সূর্যটা অস্তমিত হবে হবে ভাব, এই সময়টাকে দুঃখের সময় মনে হয় আমার, যদিও আমার মনে হওয়ায় কিছু আসে যায় না কারণ যাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। অবশ্য, যার বুক জুরে শুধুই হাহাকার তার আর ভাল্লাগা। কিন্তু হাস্যকর এই যে, আজ থেকে ৪২ বছর আগে কোন এক সময় এই সূর্যটা দেখার জন্য বসে থাকতাম দিনভর।
সেই কলেজের রঙিন দিনগুলো অদ্ভুত আনন্দ মিশ্রিত দিন। সব কিছুই তখন ছিল রঙিন, উজ্জল। সেই পরিচিত হাসিখুশি মুখ গুলো প্রতিদিন দেখতাম।
স্মৃতির পাতা খুললে প্রথমেই আসে কলেজে প্রথম পা রাখার দিনটি। সেদিনই আমার সাথে খুশির দেখা। হাসিখুশি মেয়েটার নামও খুশি।নাম নাকি মানুষের চরিত্রের অভিপ্রায়, তা যে সত্যি ওকে দেখেই বুঝা যেত। অদ্ভুত রুপ ছিল তার। অতিরিক্ত সুন্দরী যে হিংসার রাজ্য হবে এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ও ছিল অস্বাভাবিক। কারন ওর রুপ ওর হাসিখুশি জীবনে কোন প্রভাব ফেলত না। সেই মেয়েটা আমার প্রিয় বান্ধবী হওয়ার অতিরিক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন ছিল কিন্তু আমি যে তার প্রিয় বান্ধবী হওয়ার যোগ্যতা রাখতাম তা জানা ছিল না।জেনেছিলাম, যোগ্যতা এমন জিনিস যা চাইলে পাওয়া যায় না,পেলে রাখা যায় না। আস্তে আস্তে খুশি আর আমি বন্ধু হলাম,হাটতে শিখলাম, চলার পথে কাটাও বেঁধে গেল।
সেই খুশির নজর কারা চোখের চাহনির ঝটকায় জ্বলে ছিল আনোয়ার।ভালবাসা কেড়ে নেওয়া দায়, গড়ে ওঠা দায় নয়।আমি ছিলাম অভাগী, দায়ে ভেসে যাওয়া। আনোয়ার কে প্রথম দেখায় ভালো বেসেছিলাম। সে আমায় কখনো দেখেনি। হয়তো দেখার চেষ্টাও করেনি। তার চোখ খুশিকে খুঁজতো। আমি দেখতাম আনোয়ারের চোখে বয়ে যাওয়া প্রেম,অশ্রুকে মুছে নিয়ে আমি হাসতাম খুশির দিকে চেয়ে। অদ্ভুদ জীবন ছিল খুশিকে বাসাভালো আর আনোয়ারকে দেওয়া মন আমি না চাইতাম না ফিরিয়ে নিতে পারতাম ।আর কিছুদিনেই সেই আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম, সার্থের কাছে বয়ে গিয়েছিলাম।
জীবনের পাপকাজ উঁকিদেয় প্রতিমুহূর্ত । ফাঁকি দিলে, আবার উঁকি দেয়,মুখ বাঁকিয়ে হাসে মিচকি না খিলখিলিয়ে হাসে। বারেবারে হাসে হুম বারেবারে হাসে।জানিস ইরা, আনোয়ারের ভালোবাসার চোখ খুশি দেখে নি আর আমার ভালোবাসার চোখ আনোয়ার।দিন যায় মেনে নিতে থাকি বুঝতে থাকি আনোয়ার আমার হবেনা।খুশির ঘনিষ্ট বান্ধুবী হওয়ায়, আনোয়ার আমার সাথে বন্ধুত্ব করে শুধুই খুশিকে পাওয়ার জন্যে,ওকে কথা দিয়েছিলাম আমি ওকে সাহায্য করব। কিন্তু ওর সাথে কথা আমি আমার ভালোবাসাকে কমাতে গিয়েও বাড়িয়ে ফেলেছিলাম। ওর মুখে খুশির প্রশংসা আমায় কুড়ে কুড়ে খেত। আমি রাতে ঘুমাতে পারতামনা। কিছু খেতে পারতামনা। খুশির মায়াবী চেহারা আর মিষ্টিভাষা আমাকে গলা চেপে ধরেছিল। আমার মধ্যে ডুকে যায় কেন আমি খুশির মত নই। কেন নই। আমি কেন পারিনা হতে।মাঝে মাঝে আনোয়ারের প্রশ্ন করা বাক্য “খুশিকে বলেছ আমার কথা “আমায় আগুনে পুড়াত।
আমি নকল হাসি হেসে বলতাম ” না। বলব”। হিংসে যখন আমার শিরায় শিরায় তখন ক্লাসের সবচেয়ে বখাটে ছেলেটার কথাটা আমায় শান্তি দিয়েছিল সেদিন। পাপের কথা তখন কানে আসে নি আসেনি খুশির প্রতি ভালোবাসার কথা। আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম হিংসে। এতবড় সিদ্ধান্ত নিতে আমার একবারো বুক কাঁপে নি। সত্যিই কাঁপনি ইরা। আমি এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিলাম ইরা। বখাটে কালাম খুশির প্রতি ক্ষিপ্ত ছিল প্রেমের প্রস্তাবে না করায়। আমাকে ও সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল খুশি কখন বাসা একা বের হয় আমি জানতাম ওরা খারাপ কিছু করবে তারপরও আমি বলেছিলাম ওদের ঠিক ৫টায় বের হবে আজ।পরেরদিন যখন শুনি ওরা খুশিকে বাড়ির রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে মুখে এসিড মেরেছে। আমি হেসেছিলাম। ইরা আমি হেসেছিলাম পাপের জন্য সেদিন। আল্লাহ ও আমাকে ক্ষমা করবে না ইরা।আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলাম সবচেয়ে কাছের বন্ধুর সাথে আমার এই পাপে আমি জ্বলছি ইরা আমি জ্বলছি।
চিঠিটা ঠিক এই পর্যন্ত পড়ার পর ইরা কাগজে স্পষ্ট চোখের পানির দাগ দেখতে পেল। ইরার চোখ দিয়েও অশ্রু ঝড়ছে। মায়ের রাখা শেষ চিঠিটা যে এমন হবে সে কখনো ভাবেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে খুশিকে খুঁজেছে আর খুঁজেছে কারণটা আজ স্পষ্ট। চোখের সামনে ভাসমান।মায়ের কুকর্মকে সে নিন্দা করবে নাকি বুঝতে পেরে মাফ চাওয়াকে প্রশংসা কি করবে সে বুঝতে পারছে না। চিঠিটায় এখনো লেখা আছে। বাকিটুকু পড়ার জন্য চোখের পানি মুছে চিঠির দিকে দৃষ্টি দিল ইরা।
পরেরদিন এও জানতে পারি খুশি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি।ভাগ্যের জোরে সে বেঁচে গেছে। ফর্মালিটির খাতিরে দেখতে গিয়েছিলাম। অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকা দেহটা দূর থেকে দেখে চলে এসেছিলাম। সেদিন ওর রুপ ছিলনা মিষ্টি হাসি ছিলনা আমি কেমন জানি পৌচাশিক আনন্দ পেয়েছিলাম।আমার বিন্দু মাত্র খারাপ লাগেনি সেদিন। তার কিছুদিন পর খবর পাই খুশিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সময়ের সদ ব্যবহারে আমি আনোয়ারকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসি। ও আমাকে অনেক কথা শোনায় অপমান করে। ও আমাকে ভালোবাসেনা ও খুশিকে ভালোবাসে সেই একই কথা।আমি অপমান মেনে না নিতে পেরে শহরটা ছেড়ে দিয়ে এখানে আসি। এখানের কলেজে ভর্তি হই।তোর বাবার সাথে প্রেম হয় বিয়ে হয় ।
তুই জন্মাস। আমি তখনো অনুতপ্ত ছিলাম না। কিছুদিন পর তোর বাবা চলে যায়, আমি একা হয়ে পরি।একাকিত্ব আমার অতিতের কাছে ফিরিয়ে নেয়। নিকৃষ্ট পাপ কাজ আমায় পোড়াতে থাকে,সঙ্গিহীন জীবনে উপলব্ধি করতে পারি আমার ভুলগুলো।গলা কাটা পাখিরমত ছটপট করতে থাকি। তোর এতকিছু বোঝার বয়েস তখন হয়নি, তোর নিষ্পাপ মুখ দিয়ে বলতি কাঁদছ কেন মা? আমার পাপ মুখে তখন কোন উত্তর ছিল না। জানি তুই চিঠিটা যখন পড়বি তখন আমি না ফেরার দেশে। তোর কাছে আমার শেষ আবদার খুশিকে একটু খুঁজিস, যদি খুঁজে পাশ আমার হয়ে একটু মাফ চাস। ইরা তোর এই অপরাধি মা কে তুই মাফ করে দিস। মাফ করে দিস।এই শেষবেলায় আমার আফসোস একটাই খুশির কাছে মাফ চাওয়াটা আমার ভাগ্য নেই যে।
ইতি-
তোর মা হালিমা
ইরা উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল। তার চোখের বাধাহীন জল অনরগলে ঝড়ছে।সামনের রুমে বসা বৃদ্ধা মহিলার অর্ধেক মুখটা ঝলসানো। একটু আগে তার বাসায় এই বৃদ্ধা এসেছে তার মা হালিমাকে খুঁজতে।রুম ঝাড় দিয়ে পাওয়া চিঠিটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বসতে দিয়ে তাকে বলেছে তার মা মারা গেছে এক মাস হয়েছে। ইরা দৌড়ে সামনের রুমে বসা বৃদ্ধার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল আপনার নাম কি? বৃদ্ধা চোখের পানি মুছে ভাঙা গলায় বলল খাদিজা বেগম খুশি।