পার্থিব

পার্থিব

“শাক ক’খানা কুটে দিও। ঘরে অনেক কাজ, তাই তোমার কাছে দিয়ে গেলাম।”

“এতো শাক দিয়ে কি করবি?”

“কোথায় এতো দেখলে! ছয়টা মুখ, সবাই খেতে ভালোবাসে। তেলে দিলেই তো চুপসে মেরে এতোটুক হয়ে যায়। কুটে রেখো, আমি এসে নিয়ে যাবো।”

“আচ্ছা, রাখবো। তা একটু বসে যা না, আমি মোড়া এনে দিচ্ছি। একটু চা খেয়ে যা।”

“না, সময় নাই।”
শিরিন, সানোয়ারা’র কাছে শাক রেখে চলে যায়।

সানোয়ারা বেগম দুই ঝাড়ি শাক, একটা বড় চালুনিতে রেখে, একটা একটা করে মরা পাতা, হলুদ পাতা, শক্ত ডাঁটী বেছে ফেলে দেয়। অনেকখানি সময় নিয়ে সব শাক থেকে পরিস্কার, তাজাগুলো কুটে রাখে।

সাথে তার শাশুড়ি এসেও হাত লাগায়।

তারা বউ শাশুড়ি দুইজন এই ঘরটাতে থাকেন। ইনি সানোয়ারা’র সৎ শাশুড়ি, তার কোনো ছেলেমেয়ে নেয়, বন্ধ্যা মহিলা। সানোয়ারাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।

শাশুড়ি বয়সের ভারে বাঁকা হয়ে গেলেও সানোয়ারা’র চেয়ে শক্ত আছেন। সানোয়ারা রোগে, শোকে, দুশ্চিন্তায় বয়সের চেয়েও বেশি বুড়ো। অল্প বয়সেই তার দাঁতে পোকা ধরে তাও গেছে। সে এসব নিয়ে ভাবেনা, তার সৌন্দর্য দেখার লোক নাই। আর এখন তো বুড়িই হয়ে গেছে। আর তাছাড়া সৌন্দর্য ধুয়ে তার স্বামী পানি খাবে নাকি! এককালে তো সে যথেষ্ট সুন্দরীই ছিলো। গোলাপি বরণ গায়ের রঙ, হাঁটু অব্ধি ঘন কালো চুল। দুই পাটি সুন্দর দাঁত, হাসলে এতো সুন্দর লাগতো তাকে!

তাতে কি লাভ হলো? পেটে ধরেছে সব মেয়ে! ঘরে চেরাগ জ্বালাবার মানুষ আনার ক্ষমতা আল্লাহ তার হাতে দেননি। আল্লাহ সবাইকে সবকিছু দিয়ে হাত খালি করেননা, অহংকারীও বানান না। আল্লাহ’র একটা বিচার আছে।

তেমনি সানোয়ারাকে দিয়েছেন রূপ, শিরিনি এর পেটে দিয়েছেন পুত্র সন্তান। তার শরীরে রূপের ছিটেফোঁটাও নেই, তেমনি নেই মুখে সুন্দর ব্যবহার। চার পুত্রের জন্ম দিয়ে তার পা মাটি ছুঁতেও চায়না।

শাশুড়িকে আল্লাহ কি উপহার দিলেন, তা মাঝেমধ্যে ভেবে কূল পায়না সানোয়ারা।

না দিলেন পেটে সন্তান, না দিলেন সৌন্দর্য, না দিলেন স্বামীর ভালোবাসা। তবে তার শরীর সুস্থ, তিনি এখনো শুকনো সুপারি চিবিয়ে পান খান! তাও বা কম কি? তিনি পরহেজগারও। আজান শুনার সাথে সাথে জায়নামাজ পেতে নামাজ আদায় করেন। আলসেমি কি জিনিষ তার মধ্যে নেই। সময় সুযোগে দিনে কয়েকবার কোরান নিয়েও বসেন। তার গলায় সুর তেমন নেই, তবুও টেনে টেনে পড়ার চেষ্টা করেন, শুনতে খুব একটা খারাপ লাগেনা।

সানোয়ারার গলায় সুর আছে। সে যখন একমনে আকুল হয়ে কোরান তেলাওয়াত করে,

ফাবি আইয়া আলাইহি রাব্বি কুমা তুকাজ্জিবান…. শুনতে শুনতে শ্রোতার চোখে পানি এসে যায়।

সানোয়ারা’র পানের অভ্যাস নাই। কখনো খাওয়ার শখ হলে হামানদিস্তায় চেঁছে খায়। তাও আলসেমি লাগলে দুই হাতের তালুতে ঢলে মুখে দিয়ে দেয়।

তার ডায়াবেটিস আর হাই ব্লাড প্রেশারও আছে। মাঝেমধ্যে কোমর ব্যথা উঠলে হামাগুড়ি দিয়ে বাথরুম সারতে হয়, এমনই বেঁকে যায় ব্যথায়। এমনকি এমতাবস্থায় রান্নাবাড়াও সারে। যদিও শাশুড়ি সবসময় তার কাজে সাহায্য করেন।

কিন্তু নিজ থেকে বুড়ি শাশুড়ি’র থেকে সাহায্য নিতে তার খুব সংকোচ।

তার তিন কন্যা শুধু, তাদের এখন বিয়ে হয়ে গেছে। সেইজন্যই তার বয়স যখন চল্লিশ, তখন তেইশ বছর বয়সী শিরিনকে পুত্র সন্তান জন্ম দেবার জন্য এই ঘরে বউ করে নিয়ে আসেন তার সোয়ামি । এবং এরপর থেকে শিরিন পেটে পুত্রসন্তান এবং একচেটিয়ে ক্ষমতা হাতে নিয়ে নিয়েছে আর সানোয়ারাদের করেছে আলাদা ঘরের বাসিন্দা ।

এতে সানোয়ারা’র মনে খুব দু:খ তা মনে হয়না। সবাই তার নিজ নিজ কপালে রিজিক এবং ভালোবাসা নিয়েই দুনিয়াতে এসেছে। সেও তাই।

ঘন্টা দু’য়েক পর, মিনহাজের মা অর্থাৎ তার সতীন শিরিন এসে শাক নিয়ে যায়। শিরিন, তার মেজো কন্যার বয়সী। তাই সানোয়ারা তাকে তুই করে বললেও মনে মনে খুব ভয় পায়। শিরিনের মুখ খুব খারাপ। কোনো কারণে তার মেজাজ একবার খারাপ হলে, সানোয়ারাকে দ্বিতীয়বার তার মায়ের পেট থেকে বের করে আনবে, এমনই স্বভাব তার। তাই সানোয়ারা দূরত্ব বজায় রেখে চলে। শিরিনের মেজাজ এমনিতেও সবসময় গরম থাকে। তাই সানোয়ারা তার মরজিমাফিক চলার চেষ্টাই থাকে। সে তার দিকে চোখে চোখ রেখে কথা বলতেও পারেনা। অথচ সে কন্যাসম! কি আর করা, যার যার ইজ্জত সেই বাঁচিয়ে চলে। এই ঘরে শিরিনেরও কুড়ি বছর হয়ে গেছে, সেও চার সন্তানের মা!

শিরিনের ঘরে সানোয়ারা গেলে কখনো পিড়ি ঠেলে দেবেতো দূরে থাক, বুবু বসো তাও ভুলে বলেনা। হয়তো এসব আন্তরিকতা দেখাতে সে অভ্যস্ত নয়।

একবার সানোয়ারা মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি নাস্তা পাঠাবে বলে শিরিনের বড় টিফিন কেরিয়ারটা ধার চাইতে যায়।

শিরিন এক ধমক দেয় তাকে,

“কয়েকটা কিনে জমিয়ে রাখতে পারোনা? কোথায় রেখেছি মনে নাই। পরে খুঁজে দেখবো। এখন কাজ করছি।”

অথচ, শিরিন কিছু চাইতে আসলে, সানোয়ারা ছাদের ঘরে থাকলেও সিঁড়ি লাগিয়ে বের করে এনে দেয়। দিতে পেরে যেন শান্তি পায়।

তাদের দুইজনের এহেন আচার ব্যবহার দেখলে সম্পর্কটা উল্টো ভাবতে পারবে যে কেউ। যেন শিরিন বড় সতীন আর সানোয়ারা ছোট!

শাক কুটে দেয়ার পর, সানোয়ারা’র খুব ইচ্ছে হয় শিরিনকে বলে, একটু খানি শাক আমার জন্য পাঠাস। তোর কষ্ট হলে আমি গিয়ে হলেও নিয়ে আসবো।

কিন্তু মুখ দিয়ে সে কথা বের হয়না।

এরা বউ শাশুড়ি যোহরের নামাজ শেষ হতেই ভাত পাতে বসে যায়। আজ সানোয়ারা শাশুড়িকে ভাত বেড়ে দিয়ে, সে পরে খাবে বলে অপেক্ষা করতে থাকে, একটু শাক যদি শিরিন আনে!

শাক খেতে হয় তাজাতাজা, তাও দুপুরবেলায়। রাতে শাক খাওয়া খুবই অনুচিত, বদহজম হয়। একবার লোভে পড়ে, রাতে শাক খেয়ে সানোয়ারাকে সারারাত টয়লেটে কাটাতে হয়েছে!

তাছাড়া বাসী শাকে স্বাদ থাকেনা। সানোয়ারা দুইটা শুকনো মরিচও ভেজে রেখেছে। শাক আনলে মরিচ দিয়ে মজা করেই খাবে। আর শিরিনকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, এই শাক কে দিয়ে গেছে। তাও জেনে নিবে। সানোয়ারাও তাকে মাঝেমধ্যে তার জন্য কিছু কুড়িয়ে আনতে বলবে। প্রয়োজনে যে আনবে, তাকে কিছু টাকা দেবে নাহয়।

আজকে সানোয়ারা দুপুর একটার জায়গায় আড়াইটা পর্যন্ত না খেয়ে অপেক্ষা করলো। কারণ, শিরিনরা একটু দেরিতেই খায়। হয়তো, তাদের খাবার সময় সানোয়ারার কথা মনে পড়বে, তখন দিয়ে যাবে। কিন্তু না, ভুলেই গেছে মনে হয়।

সানোয়ারা ভুখ আর সইতে না পেরে পাতে ভাত নিয়ে বসে। ধীরেসুস্থে লোকমা মুখে পুড়ে, আশা করে, যদি আনে! পাতের ভাত শেষ হয়, সতীন আসেনা।

এভাবে যখনই দুই তিন বোঁধা কচুর লতি, কখনো এক গামলা শীমের বীচির খোসা ছাড়াতে বা ছোট ছোট ঢেলা মাছ, চিংড়ি মাছ কুটে দিতে তার কাছে রেখে যায় শিরিন, তখন সানোয়ারা আশা নিয়ে বসে থাকে, এক বাটি এনে দেবে বলে।

কিন্তু শিরিনটা বড্ড ভুলো মনের। তার কথা ওর মনেই থাকেনা।

তারা দুইজন মাত্র মানুষ, এতো আয়োজন করে, এতো পদের রান্না করা হয়না ঘরে। শাশুড়ির গালে ঘায়ের একটু সমস্যা আছে। বেশিরভাগ সময় তিনি দুধ কলা মেখে ভাত খেয়ে উঠে যান। সানোয়ারা একা একা কখনো ডাল রেঁধে একটা ডিম ভেজে খেয়ে নেয়। কখনো দুইটা বেগুন একটা টুকরো শুঁটকি দিয়ে রেঁধে দুইবেলা খায়। এক কেজি মাংস রাঁধলে তার সপ্তাহ পার হয়! এতোদিনের বাসী রান্না তার মুখে রুচেনা তাই রেঁধে বাটি ভরে শিরিনকে দিয়ে আসে বেশি করে, যাতে ঐ ঘরের সবাই ভালোভাবে খেতে পায়।

ঘরে একটা ফ্রিজও নেই যে রেখে থুয়ে পরে খাবে।

রমজান মাস আসে। রাঁধাবাড়ার সাথে যুক্ত হয় ইফতার বানানো।

রোজা রাখা , নামাজ কালাম, কোরান তেলাওয়াত করতে তার কষ্ট হয়না। যতটা না কষ্ট লাগে একজন মানুষ সে, তার জন্য চনাভুট করতে বা পেঁয়াজু বেগুনি বানাতে! শাশুড়িকে চারটা চিড়া ভিজিয়ে কলা দিয়ে মেখে দিলে হয়। কিন্তু সানোয়ারার এই রোজা মাসে একটু চনাভূট না হলে কেমন কেমন জানি লাগে। মনে হয়, ইফতার করাই হয়নি।

তা লাগলে লাগুক, সে ভাত দিয়েই ইফতারি সেড়ে নেয়।

গভীর রাতে সেহেরি রাঁধতে উঠা আরেক কষ্টের, হাঁটু আর কোমর ভেঙে পড়তে চায় যেন। তার উপর ডায়াবেটিস বেড়েছে সীমাহীন। বাথরুমের কমোড প্রস্রাবের সাদা চিনি আর কেমন বিশ্রী গন্ধে ভরে যায়।

দুইঘর পর, প্রতিবেশী দূর সম্পর্কীয় এক জা আসে এক দুপুরে। জানতে চায়, কিভাবে কি করে দুই বুড়ো!

তার নিজের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। অভাবের সংসার তার। একমাত্র ছোট ছেলেটি সবে মিডলইস্ট গিয়ে সামান্য কিছু টাকা পাঠাচ্ছে।

জা বলে,

“অ ভাবী, পুরো রোজা মাস আমি ইফতারি বানিয়ে পাঠাবো। আর সেহেরির সময় এক পোয়া ভাত রেঁধে, ঘরে যা তরকারি থাকে, তাই এনে দেবো। তুমি আর কষ্ট করোনা।”

সানোয়ারা না না করে উঠে। জা’টি দোহায় দে, “একটু সেবা করতে দাও, তোমার মেয়েরা থাকলে কি করতোনা?”

সানোয়ারা আর না করেনা। কৃতজ্ঞতায় তার চোখ ছলছল করে।

এখন সানোয়ারা বা তার শাশুড়ি কেউ বেঁচে নেই। এরপর আর মাত্র পাঁচবছর বেঁচেছিলো সানোয়ারা। একরাতে খেয়েদেয়ে খুব অস্থির লাগলে শিরিনের ঘরে গিয়ে ঘাম দিয়ে স্বামীর হাতেই তার প্রাণটা চলে যায়।

যেন হেঁটেহেঁটেই কবরে চলে গেলো। একবছর পর শাশুড়িও।

এখন শুনতে পাই, শিরিন তার শারীরিক যন্ত্রণায় বহুত কষ্টে আছে, তার যখন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়স, তখন থেকেই বিছানায় পেশাব পায়খানা করছে! তার স্বামীও কম কষ্টে নেই। চারছেলে ঘরে বাতিই জ্বালায় শুধু, বাপের আর কোনো কাজে আসেনা।

আর ঐ জা’টি যেন সোনার পালঙ এ বসে দিন যাপন করছে। অভাব আর অসুখ কিছুই তার ধারেকাছে ঘেষতে পারেনি। ভাঙা বেড়া ফেলে ইটের দেয়াল দিয়েছে সে, ছেলের জন্য এনেছে মমতাময়ী এক বউ, সে তাকেও ভালোবাসে মায়ের মতো করে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত