মধ্যবিত্তের সাধ

মধ্যবিত্তের সাধ

হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় যেতেই দেখি নাদিম চেয়ারে বসে ঢুলছে। কাছে গিয়ে বললাম, “চা খাচ্ছি। চা খাবে? ঢেলে দিই?”

সম্ভবত চায়ের কথা শুনে কিংবা আমার কণ্ঠ কানে যেতেই নাদিম তড়াক করে উঠে বসল। আমার হাত থেকে আদা চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল, “জীবনটা বড়ই বেদনাময়।”

আদার চেয়েও তীব্র ঝাঁজ আমার গলায় এনে বললাম, “তা হবে না? সারাক্ষণ অফিসেই কাটাও। জীবনে আনন্দ বলে তোমার আছে কিছু?”

নাদিম আমার সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল। জীবন যে নিমপাতার চেয়েও তেতো তা সে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছে। আমি নাদিমকে ভ্রমণের উপকারিতা বিষয়ে এক ঘন্টার স্বল্প ভাষণ দিয়ে জানতে চাইলাম, “তোমার কি মনে হয় না আমাদের কোথাও একটু ঘুরতে যাওয়া উচিৎ?”

ভাষণে বেশ কাজ হলো। নাদিম উৎফুল্ল চোখে বলল, “অবশ্যই যাওয়া উচিৎ। একশবার যাওয়া উচিৎ। কিন্তু টাকা?”
– টাকার চিন্তা কোরো না। আমার কাছে বেশকিছু জমানো টাকা আছে। কোথায় যাওয়া যায় বলো তো? কক্সবাজার?
– ওখানে এতো বড় সমুদ্রে তুমি হারিয়ে গেলে আমি আমার কণাকে কোথায় পাবো বলো তো?
– তাহলে বান্দরবান?
– ওতো উঁচু পাহাড় থেকে একবার পড়লে আর হাত পা আস্ত থাকবে ভেবেছ?
– তাহলে আর কোথায় যাওয়া যায়?
নাদিম চোখ জ্বলজ্বল করে বলল, “চলো তোমার বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। ঘুরাও হবে, খাওয়াও হবে।”
আমি নাদিমের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। সেই আগুনে নাদিমের ইচ্ছা ভষ্ম হয়ে গেল!

অতঃপর বহু জল্পনা কল্পনা তর্কাতর্কি শেষে আধঘন্টা পর দুইজন সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম আমরা গাজীপুর রিসোর্টে যাবো। নাদিম বলল, “ওখানে যাওয়ার আগে ভালো একটা শার্ট কিনতে হবে।”
– আমার স্বর্ণের কানের দুলের হুকটা ভেঙে গেছে। নতুন গড়িয়ে নিতে হবে।
– ওখানে গেলে মায়ের জন্য একটা শাল কিনে নিব কি বলো?
– আমার মাকে একটা শাড়ি না দিলে কেমন দেখা যায়?
– ঠিকাছে। বোনটার জন্যও দুইমুঠো চুড়ি কিনে নিবো নে।
– তোমার শালা কত করে বলছিল ওর একটা নতুন হ্যান্ডসেট দরকার।

দুজনে মিলে হিসাব কিতাব করে দেখলাম, এই জার্নিতে সবকিছু মিলিয়ে মোট বিশ পঁচিশ হাজার টাকা তো লাগবেই! এতো টাকা আপাতত দুজনের সঞ্চয় মিলালেও জমবে না।

অবশেষে দুইজন ঠিক করলাম রমনা পার্কে ঘুরতে যাবো এবং আসার সময় দুইজন কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে বসে উদরপূর্তি করে আসবো। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত!

দুইজন যখন ভবিষ্যতের আনন্দময় জীবনের ভাবনায় বিভোর তখন কর্কশভাবে বেল বেজে উঠল। কে এসেছেন? আমাদের কর্কশ বাড়িওয়ালা এসেছেন। এই লোকটা যখনই আসেন কোন না কোন অফিযোগ নিয়ে আসেন। গলা ফাঁটিয়ে আমাদের দোষ গাইতে গাইতে পানের পিক চারদিকে স্প্রে করে দেন! বিচ্ছিরি অবস্থা হয়।

এবারও ব্যতিক্রম নেই। সোফায় বসতে বসতে বললেন, “এই বিকালবেলা তোমাদের বিরক্ত করলাম। কিছু মনে কোরো না।”
“অবশ্যই মনে করে করেছি। একশবার মনে করেছি।” কথাটা মনে মনে আওড়ে হাসিমুখে বললাম, “না চাচা কিছুই মনে করিনি।”
– অসময়ে এলাম।
– খুব ভালো সময়ে এসেছেন। আমরা প্ল্যান করছিলাম বাইরে কোথাও ঘুরতে যাবো।
– ভালো খুব ভালো। তবে যাবার আগে আমার বাড়িভাড়াটা দিয়ে যেও। দুইমাসের ভাড়া বাকি পড়ে আছে। মোট বারো হাজার টাকা।

আমি সরুচোখে নাদিমের দিকে তাকালাম। বেচারা কাঁচুমাচু করছে। এই মাসের বেতন হাতে পেতে আরও দেরি। তার উপর কয়দিন পরপর ক্রমাগত বাড়িওয়ালা ভাড়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন।

আমি ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেলাম। ড্রয়ার থেকে গুনে গুনে পনেরো হাজার থেকে বারো হাজার টাকা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ভাড়া বুঝে পেয়ে বাড়িওয়ালা আনন্দে ডগমগ। নাদিমকে দেখলাম মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে।

বাড়িওয়ালা পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসতে হাসতে টাকাগুলো নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ ব্যথিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। চোখ ফিরিয়ে দেখলাম নাদিম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। সে চোখে শুধুই শূন্যতা!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত