“চলো, বিয়েটা সেরে ফেলি। আজকেই। এক্ষুনি!”
আমি তখন সবে ভার্সিটি থার্ড ইয়ারে পা দিয়েছি। মিলি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। এইচএসসি দিবে। আঠারো বোধ হয় ওর হয়ওনি তখনও। মাথায় এমন আজগুবি চিন্তা আসে কী করে! তবে মেয়ের মুখ দেখে আৎকে উঠলাম। মনে হলো সিরিয়াস।
“আজকেই?”
“হ্যা, আজকেই।”
“হঠাৎ বিয়ে করার ইচ্ছা হলো কেন?”
“কী বলতে চাইছো তুমি?”
“কিছুই না। জানতে চাইছি হঠাৎ বিয়ে করার ইচ্ছে হলো কেন?”
“দেখো, আজ বাদে কাল বিয়েতো করতেই হবে। শুভ কাজে দেরি করে লাভ কী বলো?”
“আচ্ছা, তোমার বয়স কতো চলছে এখন?”
“ডিসম্বরে আঠারো হবে।”
“তুমি জানো এখন তোমাকে বিয়ে করলে যে আমার নামে বাল্যবিবাহের মামলা ঠুকে দিবে? কোমরে দড়ি বেঁধে হাজতে ঢুকাবে?”
“ওসব শুনতে চাই না আমি। আজই বিয়ে করতে হবে এবং এক্ষুনি।”
“কী হয়েছে আগে ঠিক করে বলো।”
“বাবা বলেছে, ছবি দেখতে হলে বিয়ের পর হাজবেন্ডের সাথে দেখবা। তার গাড়িতে করে যাবা। টুক করে দেখে টুক করে চলে আসবা। কেউ বাধা দিবে না তখন।”
“কী ছবি?”
“শাহরুখ খানের নতুন ছবি বেরিয়েছে।”
“তো?”
“তো আবার কী! আমাকে আজকেই দেখতে হবে ছবিটা। তুমি জানো না, আমি ওর কতো বড় ফ্যান? তাছাড়া আমার সব বান্ধবীরা দেখে ফেলেছে।”
“আশ্চর্য! তোমাকে দেখতে না করেছে কে?”
“মাত্র কী বললাম তোমাকে? বললাম না, বাবা বলেছে বিয়ের পর হাজবেন্ডের সাথে দেখতে।”
“এটা তো সব বাবাই বলে! এমনি বলে। ”
“না, আজকে এটা বলেছে। কাল বলবে বিয়ের পর হাজবেন্ডের বাসায় খাওয়া দাওয়া করবে। আমার বাসায় তোমার খাওয়া বন্ধ! তখন আমি কোথায় যাব? তাছাড়া আমি বাবার কোন কথায় ফেলতে পারি না। ছবি দেখতে হলে বিয়ে করেই দেখব। আর কিচ্ছু শুনতে চাই না! আমাকে এখনই বিয়ে করতে হবে তো এখনই। চলো।”
“কোথায়?”
“কাজি অফিসে। ”
“পারব না।”
“পারবে না?”
“না।”
“আমি কিন্তু তাহলে সুইসাইড করব।”
এ মেয়ের মাথায় যে এতো বড় ছিট আছে তা আমি আগে টের পাইনি। অবাক হয়ে বললাম-
“কী বলছো তুমি এগুলা! তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
“জানি না। শুধু জানি আজকে এক্ষুনি বিয়ে করতে হবে। না হলে আমি সত্যি সত্যি সুইসাইড করবো! এই দেখো আমার ব্যাগেই বিষের কৌটা আছে।”
এই বলে সত্যি সত্যি ব্যাগ থেকে কীসের জানি একটা কৌটা বের করলো। আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়লাম তো বাবা! কাকে জানি আবার ফোন করছে এখন।
“এই নায়লা, তোরা সবাই এক্ষুনি পল্টনের কাজি অফিসটায় চলে আয় তো! এক ঘণ্টার ভিতর চলে আসবি কিন্তু!”
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। মেয়ে দেখি সত্যি সত্যি বাড়াবাড়ি করছে এখন। আমি বুঝতে পারলাম না কী করব। এক হিসেবে খারাপ না। বিয়ে করার ফায়দাও আছে অনেক। মেয়ে হিসেবে মিলি তো খারাপ না। কিন্তু…
ফোন দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিলাম বিয়েটা আজই সারছি। প্রথমে একটু দোনোমোনো করলেও এখন আমার বেশ আনন্দই হচ্ছে। মিলির চেয়ে এখন আমার উৎসাহটাই বেশি। বিশেষ করে রাতুলের বাসায় যখন রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
এক ঘণ্টার ভিতর কাজি অফিস পুরো গমগম করতে লাগলো। মিলির সাত আটটা মেয়ে বন্ধু।আমার বিশ-পঁচিশ জন বন্ধু।এসব কাজে অবশ্য ছেলেগুলোর উৎসাহই সবচেয়ে বেশি থাকে। মিলি এক ফাঁকে কোত্থেকে যেন সেজে গুজেও চলে এসেছে। একটা লাল জরজেটের শাড়ি পড়েছে। কী সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে! আহা, বেনারসিতে আরো কতো সুন্দরই না মানাতো মেয়েটাকে। সামনের দিনগুলোর কথা ভাবতেই আমার চোখ চকচক করে উঠল।
কাজি সাহেব কোনরকমেই বিয়ে পড়াতে রাজি হলো না। মেয়ের বয়স আঠারো না হলে নাকি বিয়ে পড়ানোর নিয়ম আইনে নেই। এই করে আরো হাজার তিনেক টাকা খসাতে হলো।
বুড়ো মিয়া শেষে রাজি হলো। এক হাজার এক টাকা দেন মোহরে বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। কাজি সাহেব কবুল বলতে বলার আগেই আমি কবুল বলে ফেললাম। এবার মিলির পালা।
“মা বলো কবুল?”
মিলি কিছু বললো না। কাজি সাহেবের দিকে কেমন জানি অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বললো-
“না।”
আমি বললাম-
“কী না?!”
“বিয়ে করব না।”
“বিয়ে করবে না?”
“না।”
“কেন?”
“দেখো, বাবা বলেছে বিয়ের পর হাজবেন্ডের সাথে গাড়িতে করে গিয়ে ছবি দেখতে হবে। তোমার কী গাড়ি আছে?”
আমি হতভম্ব হয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“না, বাবার কথা আমি ফেলতে পারব না। গাড়িওয়ালা জামাই ছাড়া আমি বিয়ে করব না।”
তারপর ব্যস্ত হয়ে কাকে যেন ফোন করলো।
“এই হাসিব, ভালো আছ জান? আচ্ছা তোমাদের একটা লাল টয়োটা গাড়ি আছে না? ওটা নিয়ে একবার পল্টনের কাজি অফিসটায় আসতে পারবে? জলদি এসো কিন্তু!”