আমার বর সেই প্রথম দিনই বলেছিলো, “বাহ, চুড়ি জোড়া তো তোমার হাতে বেশ মানিয়েছে “! বরের মুখে প্রথম এমন প্রশংসা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। সেই থেকে চুড়ি জোড়া সবসময় হাতে পড়তাম। চুড়ি জোড়া বিয়ের সময় আমার বাবা দিয়েছিলেন আমাকে। বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে মাঝেমাঝে বাবার সামনে দু-হাত নাড়িয়ে বলতাম, বাবা দেখো, এই চুড়ি তুমি আমাকে দিয়েছিলে। বাবা হাতের দিকে তাকিয়ে কেবল মুচকি হাসতেন ।
প্রথম মেয়েটা হওয়ার পর হাত থেকে চুড়ি জোড়া প্রায় অনেকদিন খুলে রেখেছিলাম। প্রথম বাচ্চা বলে কথা ! তার সেবা যত্নের খাতিরে নিজের শখগুলোকে প্রায় বিসর্জন দিতে বসেছিলাম । বিয়ের প্রায় ৭ বছর পর একদিন রাতে হঠাৎ খবর পেয়েছিলাম, বাবা নাকি হঠাৎ হার্ট এ্যাটাক করে মারা গিয়েছে। সেই রাতেই বর আর বাচ্চা নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলাম বাবার বাড়িতে । আমার জীবনে সবচেয়ে প্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব ছিলো আমার বাবা। সেই ছোটবেলা বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে গতকাল অবধি আমার বাবা ছিলো আমার জীবনের হাসি কান্নার মাঝে একমাত্র ছায়া। বিয়ে হয়েছে তাতে কি? বাবার স্নেহ,ভালবাসায় কখনো ঘাটতি পড়ে না।
এই মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই স্মৃতিগুলো, যখন বাবা আনন্দ আর কষ্ট মিশ্রিত চেহারা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আমার হাতে সেই চুড়ি জোড়া পড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাবার খুব আহ্লাদী মেয়ে ছিলাম বলেই হয়তো বাবা নিজের হাতে আমাকে পড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর প্রায় ১৫ দিন পর ঢাকা চলে এসেছি। বাসায় এসে আলমারিটা খুলে সেই চুড়ি জোড়া খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, আমি সেই চুড়ি কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু ওর সাথে আরো কিছু গয়না ছিলো,ওগুলো জায়গার তা জায়গায়ই আছে কিন্তু চুড়ি জোড়া নেই! ওসব গয়না সব নিয়ে গেলেও আমার একটুও খারাপ লাগতো না। কিন্তু ভয়ংকর রকম খারাপ লাগছিলো আমার সেই চুড়ি জোড়ার জন্যে।
মুহূর্তের মধ্যে আবারো বাবাকে হারানোর শোক কলিজা ছাপিয়ে তেড়ে আসতে লাগলো। আমার কান্না দেখে আমার বর ইফতি বলেছিলো, “প্লিজ,তুমি কেঁদো না।আমি তোমাকে এর চেয়েও সুন্দর এক জোড়া নতুন চুড়ি এনে দেবো”। তখন আমার উত্তর ছিলো, “হ্যাঁ,তুমি এর চেয়েও নতুন চুড়ি আমায় ঠিকই এনে দেবে কিন্তু তাতে আমার বাবার হাতের ছোঁয়া আর এক চিলতে নিখাঁদ ভালোবাসার ছোঁয়া থাকবে না। আমার বিয়ের প্রায় ১ বছর পর থেকেই বাসায় একটা কাজের মেয়ে রেখেছিলাম। ওর নাম ছিলো তুলি। গ্রামে যাওয়ার সময় তুলিকে বাসায় রেখে গিয়েছিলাম। কথা ছিলো আমরা আসলে ও ওদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবে।বাড়ি যাওয়ার সময় ভুলে আলমারির চাবিটা সাথে নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। তুলি আমাদের খুব বিশ্বস্ত ছিলো।
জানি তুলি এ কাজ কখনো করতে পারেনা। হয়তো ও কখনো দরজা খুলে বাহিরে বেড়িয়েছিলো তখন হয়তো কেউ এগুলো চুরি করেছিলো।আর এটাই ছিলো একমাত্র স্বান্তনা! তারপর থেকে আমি প্রতিদিন রাতে কাঁদতাম আর মন খারাপ করে থাকতাম চুড়ি জোড়ার জন্যে।আজ সকাল ১০ টায় তুলি ওর গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্য বের হবে। সব গোছানো শেষ। এরমধ্যে হঠাৎ ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ” আপু আমার মায়ের খুব শখ ছিলো একজোড়া চুড়ির।কখনো আমি তাকে কিনে দিতে পারিনি। তাই আমি তোমার চুড়ি জোড়া লুকিয়ে রেখেছিলাম।দয়া করে, তুমি আমায় মাফ করে দিও! আমার বড় ধরনের এক ভুল হয়ে গেছে”। তুলির হাত থেকে চুড়ি জোড়া নিয়ে বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরলাম । তুলিকে আমি কিছু বলিনি বরং আমার অন্যান্য গয়না থেকে ওকে এক জোড়া চুড়ি দিয়ে দিয়েছিলাম আমি, ওর মাকে দেয়ার জন্য। তুলি নিতে চায়নি তারপরও জোড় করে দিয়ে দিয়েছিলাম। তুলি বলে গিয়েছিলো ১ সপ্তাহ পরে ফিরবে কিন্তু সেই তুলি আর ফেরেনি!
এভাবে দেখতে দেখতে জীবন থেকে হারিয়ে গেলো আরো অনেকগুলো বছর। আজ আমার ছেলে অমিতের বিয়ে আমার ইচ্ছে ছিলো আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা আমার ছেলের বউকে দিয়ে বরন করবো। তাই আলমারি থেকে আস্তে আস্তে করে চুড়ি জোড়া বের করলাম । আমার বয়স হয়ে গেছে! কখন মরে যাই তার কোনো ঠিক নেই। তাই আমি চেয়েছিলাম আমার প্রিয় জিনিসটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম অটুট থাকুক। চুড়ি জোড়া শেষবারের মতো হাতে পড়লাম। ইফতি হঠাৎ বলে উঠলো সেই পুরনো কথা, বাহ্! চুড়ি জোড়া তো আজো তোমার হাতে দারুণ মানিয়েছে। সেদিনকার মতো আজো মুচকি হাসি দিলাম। কিন্তু আজকের হাসিটা সেদিনকার মতো লজ্জা মিশ্রিত ছিলো না বরং অশ্রুসিক্ত ছিলো। হাত থেকে চুড়ি জোড়া খুলে পাশের রুমে গিয়ে বউয়ের হাতে পড়িয়ে দিলাম যেমনটা আমার বাবা আমার হাতে পড়িয়ে দিয়েছিলেন। বউ কেবল মুচকি হাসলো।
হতে পারে এটা ওদের কাছে সামান্য এক উপহার।কিন্তু ছোট আর বড় উপহার বলে কোনো কথা নেই। ভালবাসার এক অমোঘ টানেই এই উপহারের কথা হৃদয় থেকে বেড়িয়ে আসে।যেটা এককালে স্মৃতির ডাইরীতে জায়গা করে নেয়। ওদের রুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতেই চোখ জোড়া আবারো ঝাপসা হয়ে আসলো। আবারো মনে পড়লো বাবা,ইফতি আর বহুবছর আগেরকার তুলির কথা! আমার ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়া মিষ্টি অনুভুতির কথা না হয় বাদই দিলাম। এই চুড়ি হয়তো প্রজন্মের পর প্রজন্ম থাকবে, না হয় কালের স্রোতে বিলীন হয়ে যাবে। হয়তো-বা তখন কেউ জানবেই না যে এই চুড়ির পিছনে আবেগ, আনন্দ আর দুঃখে জড়ানো কিছু গল্প ছিলো!