আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে আপনার এই বোবা ছেলেকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে আমাদের স্কুলের নামটা খোয়াব নাকি ।
– না হেড মাষ্টার সাহেব আমার ছেলে জন্মগত বোবা না, ছোট বেলায় বড় ধরনের অসুখ হয়ে বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে । কিন্তু ওর ব্র্যান ভালো স্যার । মুখস্হ সব লিখতে পারে । আর আসে পাশে কোন প্রতিবন্ধী স্কুল নেই যে ছেলেটাকে ওখানে ভর্তি করাবো ।
অনেক পিরাপিরি করার পর সাদিফ কে স্কুলে ভর্তি করে নিল হেড মাষ্টার । কিন্তু সাদিফের সাথে কেউ মিশতে চায় না ও বোবা বলে । এছাড়া স্যারেরা ওকে নিয়ে একটু বিড়াম্বনায় আছে কারণ সাদিফ স্বাভাবিক ছেলেদের মত কথা বলতে পারে না । পড়া জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে পারেনা । অনেক সময় লিখতে দেওয়া হয় তাকে কিন্তু সেটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই তার বসার জায়গা নির্ধারিত হয় ক্লাসের শেষ বেঞ্চে ।
টিফিনের সময় ছেলে মেয়েরা যখন মাঠে খেলা করে, সাদিফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে । কেউ তাকে খেলায় নেয় না । তারও খেলতে মনে চায় । বিহঙ্গের মত মুক্ত আকাশে উড়তে মনে চায় । কিন্তু সে পারে না, তার একটাই ত্রুটি সে বোবা । শিক্ষকরা এখন আর তার দিকে গুরুত্ব দেয়না । কিন্তু সবাইকে চমক দিয়ে প্রথম সাময়িক এবং দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় দশ এর ভিতরে জায়গা করে নেয় সে । কিন্তু সাদিফ তার রেজাল্টে মোটেও খুশি নয় তাকে আরো ভালো করতে হবে তার প্রতি অবহেলার জবাব মুখে না কলমের মাধ্যমে দিতে হবে ।
ফাইনাল পরীক্ষার আর মাত্র একমাস বাকি । টেবিলে বসে সাদিফ হারিকেনের ক্ষীণ আলোয় মাথা ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে মনে মনে পড়তে থাকে । তার মা দাওয়ায় বসে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাদিফের দিকে । কেন ভাগ্য বিধাতা তার একমাত্র ছেলেটা কে বোবা করে দিল । সাদিফ লক্ষ্য করে তার মা তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । সাদিফ ইশারা দিয়ে মাকে বুঝানোর চেষ্টা করে কি ব্যপার আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন ? তার মা তাকে বলে কিছু না বাবা এমনি তুই পড় । তোকে যে ভালো রেজাল্ট করতে হবে বাবা । অনেক খানি পথ হেটে সাদিফ কে স্কুল যেত হয় । পথি মধ্যে সাদিফ দেখতে পায় একটি বৃদ্ধ লোক গাছের নিচে বসে হাঁপাচ্ছে, খুবই ক্লান্ত । সাদিফ কে দেখে তাকে ইশারায় ডাক দেয় ।
-বাবা তোমার কাছে পানি হবে ?
সাদিফ কোন কথার উত্তর দেয় না কিন্তু তার পানির ফ্লাক্স থেকে তাকে পানি খাওয়ায় । টিফিনের খাবার টুকু তাকে ইশারায় খেতে বলে ।
-বাবা তুমি কথা বলতে পার না ??
সাদিফ মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয় সে কথা বলতে পারে না । বৃদ্ধ তার মাথা হাত বুলিয়ে দেয় । বেঁচে থাক বাবা বেঁচ থাক নিশ্চয় আল্লাহ তোমার মুখের জবান ফিরিয়ে দিবেন । পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে । প্রতিটি পরীক্ষাই খুবই ভাল দিয়েছে সাদিফ । সদিফের বিশ্বাস সে এবার প্রথম হবেই । তার প্রতি সবার অবহেলার জবাব ভালো ভাবেই দিবে যদি সে প্রথম হতে পারে । আজ সেই দিন, পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশের দিন । মাঠের মাঝখানে বিশাল প্যান্ডেল করা হয়েছে । স্থানীয় চেয়ারম্যান কে প্রধান অতিথি করা হয়েছে । আর চেয়ারম্যানই আজকে প্রতিটি ক্লাসের রেজাল্ট ঘোষণা করবে । প্রথমেই উপরের ক্লাসের প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় স্থান অধিকারীদের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে এবং যে ক্লাসে প্রথম হচ্ছে তাকে সবার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে বলা হচ্ছে । একে একে সব ক্লাসের রেজাল্ট ঘোষণা শেষ । এবার সাদিফদের ক্লাসের রেজাল্ট ঘোষণার পালা ।
সাদিফের ভিতরটা খুবই কাঁপছে সে কি পারবে তার মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে । সাদিফ মাথা নিচু করে বসে আছে । চেয়ারম্যান সাহেব ঘোষণা দিলেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে মোঃ সাদিফ । সাদিফ লাফিয়ে উঠলো, চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হলো না । সাদিফ স্টেজে উঠে চেয়ারম্যানের হাত থেকে রেজাল্ট সিট নিল । চেয়ায়ম্যান তাকে অনুরোধ করলো সাদিফ বাবা তুমি সবার উদ্দেশ্যে কিছু বল । কারণ সে জানেনা সে বোবা । সাদিফ মাইক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না । তার ঠোঁট কাঁপছে কিছু বলার জন্য, মুখ দিয়ে শুধু আঁ আঁ শব্দ বের হচ্ছে । কে যেন একজন তাচ্ছিল্যের সহিত বলে উঠলো আরে ও কি বলবে ওতো বোবা ।
সাদিফের কানে সেটা প্রতিধ্বনি হতে লাগলো ওতো বো ওতো বোবা সাদিফ প্রাণ পণে কিছু বলতে চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু কথা বের হচ্ছে না । এক সময় কিভাবে যেন তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসলো । না আমি বোবা না আমি বোবা না । আকাশে বাতাসে তার কথার প্রতিধ্বনি হতে লাগলো । সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো এক বোবা ছেলেটার দিকে । স্টেজে বসা তার মা, বাবার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরতে লাগলো । এই অশ্রু আনন্দের অশ্রু এই অশ্রু বিজয়ের অশ্রু। সাদিফ লক্ষ্য করলো স্টেজের শেষ মাথায় জীর্ণ শরীরের একটা লোক তার দিকে তাকিয়ে হাসছে । সেই হাসিটা বড়ই রহস্যময় । লোকটাকে তার চেনা চেনা মনে হচ্ছে ।