একটি বৃন্তে দুটি ফুল

একটি বৃন্তে দুটি ফুল

— আপনি নাকি একসময় ভূত খুঁজে বেড়াতেন? আন্টি বললো আমাকে।

আমার সামনে একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটার নাম অদিতি ইসলাম অরিত্রী। নামটা খুবই সুন্দর। যেমনটা সুন্দর এই অদিতি নামের মেয়েটার চোখ দুটো। কেমন গভীর আর টলমলে। আমি চায়ে চুমুক দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে ওর চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছি। এমন সময় অদিতি কথাটা বলে উঠলো। প্রথম লাইনটা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম। কারণ আমার এই ব্যাপারটা মা বাবা ছাড়া আর কেউ জানতো না। কিন্তু পরের লাইনটা শুনে স্বস্তি পেলাম। আম্মুর কাছ থেকেই জেনেছে তাহলে।

— একটু ভুল বলেছে আম্মু আপনাকে। আমি ভূত খুঁজতাম না। আমি প্যারানরমাল ব্যাপার নিয়ে রিসার্চ করতাম। যদিও পুরো ব্যাপারটাই ছিল শখের অংশ।

আমার কথা শুনে অদিতি হাসলো। ওর টোল পড়া গালের দিকে তাকিয়ে আমি চায়ে আবারো চুমুক দিলাম। ভাবছি বিয়ের পর অদিতিকে বলবো সারাদিন হাসতে। ও হাসবে আর আমি ওর চোখ আর গালের দিকে তাকিয়ে থাকবো।

— তা কখনো কোন প্যারানরমাল ব্যাপার খুঁজে পেয়েছেন কোথাও? আদৌ প্যারানরমাল এক্টিভিটি বলতে কিছু আছে?

অদিতি আমাকে প্রশ্নটা করলো। তখনই আমার মনে পড়ে গেল চার বছর আগের সেই ঘটনাটা। যে ঘটনা এখনো আমাকে ভাবায়। অদিতিকে বলবো নাকি গল্পটা?

— আপনাকে আমার এক প্যারানরমাল ঘটনার সম্মুখিন হওয়ার গল্প বলবো? সময় আছে আপনার?

অদিতি কখন যে আমার হাতের উপর ওর হাত রেখেছে তা বুঝতেই পারিনি। বুঝতে পেরে আমি চমকে গেলাম। আমার হাতের তালুতে একটা কাটা দাগ আছে। অদিতি ওই দাগটায় আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বললো,

— হ্যা সময় আছে। আমি আপনার কথা শুনতেই তো এসেছি।

অদিতির কথা শুনে আমি নড়েচড়ে বসলাম। এই গল্পটা এতদিন পর্যন্ত আমি ছাড়া আমার আশেপাশের আর কেউ জানতো না। কিছুদিন পর অদিতির সাথে আমার বিয়ে। ওর সাথেই গল্পটা সবার প্রথম শেয়ার করা যাক।

” এটা কতটা প্যারানরমাল তা আমি জানি না। তবে এটা ছিল আমার জীবনে দেখা অন্যতম অস্বাভাবিক ঘটনা। আমি তখন ছিলাম নাটরে। এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে এটেন্ড করার জন্য সেখানে গিয়েছি। নাটরের নলডাঙ্গা থানায় ছিল বন্ধুর গ্রাম। আমরা বিয়ের তিনদিন আগে সেখানে যাই। বন্ধুর গ্রামের নাম ছিল নওদা পাড়া। বেশিরভাগই টিনের ঘর সেখানে। দুই একটা পাকা বাড়িও ছিল। তবে বন্ধুর বাড়ি ছিল মোটামুটি একটা রাজপ্রাসাদের সমতুল্য। বোঝাই যায় বন্ধুর বাবা এলাকার সবচেয়ে বড়লোক। সেখানে আমাকে মোটামুটি ভিআইপি লেভেলের আদর আপ্যায়ন করা হলো প্রথম দিন। এত এত পরিমান খাবার রান্না করা হলো আমার জন্য ভাবতেই কেমন যেন লাগছিল।
খাওয়া দাওয়ার পর আমি আর আমার বন্ধু একটা রুমে গেলাম। রাতে আমাদেরকে সে রুমেই ঘুমাতে হবে। তো তখন সন্ধ্যা সাতটা কি আটটা বেজেছে। আমি শহরের মানুষ। এত তাড়াতাড়ি তো ঘুমানোর প্রশ্নই ওঠে না। তাই আমি আর বন্ধু মিলে ওর ল্যাপটপে একটা মুভি দেখতে শুরু করলাম। কিছুক্ষন পরেই ঘরের দরজায় কে যেন নক করলো। আমার বন্ধু গিয়ে দরজা খুলে দিল। একটা মেয়ে ঘরে ঢুকলো। বয়স দশ কি বারো বছর হবে মেয়েটার । আমার দিকে তাকিয়ে খুবই সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললো,

— ভাইয়া কেমন আছেন? আমার নাম হাসনা হেনা।

আমি মেয়েটির কথায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এমন মিষ্টি কন্ঠস্বর কোন মেয়ের হতে পারে তা আমি কোনদিন কল্পনা করতে পারিনি। আমি হেসে বললাম,

— আমি ভাল আছি। তুমি কেমন আছো? আমার নাম আবির রায়হান।

তখন খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মনে হলো মিহি সুরে কেউ স্বর্গীয় কোন বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। এতটাই মিষ্টি ছিল হাসির শব্দ। আমি বন্ধুর দিকে তাকালাম। বন্ধু বললো মেয়েটা ওর বড় বোনের মেয়ে। বিয়ে উপলক্ষে বেড়াতে এসেছে।
সেদিন মেয়েটা বেশ কিছুক্ষন আমাদের সাথে কথা বললো। আমার সাথে মোটামুটি ভাল একটা সম্পর্ক হলো মেয়েটার। সেদিন রাতের ঘটনা অতটুকুই।
পরদিন সকালে নাস্তা করার জন্য বসলাম। বন্ধুর পুরো ফ্যামেলি একসাথে নাস্তা করতে বসেছে। কিন্তু হাসনা হেনাকে দেখলাম না। বন্ধুকে বললাম,

— কিরে হাসনা হেনা কই? নাস্তা করবে না?
— ও ঘুমাচ্ছে।

আমি একটু অবাক হলাম। এখন প্রায় দশটা বাজছে। বড়রা দশটা পর্যন্ত ঘুমাতেই পারে। কিন্তু একটা দশ বছরের বাচ্চা সচরাচর দশটা পর্যন্ত কখনোই ঘুমায় না। নিশ্চয়ই অসুস্থ।

— কিরে হাসনা হেনা অসুস্থ নাকি?
— আরে না, এমনিই ঘুমাচ্ছে।

বন্ধুর ভাবলেশহীন জবাব শুনে ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নিলাম। তারপর নাস্তা শেষ করে একটু বাইরে বের হলাম। বাইরে বের হওয়ার সময় উঠানে দেখলাম একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে হাসনা হেনার মতই। বয়সও একই হবে। আমি মেয়েটার দিকে তাকাতেই মেয়েটা ফিক করে হেসে দিল। আমিও হেসে দিয়ে মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করলাম।

— তোমার নাম কি মামণি?
— আমার নাম রজনী আক্তার ।

রজনীকে দেখে কেন যেন মনে হলো ও হাসনা হেনার বোন হবে হয়তো। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম,

— তুমি কি হাসনা হেনার বোন?

মেয়েটা মাথা নেড়ে হ্যা বললো। এই কারণেই তো চেহারায় মিল খুঁজে পেয়েছি আমি। আমি আর রজনীকে কিছু বললাম না। বাইরে বেশ কিছুক্ষন ঘুরে পুকুরে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে গোসল করে চোখ লাল করলাম।
দুপুরে খেতে বসলাম সবাই মিলে। বন্ধুর পরিবারের সবাই আমাকে ঠিক কতটা আপন করে নিয়েছে এত অল্প সময়ের মধ্যে তা বলে বোঝাতে পারবো না। খেতে খেতে হঠাৎ খেয়াল হলো রজনী ওর মায়ের পাশে বসে খাচ্ছে কিন্তু হেনা নেই। এবার আমি অবাক হলাম।

— কিরে সকালেও হাসনা হেনাকে দেখলাম না। এখন দুপুরে খেতে বসেও দেখি ও নেই। ঘটনা কি?

আমার প্রশ্ন শুনে আমার বন্ধু বেশ কিছুক্ষন ঝিম মেরে বসে থেকে বললো যে হেনা ঘুমাচ্ছে। ওর কথা শুনে এবার মনে বড় ধরনের খটকা লাগলো।

— হেনার কি হয়েছে বলবি তুই? কি লুকাচ্ছিস আমার কাছে? হেনার কিছু হয়েছে নাকি?
— আরে নাহ ওর কিছু হয়নি। খাওয়া শেষ কর তোকে পরে বলছি।

বন্ধুর কথা শুনে তখনকার মত চুপ হয়ে গেলাম। তবে মনে একটা প্রশ্ন বারবার খোঁচাচ্ছিল। হেনার কি খারাপ কিছু হয়েছে?
খাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নেয়ার জন্য বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আমার বন্ধু তখন আমাকে বললো হাসনা হেনার জীবনের এক বড় রহস্যের গল্প।

— আবির রজনীকে চিনিস তো?
— হ্যা আজ সকালে কথা বললাম। দেখতে তো অনেকটা হাসনা হেনার মতই। আমি তো প্রথমে ওকে হাসনা হেনার সাথে মিলিয়ে ফেলেছিলাম।
— রজনী আর হেনা জমজ বোন। রজনী হেনার চেয়ে আটাশ মিনিটের বড়।
— হুম বুঝলাম। কিন্তু হেনাকে দেখলাম না কেন সারাদিনে?
— সেটাই তো বলছি। ওদের দুজনের বয়স যখন চার বছর তখন হঠাৎ একদিন হেনা খেলতে খেলতে অজ্ঞান হয়ে যায়। বড় বোন তো কেঁদে একেবারে হয়রান হয়ে আমাদেরকে ফোন দেয়। ততক্ষনে হেনাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়ে গিয়েছিল। আমরা হাসপাতালে গেলাম। গিয়ে শুনি হেনা আর নেই। আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। বড় বোন আর দুলাভাই তো পাগলের মত কাঁদতে থাকে। আমরা সবাই কাঁদতে শুরু করি। রজনী তখন তার মায়ের চোখের পানি মোছায় ব্যস্ত। হঠাৎ রজনী মাটিতে পড়ে যায়। আর সাথে সাথে সাদা কাপড়ে ঢাকা বেডে শুয়ে থাকা হেনার দেহ নড়ে ওঠে।

— কি বললি? তাহলে ডাক্তাররা কেন বললো যে হেনা মারা গেছে?
— বলছি শোন। যখন হেনা জেগে ওঠে আর রজনী মাটিতে পড়ে যায় তখন আমরা ডাক্তারকে ডেকে আনি। ডাক্তার তখন হেনাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো। তারপর রজনীকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলো। রজনীর হৃদস্পন্দন নাকি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার ডাক্তার রজনীকে মৃত ঘোষনা করলো না। কারণ হেনাকে পরীক্ষা করে মৃত ঘোষনা করার পর তো হেনা ঠিকই জীবিত হলো। সারারাত আমরা হাসপাতালে রইলাম। পরদিন ঠিক নয়টায় রজনী বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। আর সাথে সাথে হেনা ওর মায়ের কোলে নেতিয়ে পড়লো। এরপর আমরা উপায় না পেয়ে হেনা আর রজনীকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সেখানেও একই ঘটনা ঘটনো। রাত নয়টায় রজনী ঢলে পড়ে আর হেনা জেগে উঠে। আর সকাল নয়টায় হেনা ঢলে পড়ে আর রজনী জেগে উঠে।

শেষের কথাগুলো শুনে আমার মাথা ঘুরতে শুরু করলো। আমি মনে মনে ভাবলাম বন্ধু নিশ্চয়ই আমার সাথে মজা নিচ্ছে। তাই আমি বললাম,

— শালা মজা নাও আমার সাথে? তুমি একটা আজগুবি গল্প বললা আর আমি মেনে নিলাম তাইনা?

আমার কথা শুনে বন্ধু কিছুক্ষন হাসলো। তারপর আমার হাত ধরে বললো ‘চল’। আমি আর কিছু না বলে বন্ধুর সাথে গেলাম। আমাকে একটা তালাবদ্ধ ঘরে নিয়ে গেল। তালা খুলে ঘরে ঢুকে দেখলাম হেনা ঘুমাচ্ছে। আমি হেনার কাছে গেলাম। ওর হাতটা ধরলাম। হাত ধরে আমি শিউরে উঠলাম। বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আছে হেনার শরীর। নাকের কাছে হাত নিলাম, কান কাছের কাছে নিয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষন। কিন্তু শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম না। এবার আমার কাছে অবাক লাগলো ব্যাপারটা। এটা কিভাবে সম্ভব? এটা তো একেবারে উদ্ভট ঘটনা বলা চলে।

— ওদেরকে অন্য কোথাও ভাল কোন হসপিটালে নিয়ে যাসনি?
— দার্জিলিং নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে কোন লাভ হয়নি। ডাক্তাররা সরাসরি বলেছে তারা এই ঘটনা এর আগে কখনো দেখেনি। এটা একেবারেই বিয়ন্ড সাইন্স।

কখন যে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল কথা বলতে বলতে টের পেলাম না। আমি বন্ধুকে বললাম নয়টা পর্যন্ত এখানেই বসে থাকতে চাই। বন্ধু কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসলো। আমি বসে রইলাম সেখানেই। অপেক্ষায় ছিলাম রাত নয়টা কখন বাজবে।”

আমি আমার গল্প শেষ করলাম। অদিতি হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বুঝতে পারলাম ও আমার গল্পটা উপভোগ করেছে বেশ। আমি গল্প বলা থামাতেই বললো,

— কি হলো থামলেন কেন? বলুননা কি হলো রাত নয়টায়? সত্যি সত্যিই কি হেনা জেগে উঠেছিল? নাকি পুরোটাই ভূয়া?

অদিতির কথায় আমি কিছু বললাম না। আমার কেন যেন এখন আর গল্পের শেষটা বলতে ইচ্ছে করছে না। আর বলতে ইচ্ছে করছে না যে সে রাতে আমি এক অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলাম। আমি দেখেছিলাম দশ বছর বয়সী একটা মেয়েকে বারো ঘন্টা পর মৃত থেকে জীবিত হতে। আমি দেখেছিলাম দশ বছরের একটা মেয়েকে বারো ঘন্টা পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত