কুয়াশার চাদরে

কুয়াশার চাদরে

শীত আসবো আসবো করছে। এই সময় গ্রামটা বেশ সুন্দর লাগে। গাছের পাতাগুলো হলুদ হয়ে ঝরে পড়তে থাকে। সন্ধ্যা না হতেই পাতলা কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় প্রকৃতি। আশরাফ উদ্দিন রাতের খাবার খেয়ে স্বভাবসুলভ হাঁটতে বের হয়েছেন। কিন্তু আজ বেশিদূর যেতে পারলেন না। শো শো করে শীতল বাতাস বইছে। গায়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। উনি বের হয়েছিলেন পাতলা জামা পরে। তাই থাকতে না পেরে চলে এলেন বাড়িতে। তার বাড়িটা সুন্দর। কাঠের দোতলা বাড়ি। একতলা থেকে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি ঘরের মাঝখানেই আছে। তার বাবা বাড়িটা বানিয়েছিলেন বহু বছর আগে। গ্রামের মাঝামাঝিতে তাদের অপূর্ব দর্শন বাড়িটা দেখে যে কেউ থমকে দাঁড়ায়।

আশরাফ উদ্দিন পেশায় ডাক্তার। গ্রামের যে সে ডাক্তার নয়। বিদেশ থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসা ডাক্তার। তার বাবার ইচ্ছে ছিলো ছেলে গ্রামের লোকদের চিকিৎসা করবে। তাই তিনি দেশে ফিরে রয়ে গেলেন গ্রামে। টাকা পয়সার অভাব নেই। তার বাবা যা করে রেখে গেছেন তাতে তিন পুরুষ অনায়েসে বসে বসে খেতে পারবে। তবে আশরাফ উদ্দিন সেজন্য নিজের কাজে ফাঁকি দেন না। যখন যার প্রয়োজন, সাথে সাথে সেখানে হাজির হন। তার স্ত্রী মারা গেছেন বছর দুই আগে। এক ছেলেই তার পরিবার। ছেলে শহরে থেকে পড়াশুনা করছে। হোস্টেলে থাকে। এখন অবশ্য বাড়িতেই আছে। সেমিস্টার ব্রেকে এসেছে। ছেলে তার সাথেই খেয়েদেয়ে উপরে চলে গেছে নিজের ঘরে।

ডাক্তার হওয়ার সুবাদে তার ঘুমানোর আগে খানিকটা পড়াশুনা না করলে ভালো লাগে না। বহুদিনের অভ্যাস। তিনি শেলফ থেকে একটা বই টেনে নিয়ে হলঘরে আরামকেদারায় বসলেন পড়ার জন্য। গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। হলঘরে বড় একটা মশালের মতো লাইট আছে। সূর্যের আলোতে চার্জ হয়। সারারাত জ্বলে। জিনিসটা তিনি ফ্রান্স থেকে নিয়ে এসেছিলেন। সেটার আলোতে পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে গেলেন খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙলো দরজায় ঠকঠক শব্দে। কেউ একজন এসেছে। আশরাফ উদ্দিন ঘড়িতে দেখলেন রাত একটা বেজে দশ মিনিট। এত রাতে কে এসেছে? কোনো রোগী নয়তো? তিনি তড়িঘড়ি করে দরজা খুললেন। দরজার ওপাশে একজন মধ্যবয়সী লোককে দেখা গেলো। পরনে পুরানো তালি দেয়া পাঞ্জাবি, রঙচটা প্যান্ট আর বড় শাল জড়ানো গায়ে। মুখের অর্ধেকটা ঢাকা। আশরাফ উদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, “কে আপনি?”

লোকটা ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে গলায় বলল, “আজ রাতটা আপনার বাড়িতে থাকা যাবে? বড় বিপদে পড়ে এসেছি।”
লোকটার গলায় অসহায়ত্বের কোনো চিহ্ন নেই। উল্টো কেমন যান্ত্রিক গলা বলে মনে হলো আশরাফ উদ্দিনের কাছে। তবে তিনি মানা করতে পারলেন না। বললেন, “আসুন ভেতরে।”

লোকটা ঢুকলো। ঢুকেই চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরের চারদিকে দেখতে লাগল। আশরাফ উদ্দিনের ব্যাপারটা খুব একটা ভালো লাগলো না। তিনি বললেন, “আপনি কোথা থেকে এসেছেন? এখানে কী কাজ?”
লোকটা বলল, “আমি এখানেই থাকি।”
“এখানে কোথায়? কখনো তো দেখলাম না।”
“এইযে আপনার বাড়িটা, এর জায়গায় আগে আমার বাড়ি ছিলো। সেটা ভেঙে এটা করা হয়েছে।”
“মশকরা হচ্ছে? এই বাড়ি প্রায় আশি বছর আগের বানানো। আপনার বয়স পঞ্চাশ হবে বড়জোর।”
লোকটা হেসে বলল, “তা ঠিক বলেছেন। এই শরীরের বসয় আটচল্লিশ।”
“মানে?”
“বসে বলি? আমি খুব ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।”
আশরাফ উদ্দিন লোকটাকে বসালেন। রাতের খাবার শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তিনি কিছু বিস্কুট এনে লোকটার সামনে রেখে বললেন, “এটা খেয়ে নিন।”
লোকটা অনীহার দৃষ্টিতে বিস্কুটের পেয়ালাটা দেখে চোখ সরিয়ে নিলো। বলল, “এই ক্ষুধা বিস্কুটে যাবে না। তো যা বলছিলাম..শুনবেন না?
আশরাফ উদ্দিন আগন্তুকের মুখোমুখি চেয়ারে বসে বললেন, “হ্যাঁ বলুন।”

লোকটা বলতে শুরু করলো, “এই গ্রামটা আগে এরকম ছিলো না৷ ছোট্ট একটা গ্রাম ছিলো। গ্রামের পাশে ঘন জঙ্গল ছিলো। সেসব গাছপালা এখন অনেকটাই কেটে ফেলা হয়েছে। আমার তখন যুবক বয়স। গ্রামের লোকেদের মধ্যে আমাকে একটু বেশি সম্মান করা হতো লেখাপড়া জানতাম বলে। শহর থেকে মাধ্যমিক পাশ করে এসেছিলাম। আমার স্ত্রী ছিল খুবই সুন্দরী। বিয়ের এক বছর পর আমাদের একটা মেয়ে হয়। মেয়েটা হয় একদম পরীর মতো। এত রুপ আর কারুর কোনোদিন দেখিনি। সেই মেয়ে যতো বড় হতে লাগল ততো চিন্তা বাড়তে থাকলো আমার। গ্রামের মাতবরের ছেলে মজনু সুযোগ পেলেই আমার মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করতো। গ্রামের মাতবর হওয়ার ইচ্ছা আমার সবসময় ছিলো। তাই তখনকার মাতবর লোকটার সাথে সম্পর্ক ছিলো খুব খারাপ। তার ছেলে যখন মেয়ের পেছনে ঘোরে তখন কেমন লাগে! মজনু বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলে আমি সরাসরি না করে দেই। তখন সে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল। আমি মেয়েকে লুকিয়ে লুকিয়ে রাখতাম। ভেবেছিলাম ভালো ঘর পেলে বিয়ে দিয়ে দেব। কিন্তু অঘটন একদিন ঘটেই গেলো। এক ভোরবেলা উঠে দেখলাম মেয়ে আমার গলায় দড়ি দিয়েছে। বাড়ির পিছনে বড় আমগাছে ঝুলছে শরীর। গায়ের কাপড় ছিন্নভিন্ন। আমি বুঝে গেলাম কী হয়েছে। হাতের সামনে পাওয়া দাঁ নিয়ে ছুটলাম মাতবরের বাড়ির কাছে। পথেই মজনুকে পেলাম। নির্জন পথ। আশেপাশে কেউ ছিলো না৷ সাথে সাথে তাকে ধরে প্রথমে পিটিয়ে আধমরা করলাম। তারপর দাঁ দিয়ে কুপিয়ে শরীর ফালাফালা করে ফেললাম। তাতেও আমার মন শান্ত হলো না। ওকে উলঙ্গ করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলাম। সারা গ্রামের লোক আস্তে আস্তে জড়ো হলো সেখানে। কিন্তু আমার রণচণ্ডী মূর্তি দেখে কেউ কিছু বলার সাহস পেলো না। আমি চলে গেলাম মেয়ের কাছে। মেয়েকে দাফনের ব্যবস্থা করলাম। মজনুর লাশও লোকে কবর দিয়ে দিলো।”

আশরাফ উদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “কী বলছেন এসব?”

“জ্বী। ঠিক বলছি। ঘটনা এখানেই শেষ না। সেদিন রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম মজনু আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যেভাবে তাকে মেরে রেখেছিলাম সেই অবস্থা। স্বপ্নের মাঝেও আমি কাঁচা মাংসের গন্ধ পেলাম। সে বলল, তুই আমার সাথে যা করেছিস তার ফল পাবি। ফল পাবি….ফল পাবি….।

মজনু আমার কাছে আসতে শুরু করল। একেবারে সামনাসামনি আসার পরপরই আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো। আমি উঠে দেখলাম ফজরের আজান হচ্ছে।

এরপর আরও দু’দিন আমি একই স্বপ্ন দেখলাম। প্রতিবার মজনু আমার কাছে আসার সাথে সাথে ঘুম ভেঙে যায়। তৃতীয় দিন আমার আর সহ্য হলো না। আমি ছুটে গেলাম জঙ্গলে। সেখানে এক তান্ত্রিক থাকতো। জাদুটোনা, শয়তান উপাসনা কী না করতো! তার কাছে গিয়ে পায়ে ধরে বললাম আমাকে যেভবেই হোক বাঁচিয়ে দিতে। তান্ত্রিক আমাকে লাথি দিয়ে ফেলে দিলেন। বললেন, যতক্ষণ পুরো সত্যি না বলবি ততক্ষণ কিছুই হবে না। অগত্যা আমি তাকে আসল সত্যিটা বললাম।”

“আসল সত্যি মানে?” আশরাফ উদ্দিন চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলেন। গল্পে কখন ডুবে গেছেন জানেনও না।

আগন্তুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার মেয়েটা ছিলো ছোটবেলা থেকে খানিকটা অসুস্থ। পাগল ধরণের। মাথা কাজ করতো না সবসময়। তাই ও’কে সবার থেকে আড়ালে রাখতাম। সবাই ভাবতো সুন্দরী মেয়ে বলে আড়াল করে রাখছি। আসলে তা না। মেয়েটা পাগলামীর বশেই সেদিন গলায় দড়ি দিয়েছিলো। পাগল মেয়েটা মরাতে আমি তেমন কষ্ট পাইনি৷ যখন মাঝরাতে ওর লাশ দেখি, তখনই মাথায় অন্য চিন্তা আসে। মেয়ের জামাকাপড় ছিড়ে শরীরের কিছু জায়গায় আঁচড়ে ক্ষত বানিয়ে রাখি। যাতে মনে হয় ওর সাথে অনেক খারাপ হয়েছে। তারপর সকালে সুযোগ বুঝে মজনুকে মেরে ফেলি। ওর বাবার উপর শত্রুতার জন্যই কাজটা করেছিলাম। কিন্তু মজনু নির্দোষ ছিলো, তাই সে ফিরে এসেছিলো প্রতিশোধ নিতে।

আমার সব কথা শোনার পর তান্ত্রিক বললেন, উনি আমাকে বাঁচাতে পারবেন। কিন্তু তার জন্য আমাকে শয়তানের উপাসনা করতে হবে। যদি শক্তিশালী দুষ্ট আত্মাকে বশে আনতে পারি, তাহলে সেই আত্মা আমাকে মজনুর আত্মার কবল থেকে বাঁচাতে পারবে। কিন্তু শর্ত হলো এরকম করলে আমি আস্তে আস্তে পিশাচে পরিণত হব। আর প্রতি অমাবশ্যায় সেই দুষ্ট আত্মাকে তৃপ্ত করার জন্য একজন কুমারী মেয়ে বলি দিতে হবে।

আমি রাজি হয়ে যাই। মনেপ্রাণে শয়তানের উপাসনা করতে থাকি। আমি নিজেই খারাপ লোক বলে দুষ্ট আত্মা সহজেই ধরা দেয়। আমি ধীরে ধীরে পিশাচে পরিণত হতে থাকি। পুরোপুরি পিশাচ হওয়ার পর আত্মাটা আমাকে আদেশ দেয় কুমারী মেয়ে জোগাড় করে দিতে। আমি পিশাচ হয়ে গেলেও তখনো মানুষের মতোই দেখতে আর মানুষের মধ্যেই ছিলাম। লুকিয়ে প্রেতসাধনা করতাম।
প্রথম অমাবশ্যায় আমি গরীব ঘরের এক মেয়েকে রাতের অন্ধকারে তুলে এনে বলি দিলাম। রক্তগুলো সব বইয়ে দিলাম আত্মার জন্য। আর রয়ে যাওয়া কলিজাটা খেয়ে নিলাম তৃপ্তি করে।

পরের অমাবস্যায় আবার একই কাজ করলাম। কিন্তু এক অমাবস্যা থেকে আরেক অমাবস্যা অনেকদিন দেরীতে আসে। আমার তখন কলিজা খাওয়ার লোভ পেয়ে বসেছে মনে। তাই সুযোগ বুঝে অমাবস্যার আগেই এক রাতে একটা ছোট বাচ্চাকে মেরে তার কলিজা খেলাম। সেটাই কাল হলো। তখনই ধরা পড়ে গেলাম। গ্রামের লোক আটকে ফেলল আমাকে। খুব কামেল এক কবিরাজ ছিলো পাশের গ্রামে। তাকে আনা হলো। সে আমাকে সহ দুষ্ট আত্মাটাকে বেঁধে ফেলল গ্রামের সবচেয়ে প্রান্তের একটা অশ্বত্থ গাছের সাথে। আত্মাটা বাঁধা পড়ে গেলো। শরীরটা না খেতে পেয়ে মরে গেলো একদিন। কিন্তু আত্মা সেই গাছে আটকেই রইলো বছরের পর বছর।

আজ এক কাঠুরে অশ্বত্থ গাছটা কেটে ফেলেছে। আমিও সাথে সাথে মুক্তি পেয়ে গেছি। মুক্তি পেয়েছে শয়তান আত্মাটাও। আজ আমি এসেছি সেই কাঠুরের শরীরে প্রবেশ করে।
অনেকদিন কলিজা খাই না৷ আজ আমার শখ পূরণের দিন।
আপনাকে এসব কেন বললাম জানেন? কারণ এখন থেকে আমার আস্তানা এখানেই হবে৷ এই বাড়ির মাটির নিচেই পোতা আছে আমার হাতে বানানো শয়তানের মূর্তি। সেটা উঠিয়ে আবার উপাসনা শুরু করব। আমি হব পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী পিশাচ।”
কথা শেষ করে লোকটা ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠল। হাত বাড়ালো আশরাফ উদ্দিনের দিকে।

আশরাফ উদ্দিনের পড়াশোনা ডাক্তারী লাইনে হলেও তিনি ভূত-প্রেত-আত্মা সম্পর্কে ছাত্রজীবনে অনেক পড়াশেনা করেছেন। নেশা হয়ে গিয়েছিলো একটা সময় এসব। সেখান থেকেই তিনি জানেন, মানুষরুপী পিশাচদের বুকের বামপাশে হৃদপিণ্ড থাকার জায়গায় একটা কালো বস্তু থাকে। সেটা কোনোভাবে আঘাত করতে পারলেই সেই পিশাচটার শক্তি হঠাৎ করে নষ্ট হয়ে যায়। তারপর তাকে কোনো কিছুর সাথে বেঁধে ফেলতে হয় যা থেকে বের হতে পারে না তারা। আশরাফ উদ্দিন ভীত চোখে তাকিয়ে ছিলেন এতক্ষণ পিশাচের দিকে। একবারও বুঝতে দেননি তার মাথায় অন্যকিছু চলছে। তিনি টেবিলে থাকা একটা ছুরি আস্তে আস্তে হাতে নিয়ে অতর্কিতে চালিয়ে দিলেন পিশাচের বুকে। পিশাচটা আর্তনাদ করে পড়ে গেলো নিচে। আশরাফ উদ্দিন শরীরটা দ্রুত বেঁধে ফেললেন একটা কাঠের চেয়ারের সাথে। দোয়া পড়ে বন্ধ করে দিলেন আত্মা।

কাজ শেষে ক্লান্ত আশরাফ উদ্দিন এলিয়ে পড়লেন আরাম কেদারায়। সকালে উঠে ছেলেকে খুঁজতে ওপরে গেলেন। দেখলেন ছেলে টেবিলে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তিনি কাছে গিয়ে মৃদু ধাক্কা দিতেই ছেলেটা টলে পড়ে গেলো নিচে। আশরাফ উদ্দিন আতঙ্কিত চোখে দেখলেন তার ছেলের পুরো পেট চেরা। কলিজাটা বের করে নেয়া হয়েছে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত