অভাগী মা

অভাগী মা

– ‘বাবা, রাতে খেয়েছিস?’ ফোনের ওপাশ থেকে বললেন সিয়ামের মা।

~ ‘আচ্ছা, মা বলতো; আমি ভাত খেয়েছি কি খাইনি, এইটা আমার ব্যাপার। তোমার এত মাথাব্যাথার কি আছে এই বিষয়ে?’ চোখ দুটো অগ্নির ন্যায় লাল করে বলল সিয়াম।

– ‘বাবা, জনিস না তোকে ফেলে খাওয়া হয়না। শহরে গেলি আজ কতদিন। কি খাস, কি না খাস, তা তো কোনোদিন ও দেখা হয়না। বাসায় আয় বাবা, অনেক মনে পড়ে তোকে। আসবি বাবা?’

~ ‘আজ ও তোমার কাছে সেই ছোট্টটা রয়ে গেলাম? কি আশ্চর্য! আর আমাকে এত বিরক্ত করার কি আছে বল তো? জানই তো শহরে এসেছি পড়ালেখা করতে। আমি আপাতত বাসায় আসতে পারব না।’

– ‘বাবা, সামনে রমজান। এই রমজান মাসটা আমাদের সাথে কাঁটা। তোর বাবা ও নেই। সুদূর প্রবাসে আমাদের পেট চালানোর দায়ে আছেন। জানিস বাবা, অনন্যা তোর জন্য প্রতিদিনই কান্না করে।’

~ ‘তোমার এইসব বকবক আমার ভাল লাগতেছেনা। আর কিছু বলবা? নাহয় রাখ।’

– ‘ভালো থাকিস বাবা।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই সিয়াম ফোনটা কেঁটে দিল। মা’য়ের প্রতিদিনের বকবকানি শুনতে শুনতে তার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। হুট করেই অনুফার কল। কল কেঁটে দিয়ে ব্যাক করল সিয়াম। ওইপাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠে ভেসে আসলঃ

– ‘বাবু, খেয়েছ?’

~ ‘না। তুমি? অনুফার হাতে তখনো ভাতের প্লেট। প্রায় অর্ধপ্লেট শেষ। তারপর ও সে বললঃ

– ‘কি? এখনো খাওনি? তুমি না খেলে আমি ও খাব না।’

~ ‘বাবুটা আমার, রাগ করেনা। খেয়ে নাও, আমি ও খেয়ে নিচ্ছি।’

– ‘না। আগে তুমি খাও। তারপর আমাকে কল দিবা। তখন আমি খাব।’

কথাটা বলেই ফোন কেঁটে দিল অনুফা। প্লেটের বাকি অর্ধেক ভাতগুলো খেতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। সকালবেলা মোবাইলের আওয়াজে সিয়ামের ঘুম ভাঙ্গে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে অনন্যার নম্বর থেকে কল এসেছে। রাগে চোখ দু’টো লাল হয়ে যায় তার। কলটা কেঁটে দিয়ে আবারো ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু না। তা হচ্ছেনা। অনন্যার কল আবারো। রিসিভ করেই সিয়াম বলে উঠলঃ

– ‘তোরা মা-মেয়ে মিলে কি আমাকে মেরে ফেলবি? জানস না আমি এই সময়ে ঘুমে থাকি।’

ভাইয়ের কথাটা শুনে অনন্যার চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু বেয়ে পড়ল। কাঁদো কাঁদো ভাবটা লুকানোর চেষ্টা করে ও ব্যর্থ হয়ে বললঃ

~ ‘ভাইয়া, রাগ করিস না। তোকে কষ্ট দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। তবে বাধ্য হয়েই কল দিলাম।’

– ‘এত কাহিনী না করে কি বলবি বল। নাহয়, আমি ফোন কেঁটে দিলাম।’

~ ‘মা’র শরীরটা খুবই খারাপ। তার একটিই ইচ্ছা, তোকে দেখার। ভাইয়া, তোর দুটি পায়ে পড়ব। প্লিজ একবার বাসায় এসে মাকে দেখে যা। নিজের জন্য নয়, মায়ের জন্য হলেও একবার আয়।’

– ‘আচ্ছা, দেখি। পারি কি না।’

~ ‘ভাইয়া, প্লিজ আয়।’

সিয়ামের ভ্রু দুটো কুঁচকে যায়। চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় দরজার কড়া নড়ে উঠে। দরজা খুলতেই অনুফা ভিতরে চলে আসে। সিয়াম সবিস্ময়ে বলেঃ

– ‘আরেহ! তুমি এখানে? আমাকে আগে জানালে তো পারতা।’

~ ‘সারপ্রাইস।’

– ‘যাক বাবা! বাঁচলাম।’

~ ‘কোথাও যাচ্ছ মনে হচ্ছে?’

– ‘হ্যাঁ, একটু গ্রামে যাব। কি যেন ঝামেলা হয়েছে। তুমি কোথায় যাবে?’

~ ‘আমি তো ভাবছিলাম তোমাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাব।’

– ‘আচ্ছা, চল তাহলে। গ্রামের বিষয়টা বাদ দাও।’

~ ‘ঠিক আছে। আজকে দুজন মিলে রিক্সা নিয়ে ঘুরব, ফুচকা খাব, আইসক্রিম খাব।’

– ‘হুম, আমার পাগলিটা।’

রিক্সায় আছে সিয়াম আর অনুফা। রিক্সাওয়ালা নিজের গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। এমন সময় অনন্যার ফোন। রিসিভ করতেই অনন্যার কাঁদো কাঁদো গলা,

– ‘ভাইয়া, আসতেছিস?’

~ ‘না। আমি আসব না। অনেক ব্যস্ত আছি। এখন রাখ। পরে কথা হবে। অনন্যা হয়তো অনেক কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু, তার বলা হল না। ফোনটা নিজ থেকেই কেঁটে দিল। অনুফা বললঃ

– ‘কি হয়ছে?’

~ ‘না। কিছুনা। ছোট বোন কল দিয়েছিল।’

– ‘ওহ!’

~ ‘বাদ দাও তো।’

– ‘একটা কথা বলি?’

~ ‘হাজারটা বল।’

– ‘সামনে তো রমজান। তারপর ঈদ।’

~ ‘জানা আছে। কি চায় এবার? শাড়ি?’

– ‘হুম।’

~ ‘এইবারে একটা নীল রংয়ের শাড়ি দেব ভাবছি।’

– ‘রিক্সা থেকে নাম। ওই যে ওইখানে চল, ফুচকা খাব।

~ ‘চল।’

১৫ দিন পার হয়ে গেল। মোবাইলে ‘মা’ নামে সেভ করা নম্বরটা বের করে কল দিল সিয়াম। একবার, দুইবার, তিনবার। প্রতিবারই মোবাইল বন্ধ বলতেছে। রাগ উঠে যায় তার। হাতে একটা টাকা ও নাই। অনুফার জন্য শাড়ি কেনা প্রয়োজন। মা’কে বললেই টাকাটা হাতে পেত। মা’য়ের নম্বর ছেড়ে অনুফার নম্বরে কল দিতে গিয়ে ও একই দশা। মোবাইল বন্ধ। আর কোনো উপায় না পেয়ে বাসায় যাওয়ার উদ্যোগ নেয় সে। বাসার গেইটের সামনে আসতেই ‘মা, মা’ বলে ডাকতে থাকে সিয়াম। ভিতর থেকে অনন্যা বের হল। চুল তার উস্কো খুস্কো। চেহারাটা অন্যরকম। চুপি চুপি সে বলল, ‘আস্তে, আস্তে। মা ঘুমুচ্ছেন। আপনি কে?’

– ‘আমাকে চিনিস না? আমি সিয়াম। মা কোথায়?’

~ ‘কার মা? কোন মা? যা এখান থেকে।’ রাগে-ক্ষোভে বাড়ি থেকে বের হয়ে পাশের বাড়ির মতিনের বাসায় যায় সিয়াম। মতিনের মা তাকে দেখেই বলে উঠলঃ

– ‘বাবা, তুই এতদিন পর? আহা! তোর মায়ের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ হলো না। বেচারি, তোকে না দেখেই মরে গেল।’

মুহূর্তেই সিয়ামের উপর বিশাল এক পাহাড় ভেঙে পড়ল। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে লাগল। সামনের সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল। কিছু একটা যেন তাকে খুব করে তাড়া করছে। চোখ দিয়ে বেশ কয়েক ফোঁটা পানি নিজের অজান্তেই পড়ে গেল। মতিনের মাকে বললঃ

– ‘চাচি, মা মারা গেল কবে?’

~ ‘এক সপ্তাহ হল আজ। ডাক্তার বলেছিল স্ট্রোক করেই তার মৃত্যু হয়েছে। অনন্যার অবস্থা দেখেছিস? মেয়েটা মনে হয় এইবার পাগল হয়েই যাবে।’

– ‘চাচি, মায়ের কবরটা কোথায়?’

~ ‘পশ্চিম পাশের একেবারে কোণায়।’

আরেকমুহূর্ত সেখানে দাঁড়াল না সিয়াম। কবরস্থানে এসে মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে চোখের কয়েকফোঁটা পানি বর্ষণ করল। মনের ভিতর চাপা দেওয়া অনেক কথা ছিল বলার। কিন্তু, সে কিছুই বলল না। শুধু দাঁড়িয়ে রইল আর চোখের পানির ধারাটা ক্রমাগত বাড়তে লাগল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত