখানে এক চাচা বিনা পয়সায় ঔষধ দেয় তার মাকে। চাচাটা বড্ড ভালো মানুষ। সেগুলো নিতেই এখানে আসছে। মা তো বাসায় একা। নিশ্চয় খুব চিন্তা করছে তার জন্য। হঠাৎ একটা মেয়ে এসে বললো, “বাবু তুমি এখানে বসে একা একা কাঁদছো কেন?” চোখ মুছতে মুছতে বললো, “আমার মা বাসায় একা। খুব অসুস্থ। এই ঔষধ নিয়ে বাসায় যেতে হবে, কিন্তু কেউ রাস্তা পার করে দিলো না।” “আচ্ছা চলো আমি পাড় করে দেই। তোমার নাম কী বাবু?” “আমার নাম আশিক।” মেয়েটা আশিকের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে রাস্তা পাড় করে দিচ্ছে। আর আশিক একটু পর পর মেয়েটির দিকে মাথা উঁচু করে তাঁকিয়ে মুচকি হাসি দিচ্ছে। চারদিন পর!

আশিক তার মায়ের সাথে হসপিটাল এসেছে। এখন আগের চেয়ে বেশ সুস্থ। আজ এসেছে একটা পরীক্ষা করাবার জন্য। কিন্তু গেটের সামনে অনেক মানুষের ভির দেখতে পেলেন। অনেকে কান্নাকাটি করছে। কী হয়েছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরে একটা লোকের কাছ থেকে জানতে পারলো, একটা স্কুল বাস রোড এক্সিডেন্ট করেছে। অনেক বাচ্চারা ছিলো বাসটির ভিতর। দশ পনেরো জন নাকি জায়গায় মারা গেছে। ভির ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন। ফ্লোড়ে বেশ কয়েকটা মৃত বাচ্চা দেখলেন। হঠাৎ খেয়াল করলেন একটা লোক খুব ছোঁটা ছুঁটি করছে। হয়তো এখানে তারও বাচ্চা আছে। তবুও একজন নার্সকে ডাক দিলেন আশিকের মা।

“আপা ঐ লোকটা এমন পাগলের মতো দৌড়া দৌড়ি করে কেন?” “উনার বাচ্চার অবস্থা খুবই খারাপ। জরুরী রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু ঐ গ্রুপের রক্ত কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না!” “আপা দেখেন তো আমার রক্ত মেলে কিনা।” “আপনি রক্ত দিবেন?” “হয় দেবো। কারণ আজ তো ওটা আমারও সন্তান হতে পারতো।” “আচ্ছা আমার সাথে ভিতরে আসুন।” আশিককে একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখে, তার মা রক্ত দিতে ভিতরে চলে গেলো। সে চুপচাপ বসে হসপিটালের লাইট গুলো গুণছে আঙুলের ইশারা দিয়ে।

আঁধা ঘন্টা পর তার মা বেরিয়ে এলো। একটা লোক তার মা’কে ধরে নিয়ে এগিয়ে আসছে। আশিক দৌড়ে চলে আসলো মায়ের কাছে। লোকটার দিকে তাঁকিয়েই আশিক ভ্রু কুঁচকে নিলো। এটা তো সেই লোকটা যাকে রাস্তা পাড় করার জন্য বলেছিলো! দেখতে একদম ছোট মামা’র মতো। কিন্তু লোকটা রাস্তা না পাড় করিয়ে তাকে অনেক বকা দিয়েছিলো। আশিক তার মা’কে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার আর চিনতে কষ্ট হলো না, আশিক সেই ছেলেটি। আশিককে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কান্না জুড়ে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আজ তোমার মা রক্ত না দিলে আমার বাচ্চাটা বাঁচানো সম্ভব হতো না। আল্লাহ বোধহয় আমার কোল খালি করে দিতেন। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও বাবু!”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত