— “কি করো?”
— “অক্সিজেন নেই এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়ি।”
— “আরে হাত, পা, মুখ দিয়ে কি করতেছো?”
— “হাত দিয়ে ফোন ধরে আছি। পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।”
— “উফ্… প্রশ্ন করাই ভুল হইছে।”
— “আর মুখ দিয়ে একটা বড়লোক বাপের প্রতিবন্ধী মেয়ের সাথে কথা বলছি। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী।”
— “তো, আমায় জিজ্ঞেস করো আমি কি করি?”
— “তুমি কি করো?
— “একটা বদ্ধপাগলের সাথে প্রেম করতেছি।”
— “আমরা জানি, প্রকৃতি সমতা পছন্দ করে। যেহেতু একটি পাগল পুরুষের সহিত একটি নারী প্রেম করিতেছে, সেহেতু নারীটিও পাগলী। প্রুভড।”
— “তোর সাথে থাকলে যে কেউ পাগলী হয়ে যাবে।”
— “সেম টু ইউ।”
— “অনেক হইছে। মাফ চাই।”
— “এই মধ্যরাতে ফোন দিলে কেন সেটা আগে বলো তো।”
— “এমনি ঘুম ভেঙে গেল তাই। তুমি এখনো ঘুমাও নি তাইনা? কি করো এত রাতে?”
— “সত্য বলবো নাকি মিথ্যা?”
— “অবশ্যই মিথ্যা নয়।”
— “আমি এখন রাস্তায়। চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি। মধ্যরাতে একা একা রাস্তায় হাঁটার এক অন্যরকম অনুভূতি। তুমি কখনো এমন করেছিলে?”
— “আমায় কি তোমার এতটাই পাগলী মনে হয়?”
— “এর থেকেও বেশি।”
— “তোমার উপর আজ আমার অনেক মন খারাপ। ইচ্ছে করছে তোমার মুখটা পানির মধ্যে চুবাই। না না পানির মধ্যে না। কাদার ভিতর চুবাই।”
— “কেন?”
— “তুমি খুব উল্টাপাল্টা একটা মানুষ। তোমার কিছুই মনে থাকে না। সরি সরি। তোমার একটা জিনিশ খুব ভালো মনে থাকে। সেটা হলো খুঁজে খুঁজে পূর্নিমা রাতে জোছনা দেখা। অদ্ভুত পাগলামি।”
— “আজ রাতে সিগারেট খাওয়া হয়নি। খুব সিগারেটের পিপাসা লাগছে। মনে হচ্ছে তিনদিন থেকে পানি খাইনা।”
— “তুমি কি জীবনেও একটু গোছালো, স্বাভাবিক হবে না? হ্যাঁ?”
— “মিথি…”
— “বলো।”
— “আমার এখন খুব চিৎকার করে গান গাইতে ইচ্ছে করছে। তোমার সাথে কথা বলতে একদমই ভালো লাগছে না। ফোনটা রাখো এবং ঘুমাও। আমি গান গাইবো।”
— “আমি ঘুমাবো না। আজ সারারাত জেগে থাকবো। ভোরে ঘুমাবো। তারপর কাল দুপুরে ঘুম থেকে উঠবো। কেমন হবে বলোতো?”
— “খুবই জঘন্য। শুনেই আমার বমি আসছে।”
— “তুমি নিজের অভ্যাস গুলোকেই দেখি জঘন্য বলছো।”
— “আমি মনের বিরুদ্ধে কিছু করি না তা তুমি জানো। তোমার সাথে কথা বলে এই সুন্দর সময়টাকে আর নষ্ট করতে চাচ্ছিনা। তুমি ঘুমাও।”
— “ঘুম ধরবে না।”
আমি ফোনটা কেটে দিলাম। তারপর ফোন বন্ধ করলাম। আমি এখন রাস্তায় না। ঘরের ভিতর বিছানায় শুয়ে আছি। মিথিকে মিথ্যা বলেছি। মিথিকে আমি প্রচুর মিথ্যা বলি। যদিও মিথ্যা গুলো ছোটখাটো। তবুও বলি। মিথির দুইটা কারণে খুব মন খারাপ। প্রথমত, আজ মিথির জন্মদিন। মিথি হয়তো আশা করেছিল আমি বারটা এক মিনিটে ওকে ফোন দিয়ে ছোট করে বলবো, “শুভ জন্মদিন মিথি।” আর দ্বিতীয়ত, আমি মিথির সাথে মাত্র খারাপ ব্যবহার করলাম। জানি আজ রাতে মিথি ঘুমাই নি। আমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলো। কেননা মিথির কাছে আজ রাতটা খুবই স্পেশাল। শুধু জন্মদিনের জন্যই না। এই জন্মদিনেই মিথি আমায় প্রপোজ করেছিল। যদিও আমি জানি আমি মিথির কাছে কিছুই না। তবুও প্রপোজ করেছিল।
মিথি সমাজের সবার কাছেই সুন্দরী। মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরী। কিন্তু আমার কাছে মিথিকে কেন জানি কিছুটা চাকমা আকৃতির মনে হয়। এই মনে হওয়াটা আমি মনের মধ্যেই রেখে দিয়েছি। আদৌ কাউকে বলিনি। কেননা যাকেই বলবো, সে নির্ঘাত একটা পাগলা গারথের ঠিকানা খুব যত্ন সহকারে খাতায় লিখে আমায় দেবে। মিথি আমায় হয়তো অস্বাভাবিক ভাবে ভালোবাসে। কারণটা আমি আজও আবিষ্কার করতে পারিনি। কি আছে আমার মাঝে? কিছুই তো খুঁজে পাইনা। আচ্ছা আমি কি মিথিকে ভালোবাসি? এই প্রশ্নের উত্তরও আমি আজও পাইনি। শুধু জানি আমি খুবই স্বার্থপর। হয়তোবা মিথির এতো ভালোবাসা পাওয়ার লোভে আমি ভালোবাসার অভিনয় করছি। অভিনয় করছি কিনা সেটাও জানিনা। আসলে ভালোবাসা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই।
মিথির জন্য একটা শাড়ি কিনেছি। শাড়ির কালারটা নীল নাকি আকাশী তা ঠিক বুঝতে পারছি না। শাড়িটা মিথির জন্য কিনেছি, কিন্তু আমি কি মিথিকে এটা দিতে পারবো? মিথি তো শাড়িটা পেলে খুশিতেই কেঁদে দেবে। কেননা আমি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ খুব কম করি। মিথিকে এতটা খুশি করানো কি ঠিক হবে? এসব ভাবতে ভাবতেই এই মধ্যরাতে আমি পাঞ্জাবি পড়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে শাড়িটা হাতে নিয়ে খুবই সতর্কতার সাথে চুপিচুপি বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম। আমি মিথির দোতলা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে। ওদের বাসার সামনে ছোট প্রস্থের একটা পাকা রাস্তা। খুবই কম মানুষ যাতায়াত করে এই রাস্তায়। রাস্তার একপাশে শুধু ফাঁকা জমি। আমি ভূত প্রেত বিশ্বাস করিনা। তবুও আমার কিছুটা ভয় লাগছে। হালকা কুয়াশা চারপাশে। চাঁদটা অর্ধেক। জোছনার আলো খুবই ঝাপসা। আজ পূর্ণিমা হলে হয়তো খুব ভালো হতো। আমি শাড়িটা মিথির গেটের নিচে রাখলাম। তারপর ফোনটা চালু করে মিথিকে ফোন দিলাম,
— “মিথি…”
— “বলো।”
— “মন খারাপ?”
— “পাগলীদের মন খারাপ করতে নেই। পাগলীরা মন খারাপ করে না।”
— “তোমার গেটের নিচে একটা শাড়ি আছে। তুমি শাড়িটা পড়ে বাহিরে আসবা। আমি তোমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। চোখে হালকা করে কাজল দিবা। ছোট্ট একটা কালো টিপ পড়বা। টিপটা ইচ্ছে করেই ভুল জায়গায় পড়বা।”
এই বলে আমি ফোনটা কেটে দিলাম। আমি জানি মিথির মনে এখন কয়েকটা জিনিশ একই সাথে ঘুরছে। অবাক, ভয়, আমার উপর প্রচুর রাগ ইত্যাদি। পনের মিনিট পর মিথি খুবই চুপিসারে গেট গলিয়ে বেরিয়ে আসলো। এসেই আমায় দাঁত কড়মড় করে বললো?
— “তুমি তো প্রথম শ্রেণির পাগল। এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও।”
আমি চাঁদের ক্ষীণ আলোয় দেখলাম মিথি ঠিকই শাড়ি পড়েছে। চোখে কাজল দিয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। চুলগুলো খোলা। কালো টিপটা সত্যি সত্যিই ভুল জায়গায় পড়েছে।
— “কথা কানে যাচ্ছে না? এখান থেকে চলো। কিছুক্ষণ হাঁটবো। তারপর তুমি চলে যাবে। আজ তোমার বিচার করবো না। কাল করবো।”
আমি কিছুটা ঘোরের মধ্যে আছি। মিথি আর আমি পাশাপাশি খুব সন্তপর্ণে হাঁটছি। যতটা সম্ভব আস্তে আস্তে হাঁটছি। দুজনেই চুপচাপ। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। শুধু আমাদের হাঁটার শব্দ কানে আসছে। আচ্ছা আজ পাখি ডাকছে না কেন? হঠাৎ মিথি বললো,
— “চুপচাপ যে? ভয় লাগছে?”
— “না।”
— “তো?”
— “শুভ জন্মদিন মিথি।”
মিথি চুপ হয়ে গেলো। তারপর কিছুটা রাগ হওয়ার মিথ্যা অভিনয় করে বললো,
— “গাধা, জন্মদিনে বারটা এক মিনিটে উইশ করতে হয়।”
— “আমি ওই নিয়মে বিশ্বাসী না।”
— “কেন?”
— “যে যখন জন্মেছে তাকে ঠিক সেই সময়েই উইশ করা উচিৎ। যেমন আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি তুমি ঠিক এরকম অর্ধ পূর্ণিমায় মধ্যরাতে হয়েছো। তাই তোমায় এখন উইশ করলাম।” মিথি আবারও চুপ হয়ে গেলো। আমি সম্পূর্ণ মিথ্যা বললাম। মিথি কখন হয়েছে তা আমি জানিনা। মিথি খুব আস্তে আস্তে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
— “ধন্যবাদ।” মিথি আবারো কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললো,
— “আজ চাঁদটা একেবারে বড় গোল হলে খুব ভালো হতো তাইনা?”
— “না।”
— “কেন?”
— “কারণ তখন তোমার সৌন্দর্যের চেয়ে চাঁদের সৌন্দর্য বেশি ফুটে উঠতো।”
— “তারমানে চাঁদই বেশি সুন্দর আমার থেকে?”
— “অবশ্যই।”
মিথির হয়তো কিছুটা মন খারাপ হয়ে গেলো। হয়তো কিছুটা মিথ্যা প্রশংসা আশা করেছিলো। আমি হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, মিথি হালকা শীতে কিছুটা কাঁপছে। হয়তো মেয়েটা আমায় শাড়ি দেখাবে বলে চাদর পড়েনি। আমি মিথিকে বললাম,
— “মিথি চাদরটা একটু ধরো তো। আমার চাদর পড়ে গরম লাগছে।”
মিথি বুঝে ফেললো আমার অযুহাত। মিথি খুবই চুপচাপ চাদরটা নিয়ে ওর শরীরে জড়িয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর আমারও হালকা ঠান্ডা লাগতে শুরু করলো। বিষয়টা মিথির চোখ এড়ালো না। মিথি খুবই চঞ্চলতার সাথে বললো,
— “আচ্ছা, আমার জিনিশ মানেই তো তোমার অর্ধেক, আমার অর্ধেক। আবার তোমার জিনিশ মানেই তো আমার অর্ধেক, তোমার অর্ধেক। তাইনা?”
— “হুম।”
— “তবে তোমার চাদর আমি একাই কেন পড়েছি? হ্যাঁ? এটা তো ঠিক না। দু’জনই অর্ধেক অর্ধেক। কাছে আসো।”
আমি একটা মৃদু হাসি দিলাম। মিথি আমায় অর্ধেক চাদর দিয়ে দিলো। আমরা দু’জনই চুপচাপ হাঁটছি। কেউ কথা বলছি না। কথা বলতে পারছি না। একেই হয়তো জীবনের সেরা মুহুর্ত বলে। মিথি কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
— “কালো টিপটা ভুল জায়গায় পড়তে কেন বলেছিলে?”
— “আমি ঠিক করে দেবো বলে।”
আমি মিথির টিপটা খুলে ঠিক জায়গায় পড়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। কেননা মিথির কপাল কাঁপছে। আমার হাতও দেখি কাঁপছে। আচ্ছা, আমার হাত কাঁপছে কেন? তারমানে কি আমি ভালোবাসার মানে বুঝতে শুরু করলাম?