রাবেয়া তখন অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী। এক ঝুম বৃষ্টির রাতে হঠাৎ প্রচন্ড পেটে ব্যাথা শুরু হয়। ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন ২ টা বেজে দশ। এতো রাতে ডাক্তার পাওয়াও দুস্কর। অথচ রাত পেরোলেই সকাল ১০ টায় রাবেয়াকে পরীক্ষার টেবিলে বসে ইতিহাসের কিচ্ছাকাহিনী লিখতে হবে। ধুরছাই এই ইতিহাস পড়তে আর ভাল লাগে না রাবেয়ার। নিজের পেটের ইতিহাসই তো তেমন ভাল না। প্রায়ই পেটের ব্যাথায় কাৎরায় আর শুকনো মরিচের গুষ্টি উদ্ধার করে।
মা প্রায়ই ধমকায় এতো শুকনো মরিচ খেলে তো পেট ব্যাথা করবেই। মায়ের কথা গুলো রাবেয়ার কাছে অমূল্য মনে হয় যখন সে ব্যথায় ছটফট করে। আর পেট ব্যথা ভাল হয়ে গেলেই বলে- ধুর মা কি বুঝে। শুকনো মরিচের মজা যে খায় সেই জানে।
সময় বাড়ছে। বৃষ্টির বেগও বাড়ছে। রাবেয়ার পেটের ব্যাথা তার থেকেও দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু এতো রাতে এই ঝড়ের রাতে ডাক্তার কোথায় পাওয়া যায়। রাবেয়ার ছোট ভাই ইয়াসির বললো- “মা ওয়াসিম ভাইয়াকে নিয়ে আসি। উনি তো এখন ইন্টার্নি করতেছে।”
মা বলল- “ঐ পোলা ডাক্তার হইলো কবে। ও তো ফার্মেসিতে চাকরি করে।” ইয়াসির বলল- “মা ঐ ওয়াসিম না। ফার্মেসি তে চাকরি করে ওরা থাকে দোতলায়। ওয়ামিস ভাইয়ারা থাকে তিন তলায়।”
“ও ঐ চশমা পরা পুলাডা? কিন্তু আনতে পারবি এতো রাইতে। ও কি আসবো?” মুখে উদ্বেগ নিয়ে মা বলল।
“দেখি” বলে ইয়াসির রাবেয়ার বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো। রুম থেকে বের হওয়ার আগেই রাবেয়া চোখ মুখ বিকৃত করে চিৎকার করে উঠলো- ” খবরদার ইয়াসির ঐ চশমিস রে আনবি না।” মা বলল- ” ক্যান, আনবেনা ক্যান?”
রাবেয়া বলল- ” আমি কোন ছেলে ডাক্তার দেখাবো না।” মা ধমক দিয়ে বলল- ” চুপ থাক তুই। খা আরো শুকনা মরিচ খা। পানি দিয়া গুলাইয়া খা। ছোটন তুই যা চশমাডারে নিয়া আয়।”
ইয়াসির অবাক হয়ে বলে- ” চশমা আনবো মানে।” মা জিহবায় কামড় দিয়ে বলে – ” আরে ঐ চশমা পরা পুলাডারে নিয়া আয়।” মায়ের কথা শুনে দুভাই বোন হেসে উঠে। হাসতে গিয়ে পেটে প্রচন্ড ব্যাথা করে উঠে রাবেয়ার। মনে মনে শুকনো মরিচের জ্ঞাতি গুস্টি উদ্ধার করে।
“খবরদার হাত ধরবেন না।” খেপে উঠলো রাবেয়া। ওয়াসিম বিরক্ত এবং অবাক হয়ে বলল- “পালস দেখবো। আপনার হাত ধরবো কে বলল আপনাকে।” রাবেয়া আরো ক্ষেপে গিয়ে বলল- ” ঐ ঐ একই কথা আপনি ছুঁবেন না আমাকে।” মা খুব অবাক হলো। রাবেয়া এর আগেও ডাক্তারের কাছে গেছে। অনেক পুরুষ ডাক্তারও ছিল। কিন্তু পালস দেখা নিয়ে এমন তো করে নাই কখনো। মা বকা দিয়ে বলল- “রাবু চুপ থাক। চশমা তুমি…” জিহবায় কামড় দেয় মা। তারপরে ঢোক গিলে বলে- “বাবা তুমি দেখ। ”
ওয়াসিম পালস ধরার জন্য রাবেয়ার কব্জির কাছে হাত রাখে। রাবেয়া হাল্কা কেঁপে উঠে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করে ওর পেটের ব্যথা গায়েব। বাংলা সিনেমা বা সস্তা গল্প উপন্যাস হলে ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হতো। কিন্তু বাস্তবে কি করে সম্ভব। রাবেয়া তাকিয়ে আছে ওয়াসিমের দিকে। ওয়াসিম ওর পালস গুনছে হাত ঘড়ির দিকে এক দৃস্টিতে তাকিয়ে।
রাবেয়ার কাছে মনে হলো। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে পালস গোনাটা এই পৃথিবীর সেরা একটা দৃশ্য। এর আগে কোন ডাক্তারকে ও এভাবে পালস গুনতে দেখেনি।
“রাতে কি খেয়েছেন?” হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল ওয়াসিম। রাবেয়ার মনে হলো পালস এক মিনিট দেখতে হবে কেন। কেন পাঁচ মিনিট না। কেন ১ ঘন্টা না। রাবেয়া কিছু বলার আগেই মা বলল- “শুকনা মরিচ দিয়ে ঝাল করে চাপা শুঁটকির ভর্তা, আলু ভর্তা। আর মাসকালাইয়ের ডাল।”
ওয়াসিম বলল- “ঝাল খাবার বাদ দিতে হবে। না হলে স্টোমাকের আরো ক্ষতি হবে। আজ থেকে কোন শুকনা মরিচ না। ওষুধ লিখে দিচ্ছি এগুলো খেলে সেরে যাবেন।” ওয়াসিম মুখস্ত কথা গুলো বলে গেল। ওয়াসিম বাসায় আসার পরে মা ই শিখিয়ে দিয়েছে যেন রাবেয়া কে শুকনো মরিচ খেতে নিষেধ করে। ওয়াসিম শার্ট থেকে বৃষ্টির পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল- আচ্ছা।
ওয়াসিমকে এক গ্লাস জুস এনে দিল কাজের মেয়ে লাকি। গ্লাস হাতে নিয়ে এক চুমুকে পুরো গ্লাস খালি করে ফেললো। রাবেয়ার কাছে মনে হল, মানুষটা এতো সুন্দর করে কিভাবে জুস খায়। ওর ইচ্ছা করছে আরো জুস খাওয়াতে। হঠাৎ খেয়াল হলো ও এসব কি ভাবছে। নিজেকে ধমক দিলো রাবেয়া। বাংলা সিনেমা নাকি। ধুর কোথাকার কে। তাকে নিয়ে কি আবোলতাবোল ভাবছে।
ওয়াসিম বিদায় নিয়ে চলে গেল। দোতলা থেকে শুনতে পেলো রাবেয়াদের বাসার কলাপসিপল গেট খোলা হচ্ছে। আবার বন্ধ হয়ে গেল। রাবেয়ার বুক কেমন যেন ফাকা ফাকা লাগছে। পেটের ব্যথা আবারো ফিরে এলো। মুখ শক্ত করে পেটের নিচে বালিশ দিয়ে উপুর হয়ে শুয়ে থাকলো রাবেয়া। কখন যে একসময় ঘুমিয়ে পরলো ও নিজেও জানে না।
রাবেয়ার মা খেয়াল করলো গত ২ মাস ধরে রাবেয়া একবারও শুকনো মরিচ খায়নি। কিন্তু এটা বুঝতে ওনার এতো সময় লাগলো কেন এটাই উনি বুঝতে পারছেন না। সেদিন মা মেয়ে দুজন শপিং করে বাসায় ফেরার সময় ফুচকা খেল। যেই রাবেয়া এক গাদা ঝাল না নিলে ওর পোসায় না সেই রাবেয়া কোন ঝালই নিলো না। ব্যাপারটা তো ঐদিন ই খেয়াল করা উচিত ছিল উনার। যাকগে মেয়ে এখন শুকনা মরিচ খায় না। রাত দুপুরে পেটের ব্যথায় কষ্ট পায় না এতেই উনি খুশি।
রাবেয়া আজ অনেকদিন থেকেই ভিতরে ভিতরে খুব অস্থির হয়ে আছে। ছটফট করছে ওয়াসিম কে দেখার জন্য। কিন্তু ব্যাস্ত ডাক্তার কে শুধু বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সেই সকাল ৮ বাজেই শুধু দেখে। কখন ওয়াসিম বাসায় ফিরে জানেনা। মাঝরাতে সামনের বিল্ডিংয়ের কলাপসিপল গেটের শব্দ হলেই দৌড়ে জানালার কাছে ছুটে যায়। কিন্তু ওয়াসিম কে আর দেখতে পায় না।
মনে মনে খুব গালি দেয় রাবেয়া- “ডাক্তার গুলা সব বেঈমান। সেই যে আসলো আর একবার আসার প্রয়োজনও মনে করলো না। আমি সুস্থ আছিনা মরে গেছি সেটা জানারও প্রয়োজন মনে করলো না। সব ডাক্তার বেঈমান।” “আমার চেম্বারের ঠিকানা কোথায় পেলন?” মুখে অবাক হওয়ার ছাপ স্পট ওয়াসিমের। রাবেয়া গা ছাড়া ভাবে বলল- “সে দিয়ে আপনার দরকার কি। আপনার চেম্বারে যেহেতু আসছি সেহেতু আমি রোগী। নেন পালস দেখেন।” বলে হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিলো রাবেয়া। ওয়াসিম হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে চশমা টা ধরে নাকের উপর বসিয়ে বলল- “কি হয়েছে আপনার। পেটের ব্যাথা এখনো সাড়েনি।” রাবেয়া মুখে ঝামটা দিয়ে বলল- ” সেটা জেনে আপনার লাভ কি। আপনাকে পালস দেখতে বলেছি দেখুন।”
ওয়াসিম মুচকি হেসে রাবেয়ার কব্জি ধরে পালস গুনছে। রাবেয়ার ভাবছে মানুষ টা এতো সুন্দর করে কিভাবে হাসে। ঠিক আগের মতো বিড়বিড় করে পালস গোনা। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ ফাটিয়ে বাজ পরছে। হঠাৎ রাবেয়ার প্রচন্ড পেট ব্যাথা শুরু হলো। ব্যাথায় ঘুম ভেংগে গেছে ওর। পাশের মানুষটা কে ধাক্কা দিচ্ছে- ” এই এই… এই শুনছো। উঠো খুব পেট ব্যাথা করছে।” ওয়াসিম কাঁচা ঘুম থেকে জেগে বলল- “খাও আরো বেশি করে শুকনা মরিচ খাও। কত করে বললাম যে এইসব তোমার সহ্য হয় না খেয়ো না।” “আমার পালস টা দেখে দাও না। এতো বকছো কেন আমাকে।” মুখে অভিমান ফুটিয়ে বলল রাবেয়া।
৫ মাস আগের কথা…
রাবেয়া ওয়াসিমের চেম্বারে প্রথমবার যাওয়ার পরে প্রায়ই যেত এরপর। অকারণ অহেতুক কিছু কথা বলতো। পালস চেক করাতো। তারপরে হুট করে বের হয়ে চলে আসতো। চলে আসার আগে বলতো ও না যাচ্ছি। দু দিন পরে আবার এসে হাজির হতো। আর ওয়াসিম রাবেয়ার এইসব কাজকারবার দেখে মুচকি মুচকি হাসতো কেবল। একদিন রাবেয়া বাসন্তি রংয়ের শাড়ি খোপায় গাদা ফুল পরে চেম্বারে হাজির। ওয়াসিম অবাক হয়ে যায়। আজ তো ১লা ফাল্গুন না। এইদিন ছাড়া মেয়েরা বাসন্তি রংয়ের শাড়ি পরলে মনে আজ বুঝি মেয়েটার গায়ে হলুদ।
ওয়াসিম মুখ ফোসকে বলেও ফেললো- ” আজ কি আপনার গায়ে হলুদ নাকি?” বলে বেশ শব্দ করে হেসে উঠলো। এতোদিনে এই প্রথম রাবেয়া ওয়াসিমের প্রাণখোলা হাসি দেখতে পেলো। রাবেয়ার বুকে দামামা বাজছে। যে করেই হোক এই হাসি শাড়ির আঁচলে বাঁধতেই হবে। সেটা আজই। এক্ষুনি। “হ্যাঁ আজ আমার গায়ে হলুদ কাল বিয়ে।” বলে হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল- “নেন পালস টা দেখে দেন।” ওয়াসিম হাসতে হাসতে পালস গুনছে আর একটু একটু মাথা ঝাঁকাচ্ছে। “তা বিয়ের দাওয়াত দিবেন না?” ওয়াসিমের মুখে এখনো হাসি লেগে আছে। রাবেয়া বলল- “সেই জন্যই তো এসেছি। এই নিন জনাব দাওয়াত পত্র।” হাতের খামটা দিয়েই ঝড়ের বেগে চেম্বার থেকে বের হয়ে গেল রাবেয়া।
খাম টা খুলে একটা ছোট চিরকুট বের করলো ওয়াসিম। চিরকুটে লিখা- “আমায় একটা ঘুড়ি কিনে দিবেন। শুধু আপনার আকাশে উড়াবো।” একমুহুর্তে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল ওয়াসিমের। এই মেয়েকে কিছুতেই হারানো যাবে না। সেও প্রায় ঝড়ের বেগে চেম্বার থেকে বের হয়ে এলো। বাইরে এসেই দেখতে পেল রাস্তার ওপাড়ে একটা রিক্সায় মুখটা নিচু করে বসে আছে রাবেয়া।
রাস্তা পার হয়ে রিক্সার কাছে যেতেই একদিকে সড়ে বসলো রাবেয়া। রাবেয়ার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে আছে নাকি এটা মেকাপের রং বুঝতে পারছেনা ওয়াসিম। কিন্তু লজ্জা রাবেয়ার পুরো মুখোমন্ডলেই ছড়িয়ে আভা ছড়াচ্ছে। ওয়াসিম রিক্সায় উঠতেই রাবেয়া মাথা আরো নিচু করে ওয়াসিমের কনুইয়ের কাছে শার্ট খামছে ধরলো। ওয়াসিম অবাক হয়ে আড় চোখে তাকালো রাবেয়ার দিকে। রাবেয়ার সারা শরীর কাঁপছে।