হাসিটা আজ পূর্ণ

হাসিটা আজ পূর্ণ

আমি আবুল চাচার দোকানে গিয়ে চাচাকে বলি “চাচা আধাকে গুঁড়া করে এক কাপ রং চা দিন তো?” চাচা আমাকে এক পলক দেখে চা বানানো শুরু করেন। আমি তানভীর ভাইয়ের দিকে তাকাই। উনি বলেন “আবিদ ভাই আমায় কি বলবেন! কষ্ট নামের বস্তুটি সবার জীবনে আটার মত লেগে থাকে কেন?” আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখি উনাকে। কথার মধ্যে চাপা কষ্টের ছাপ পাই। আমি উনার কথার উত্তর খুজার চেষ্টা করি। কিছুক্ষণ পর বলি “তানভীর ভাই! আপনি কি জানেন? আমরা সুখের দেখা কখন পাই? কষ্টের পর সুখের দেখা পাই। আমরা সুখের জন্যই কষ্ট করি। এজন্য বলতে পারেন ‘সুখ’কে নিয়ে আসতে ‘কষ্ট’র প্রয়োজন” তানভীর ভাই আমার কথা শুনেন। তার হাতের চায়ের কাপের অর্ধেক গরম চা’টা এক শ্বাসে খেয়ে ফেললেন।

আমি তার কষ্ট খুজার চেষ্টা করি। কি কষ্ট হতে পারে তার। আমি তাকে আবার প্রশ্ন করি “কি কষ্ট ভাই আপনার?” তানভীর ভাই আমার দিকে তাকান। কেমন যেন তার চোখের চাহনি। মুখ দিয়ে একটা অতৃপ্তিকর হাসি হাসেন। তারপর বলেন “থাক না ভাই সেগুলো। আপনার হাতে ফাইল কেন? কিসের ফাইল এগুলো?” আমি হাসি। ফাইলে আমার চাকরির সব কাগজপত্র। আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে তানভীর ভাই আবার বলেন “দেখি তো ভাই ফাইলটা?” আমি ফাইলটা যখন দেই তখন চাচা চা নিয়ে আসেন। তানভীর ভাই ফাইল খুলে ফাইলের সব কাগজপত্র দেখতে থাকেন। আমি চা’টা এক চুমুক খেয়ে বললাম “চাকরির ইন্টারভিউয়ে গেছিলাম ভাই আজ। খুব খারাপ লাগে ভাই। আজ এক বছর ধরে চাকরির ইন্টারভিউয়ে গিয়ে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছি।”

তানভীর ভাই কাগজপত্র রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন “আপনার মার্কশীট তো অনেক ভালো। তারপরও কেন চাকরি হচ্ছেনা ভাই?” আমি হাসি। কি উত্তর দিবো চিন্তা করি। একথার উত্তর মুখ থেকে কিভাবে বের করবো? তারপরও বলি “এটা আর নতুন কি ভাই? সব কোম্পানির মানুষরা তো ঘোষের টাকা দিয়েই সংসার চালাতে চায়। এই জন্য চাকরি করতে গেলেই ঘোষ চেয়ে বসে। আমার বেলায়ও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।” তানভীর ভাই হাসেন। ফাইলটা আমার হাতে দিয়ে বলেন “ঠিক বলেছেন। আচ্ছা কাল এক জায়গায় ইন্টারভিউ আছে যাবেন?” আমি যখন জিজ্ঞেস করবো কোথায় তখন উনিই কাগজ কলম বের করে ঠিকানাটা লিখে দিলেন। তারপর বললেন “আমি জানি আপনি আসবেন। কারণ আপনাকে আসতেই হবে। আপনার জন্য নয় আপনার পরিবারের জন্য। আচ্ছা আজ তাহলে উঠি।” এইটুকু বলেই উনি চলে গেলেন।

আমি চেয়ে রইলাম উনার দিকে। কয়েকদিন আগেই অপরিচিত ছিলাম দুজন। কেউ কাওকে চিনতাম না। কয়েকদিন আগে এই সময়ে এখানে এসে চা খাওয়া শুরু করি আমি। এই চায়ের সূত্র ধরেই তানভীর ভাইয়ের সাথে পরিচয়। উনিও এখানে চা খাওয়ার জন্যই আসেন প্রতিদিন। আমি আর কিছু না ভেবে চায়ের বিলটা দিয়েই চলে আসি বাসায়। বাসার দরজা খুলে দিল আমার বোন। দরজা খুলে আমার হাতের ফাইলটা নিয়ে বললো “আমি জানি চাকরিটা হয়নি। এখন আম্মু আব্বুকে কি বলবি ভেবে দেখ তাড়াতাড়ি।” আমি হাসি। এই হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে চাকরি না পাওয়ার দুঃখ। ভিতরে যেয়ে দেখি আম্মু আব্বু দাড়িয়ে আছেন। মুখে মিষ্টি একটা হাসি রেখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। উনারা মিষ্টি করে হাসছেন উনার ছেলে চাকরি পেয়েছে ভেবে।

আমি কি বলবো এখন উনাদের কাছে। আমার ভিতরটা কেদে উঠে। আমার ইচ্ছে করে চিৎকার করে কাদতে। আমার মা বাবার মুখের তৃপ্তিকর হাসিটা ধরে রাখতে পারবো না বলে আমার চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে। আমি ধৈর্য ধরতে পারিনি। আমি কেদে দিয়েছি। “আমার চাকরিটা হয়নি মা” এইকথা আমার মুখ দিয়ে বের করতে পারিনি। এইকথাটা মুখ দিয়ে বের করার চেষ্টা করতেই আমার চোখে পানি চলে আসে। আমার কান্না দেখে আম্মু আব্বু কাছে আসেন। আম্মুর শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলেন “কাদিস না বাবা। ধৈর্য ধর। চাকরি হবে। কোন চিন্তা করিস না।” আমি আর আম্মু আব্বুর দিকে তাকাই না। তাদেরদিকে তাকালে আমি আরো কষ্ট পাবো। তাই রুমে চলে আসি। রুমে এসে মনে হল আজ নাদিয়ার সাথে দেখা করার কথা। সে ফোন করে বলেছিল আজ দেখা করতেই হবে। অনেক দিন দেখা হয়না। হাত মুখ ধুয়ে শার্টটা চেঞ্জ করে নাদিয়ার সাথে দেখা করতে বের হলাম।

নাদিয়াকে আজ খুব খুশি মনে হচ্ছে। বাতাসে তার চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে। তার চোখের চাহনি এবং ঠোঁটের বাকা হাসিটাই তার খুশির আভা ফুটিয়ে তুলছে। তাকিয়ে দেখি আর চোখ সরাতে পারিনা। ইচ্ছে করেনা চোখ সরিয়ে নিতে। অদ্ভুত এক ভালো লাগা সৃষ্টি হচ্ছে তার দিকে তাকিয়ে থাকাতে। সে আমার দিকে তাকায়। প্রশ্ন করে “কি? আজকেও চাকরিটা হয়নি?” আমি তার প্রশ্ন শুনে হাসি। সামনের দিকে তাকাই। সামনে নদীর স্রোত। কতসুন্দর করেই না স্রোতগুলো এঁকেবেকে যাচ্ছে। আমি নাদিয়াকে বলি “হুম। নাদিয়া জানো! চাকরি হওয়াটা এত কঠিন একটা বিষয় নয়। চাকরি যে কারোরই হতে পারে। তোমারও হবে। তোমার যদি সেই চাকরি করার যোগ্যতা নাও থাকে তাও হবে। এর পিছনের কারণ টাকা। টাকা হলো মূল। কোম্পানির বসরা না শুধু টাকাই চায়। টাকাই মনে হয় ওদের সব। ওরা বুঝতে চেষ্টা করেনা সে টাকা দিতে পারবে কি না।

সে তো টাকার জন্যই এখানে আসছে। এটা ওরা বুঝেনা। আর যাদের টাকা নেই তারাই হলো এ দুনিয়ার মধ্যস্থরের আবর্জনা। এই মধ্যস্থরের আবর্জনাগুলো মানুষের মুখে না পারে ভালো করে গন্ধ ছড়াতে আর না পারে ঘ্রাণ ছড়াতে।” হঠাৎ নাদিয়া আমার চোখের পানি মুছে দেয়। আমি বুঝতে পারিনি কখন চোখে পানি চলে আসছে। নাদিয়া আমার চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে “এই তুমি এত ভেঙ্গে পড়তেছো কেন? তুমি এত চিন্তা করো কেন বলো তো? দেখো! আমি আছি। তোমার আব্বু আম্মু আছে। সব ঠিক হবে। তুমি প্লিজ ভেঙ্গে পড়োনা।” আমি আবারও বলি “জানো! আজ এক বছর ধরে আমার মা বাবা তৃপ্তি করে হাসতে পারেনা। শুধু আমাকে সুখে রাখার জন্য ওরা তৃপ্তি করে হাসার চেষ্টা করে।” নাদিয়া সামনের দিকে তাকায়। তার ডান হাত আমার বাম হাতের উপর রেখে বলে “সময় একদিন সব বদলে দেবে আবিদ।

শুধু অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। তুমি দেখো! একদিন আমরা সবাই সুখে দিন কাটাবো। আর যাইহোক। আমার আব্বু তোমায় দেখতে চেয়েছে জানো? এই জন্যই তোমায় আজ দেখা করতে বলেছিলাম।” আমার ভিতরটা ধক করে উঠে। মনে হচ্ছে ভিতর থেকে কি যেন একটা বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমার মনে হচ্ছে নাদিয়ার আব্বুর সাথে দেখা করতে গেলেই আমি নাদিয়াকে হারিয়ে ফেলবো। এখনও চাকরি হয়নি। কোন মুখ নিয়ে দাড়াবো নাদিয়ার আব্বুর সামনে। নাদিয়াকে বললাম “আচ্ছা যাবো। কাল সকালে আরেকটা ইন্টারভিউ আছে। ঐ ইন্টারভিউ শেষ করে তোমাদের বাসায় যাবো ঠিক আছে? আজ তাহলে যাই।” নাদিয়া আমার চোখের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলে “আজ সারাদিন অনেক ধকল গেছে। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিবা। তারপর আমায় ফোন করবা। ঠিক আছে?” আমি “হুম” নামক শব্দ উচ্চারণ করে চলে আসি।

তানভীর ভাইয়ের ঠিকানা অনুযায়ী গন্তব্যস্থানে আসলাম। অনেক বড় একটা অফিস। দেখেই বুঝা যাচ্ছে অফিসের মালিক অনেক বড়লোক। আমাকে বসানো হলো ওয়েটিংরুমে। আর কাওকে ইন্টারভিউ দিতে না দেখতে পেয়ে খটকা লাগলো। একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এখানে ইন্টারভিউ হবে কি না। সে বলে একটু অপেক্ষা করতে। অগত্যা চিন্তা না করে বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর ডাক পড়লো আমার। আমি ভিতরে যাই। ভিতরে বড় বড় স্যার তিনজন বসে আছেন। আমি সালাম দিয়ে চেয়ারে বসি। তারপর আমি যখন আমার ফাইল তাদের দিকে বাড়িয়ে দিবো তখন একজন স্যার বলেন “ফাইল দিতে হবেনা। আপনার কাগজপত্র আমাদের বস দেখে নিয়েছেন। আপনি কাল থেকে চাকরিতে জয়েন করতে পারেন। জয়েনিং লেটার টা নিয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।” আমি রুম থেকে বের হয়ে আসি জয়েনিং লেটার নিয়ে।

একটু আগে যা হলো সব আমার মাথার উপর দিয়ে গেলো। খুশি হওয়ার থেকে চিন্তা হচ্ছে খুব বেশি। তাদের বস কে? আমার কাগজপত্র কবে দেখলো? অবশ্যই আমার কোন পরিচিত লোক এসব করেছে। কিন্তু কে হতে পারে? আমার সাথে সম্পর্ক এমন মানুষতো কোন অফিসের বস হতে পারেনা। হতে পারে এমন মানুষ, যার ব্যাকগ্রাউন্ড আমার জানা নেই। আমাকে আজকেই জানতে হবে কে এই অফিসের বস। বাসায় এসে ওয়াশরুমের শাওয়ার ছেড়ে গোসল করছি। শরীরের ঘামকে শাওয়ারের পানি কিছুতেই সরাতে পারছে না। আমি যখন কোনকিছু নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করি তখন আমার শরীর বেয়ে ঘাম ঝরতে থাকে। আর সেই চিন্তাটা হোক না কোন ভয়ংকর দৃশ্য এর অথবা আনন্দের। আমার ভিতর অদ্ভুতরকমের আনন্দে বিমোহিত। আজ যে বিষয় নিয়ে চিন্তা হচ্ছে সেটা আনন্দের বিষয়। আমি অফিসের বসকে দেখার স্বীদ্ধান্ত নেয়ার পর অফিসের এক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করি এই অফিসের বস কে? উনার ছবি দেখাতে। তখন সে তানভীর ভাইয়ের ছবি দেখিয়ে বলে ইনি আমাদের অফিসের বস।

আমি অবাক হই তানভীর ভাইকে দেখে। আমার আর বুঝতে বাকি নেই কাজটা কার করা। কয়েকদিনের সম্পর্কে এত বড় একটা উপকার করেছে মানুষটা। আমারও তাকে উপকার করা উচিৎ। বাসায় কাউকে জানাইনি এখনও চাকরির খবরটা। একদম মাস শেষে চাকরির বেতনটা আব্বু আম্মুর হাতে দিয়ে জানাবো। আর তখন তৃপ্তিদায়ক হাসিগুলোকে স্মৃতিবন্দি করে রাখবো। আমি অফিসে জয়েন করেছি দুদিন হলো। তানভীর ভাইয়ের সামনে যেতে আমার কেমন যেন লজ্জা লাগছে। অফিসে জয়েন করার পর থেকে এখনও উনার সামনে যাওয়া হয়নি। কোথায় উনাকে গিয়ে ধন্যবাদ দিবো জড়িয়ে ধরবো পার্টি দিবো। আমি এসব না করে মেয়েদের মত লজ্জা পেয়ে বসে আছি। বুকের ধুকধুক শব্দ বেড়েই চলেছে। তানভীর ভাইকে আর ‘তানভীর ভাই’ বলতে পারবো না। স্যার ডাকতে হবে। এসব চিন্তা করছিলাম তখন পিয়ন এসে বলে স্যার ডাকছেন আপনাকে। আমার বুকের ধুকধুক শব্দ আরো বেড়ে গেলো।

আমি যাই স্যারের রুমে। গিয়ে সালাম করে উনার সামনে দাড়িয়ে থাকি। আমাকে দেখে স্যার হাসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বলেন “কি ব্যাপার আবিদ ভাই? দাড়িয়ে আছেন কেন? বসুন?” আমি অবাক হই। স্যার আমায় ভাই বলে ডাকছেন। অদ্ভূত লাগলো। আমি বসে যাই। স্যারকে বলি “স্যার কেমন আছেন?” স্যার আমার দিকে তাকান। উনার মুখ দেখে বুঝলাম অবাক হয়েছেন। অবাক হওয়ার পর যখন অবাকের পালা শেষ হয় তখন হাসেন। হেসে হেসে বলেন “আরে আবিদ ভাই! আপনি আমায় স্যার বলে ডাকবেন না। ভাই বলে ডাকবেন। আপনি আমার ভাই। তাই একটু সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। আচ্ছা চলেন কফিশপে। ওখানে গিয়ে কফি খেতে খেতে গল্প করা যাবে।”

ধীরে ধীরে অফিসের সবার সাথে পরিচয় হয়। আন্তরিকতা বাড়ে। সবার সাথে তানভীর ভাইয়ের ব্যবহার দেখে তানভীর ভাইয়ের মত হতে ইচ্ছে করে। তানভীর ভাই যেভাবে চলেন সেভাবেই চলার চেষ্টা করি। তা-ই হয়তো সবার মনে জায়গা করে নিতে পেরেছি। তানভীর ভাইকে আমার অদ্ভুত লাগে। এই অফিসের বস উনি। কিন্তু উনাকে বস মনেই হয়না। মনে হয় উনি সবার একজন বেস্ট ফ্রেন্ড। সবার সাথেই উনি হাসিখুশিভাবেই কথা বলেন ব্যবহার করেন। একটা বিষয় খুব অদ্ভুত লাগে। কিভাবে যেন উনি আমায় নিজের একজন ভাবতে শুরু করেন। নিজের সকল বিষয় উনি আমার সাথে শেয়ার করেন। উনার বিষয় উনার পরিবারের বিষয়। উনার পরিবারের বিষয় শেয়ার করার পর জানতে পারি উনার কষ্টগুলো, উনার সুখগুলো জানতে পারি। অফিস শেষ করে প্রতিদিন আবুল চাচার দোকানের চা খেতে খেতে সুখ দুঃখের আলাপ করি আমরা। এভাবেই স্বপ্নের মত করে দিনগুলি চলে যাচ্ছিল।

একদিন অফিস ছুটির দিনে শপিংমলে যাই বোনকে নিয়ে। শপিংমলে এমন একজনকে দেখে আশ্চর্য হয়ে যাই। তানভীর ভাইয়ের স্ত্রী তানিশা ম্যাম। উনি কফিশপে বসে কফি খাচ্ছেন। অফিসে একদিন তানিশা ম্যাম আসছিলেন, ঐদিনই তানভীর ভাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমার বোনকে নিয়ে কফিশপে যাই। উনিও আমাকে দেখে অবাক হলেন মনে হলো। উনার সামনের দুটো চেয়ার টেনে আমি আর আমার বোন বসি। উনি আমায় দেখে মুখে হালকা হাসির ভাব এনে বলে উঠেন “আবিদ সাহেব কেমন আছেন?” আমিও উত্তরে বলি “জ্বি ম্যাম। আমি ভালো। আপনি কেমন আছেন?” উনি মুখের হাসিটা আরো প্রসারিত করে আমায় বুঝালেন “আমি অনেক ভালো আছি।” আমি আর কিছু বললাম না।

উনি জিজ্ঞেস করেন “তোমার ভাই কেমন আছে?” আমি হাসলাম। উনি অবাক করা চোখে আমার দিকে তাকান। আমি বলি, “আপনি যদি জানতে চান তানভীর ভাই কেমন আছেন তাহলে কিছুক্ষণ বসতে হবে।” তানিশা ম্যাম ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলেন, এতকিছু না বলে কি হয়েছে সেটা আগে বলো।” আমি বলতে শুরু করলাম, “আপনি যেদিন চলে যান, ঐদিনের পর দুদিন তানভীর ভাই অফিসে আসেন নি। দুদিন পর আমার কাছে ফোন করে বাসায় যেতে বলেন। আমিও চলে যাই। গিয়ে দেখি উনি কোথাও যাবার জন্য তৈরি হয়ে আছেন। আমি যেতেই বলেন, ” চলেন আবিদ ভাই। একটু ঘুরে আসি” আমি যখন কোথায় বলতে যাবো তখন আবার উনি বলেন, “গন্তব্যে পৌঁছাবার আগে জিজ্ঞেস করবেন না কোথায় যাচ্ছি। ওখানে গেলেই বুঝতে পারবেন।” আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।

কিছুক্ষণ পর আমরা গিয়ে পৌছাই একটা এতিম খানায়। ওখানের ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখিয়ে তানভীর ভাই আমায় বলেন, “জানেন আবিদ ভাই? আমি প্রায় সময় এখানে আসি। এই ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করি। তাদের অপূর্ণ কাজগুলো নিজের মনে করে করি। তারপর যাবার আগে তাদেরকে নিয়ে দোয়া করি যেন, আমার স্ত্রী সঠিক পথে চলে আসে। আমি কি চাই সে যেন বুঝতে পারে। আমার মা বাবা কি চান সে যেন বুঝতে পারে। আমি জানি, এই ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে যে দোয়া করি সেটা আল্লাহ তাআলা কবুল করবেন। এবং সেই অপেক্ষাতেই আছি।” এইটুকু বলে উনি থামেন। তারপর আমরা একটা রিকশাতে উঠি বাসায় আসার জন্য। রিকশায় উঠার পর তানভীর ভাই বলেন, ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌”তানিশা চকলেট আর ফুল খুব ভালোবাসতো।

সে থাকতে তার পছন্দের চকলেট আর ফুল প্রতিদিনই নিয়ে যেতাম। আমারও ফুল খুব পছন্দের। সে থাকতে পছন্দের ফুলগুলো একপাশে রেখে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তার দিকে তাকিয়ে থাকলে সে খুব লজ্জা পেতো, আর তার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যেত। আমি যখন তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম তখন আমার মনে অনেক প্রশ্ন তৈরি হত। ভাবতাম, কিভাবে যেন আল্লাহ আমাকে এমন মায়াবতীকে পাইয়ে দিলেন। যার চেহারার মধ্যে আছে মায়ার সাগর, সেই সাগরে আমি বারবার হাবুডুবু খেতাম। আর মনে মনে প্রতিদিন প্রতিজ্ঞা করতাম, এমন মায়াবতীকে যখন আল্লাহ দিয়েছেন আমায়, তার যেন কোনরকম কষ্ট না হয়।” এটুকু বলে উনি থামেন। আমি উনার দিকে চেয়ে থাকি।

উনি পথপানে চেয়ে থেকে আবার বলেন, “আমি এখনও ফুল আর চকলেট নিয়ে যাই বাসায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো। যে ফুলগুলোকে এক পাশে রেখে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম সে আজ নেই। সে নেই বলে এখন ফুলের দিকে তাকাতেই ইচ্ছে করে না।” আমি কিছু বলতে পারিনা উনাকে। উনাকে শান্তনা দেবার মত আমার ভিতর থেকে কোনকিছু বের হয়নি। হয়তো এমন কোন শব্দ নেই, যে শব্দ দিয়ে উনাকে শান্তনা দিতে পারবো আমি। আমরা বাসায় চলে যাই। তানভীর ভাই ওয়াশরুম থেকে এসে বিছানায় শুয়ে পরলেন। আমি সোফাতেই বসে থাকি। তানভীর ভাই যে ভালো নেই সেটা উনার চেহারা দেখেই বুঝা সম্ভব। শুয়ে শুয়ে আমায় আবার বলেন, “খুব কষ্ট হচ্ছে আবিদ ভাই। কখন যে এই কষ্টের ইতি ঘটবে জানি না। কষ্ট হয় যখন ভাবি তানিশা আমায় বুঝলোনা।

অনেক কষ্ট করেছি তাকে সুন্দর এই সঠিক পথে নিয়ে আসতে কিন্তু সে আসেনি। এটা যখন আমার মাথায় আসে আবিদ ভাই! তখন ভিতরটা ছারখার হয়ে যায়।” এটুকু বলে শেষ করার সাথে সাথে আমার বোন আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে তানিশা ম্যামের দিকে তাকাতে। তখনই তানিশা ম্যাম দৌড়ে চলে গেলেন। বুঝতে পারি, উনি আর চোখের পানি আটকাতে পারছেন না। এখন হয়তো বিবেকটা কাজে লাগাতে পারে। যেতে পারে তানভীর ভাইয়ের কাছে। আমি হালকা সফলতার হাসি হাসলাম। আমার বোন আমাকে দেখে অবাক হয়, বলে, “তুই হাসছিস কেন?” আমি তাকে নিয়ে কফিশপ থেকে বের হয়ে এসে বলি, “জানিস! যে আমার উপকার করলো তার উপকার করতে পেরে খুব আনন্দ হচ্ছে আমার।” আমার বোন কিছু বুঝতে না পারার মত মুখ করে বলল, “মানে?” আমি তার দিকে তাকিয়ে বলি, “চল আগে শপিং করে ফেলি” সে আর কিছু না বলে শপিং করতে লাগলো।

শপিং শেষ করে বাড়ির পথে পা বাড়াতেই আমার ফোনে কল আসে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই নাদিয়ার নামটা স্পষ্ট ভাসে। সে প্রতিদিনই ফোন করতো। কিন্তু গত দুদিন পর আজকে কল দেখে একটু অবাকই হই। আমি যেমন তাকে ছাড়া মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি তাকে ইগনোর করছি। সেও হয়তো আমাকে ইগনোর করা শিখে গেছে, মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এজন্য মনে হয় দুদিন কল করেনি। নাদিয়া যেদিন বলেছিল তার বাবার সাথে দেখা করতে সেদিনই মনে হয়েছিল কেও আমার কাছ থেকে আমার বা পাশে থাকা মানুষটাকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করছে। যেদিন নাদিয়ার বাবার সাথে দেখা করি সেদিন থেকে নাদিয়াকে কষ্ট দিচ্ছি। এড়িয়ে চলছি। নাদিয়ার বাবা ঐদিন বলেছিলেন নাদিয়াকে এড়িয়ে চলার জন্য, ভালো না বাসার জন্য। কারণ, আমার মধ্যে নাকি নাদিয়াকে ভালোবাসার মত যোগ্যতা আমার নেই। আমার না আছে চাকরি, আর না আছে ভালোমানের একটা বাড়ি। নাদিয়াকে সুখে রাখার মত শক্তি সামর্থ্য নেই আমার। ঐদিন একজন বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বাবার অনুভূতিগুলো অনুভব করে কিছুই বলিনি আমি। শুধু এইটুকু বলেছি, “আংকেল! আপনি নাদিয়াকে আপনার চিন্তানুযায়ী কিছু করবেন না। প্রথমে একটু কষ্ট করে আপনার মেয়েকে বুঝুন।

সে কি চায়। তার অনুভূতি কি? তার সুখ কোথায়? সেগুলা আপনার মেয়ের অনুভূতি আপনাকে বুঝিয়ে দেবে। জানেন আংকেল! আমি যখন নাদিয়াকে বলতাম, “তোমার বাবা আমায় মেনে নিবেন না।” তখন নাদিয়া আপনার উপরে খুব বিশ্বাস করে বলতো, “তুমি আমার বাবাকে চেনোনা। উনি আমায় খুব ভালোবাসেন। আমাকে বুঝেন। তুমি যখন চাকরি পেয়ে আমার বাবার সামনে গিয়ে দাড়াবে তখন দেখবে বাবা মিস্টি করে হেসে উনার নিজ হাত দিয়ে আমায় তোমার হাতে তুলে দিবেন।” তবে আংকেল। আমি জানি নাদিয়ার এমন কথার সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই। কিন্তু এগুলো ওর সামনে বলিনি কখনও, সে খুব কষ্ট পাবে ভেবে। আচ্ছা আংকেল আমি চলে যাই তাহলে। তবে একটা কষ্ট আমায় খুব করে ঝালাবে। নাদিয়াকে পেলাম না চাকরিটা পেয়েও।” এটুকু বলে ওখান থেকে চলে আসি। নাদিয়ার বাবা হয়তো আমাকে কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু আমি শুনিনি।

এসব ভাবতে ভাবতে নাদিয়ার কলটা কেটে গিয়ে আবার কল আসে। এইবার মোবাইল সাইলেন্ট মোডে রেখে পকেটে রেখে দিই। তার একটু পরই সামনে আগাতে গিয়ে দাড়িয়ে যাই। সামনে আগাতে পারিনা। চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায়। মনের মধ্যে ভয় সৃষ্টি হতে থাকে। নিজেকে অসহায় মনে হয় যখন দেখি নাদিয়া আমার সামনে দাড়িয়ে। চোখে পানি টলমল করে। তারমানে ও আমাকে দেখে কল করছিলো এতক্ষণ। আমি কিছু বলতে যাবো তখন নাদিয়া আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “আমি তোমায় খুব বিশ্বাস করতাম জানো? কখনও ভাবিনি আবিদ, তুমিও যে বিশ্বাসটাকে ভাঙ্গতে পারো। আমার মাথায় কোনদিন আসেই নি যে, তুমি অন্য একটা মেয়ের জন্য আমাকে এড়িয়ে চলবে।” একথা শুনে আমার বোন অবাক হয়ে যায়।

আমি থ মেরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি চুপ করে। আমার বোনকে নাদিয়া অন্য কেউ ভাবছে। আমি চুপ করে আছি দেখে আমার বোন দুধে জল ঢেলে দিলো। বলল, “ভাইয়া! ও কিসব বলছে? তুই কিছু বলছিস না কেন?” একথা শুনে নাদিয়ার চোখ কপালে। আমার খুব হাসি পেলে আমি হেসে দেই। তখন নাদিয়া আমার আরো একটু কাছে এসে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, “সে তোমার বোন?” আমি হেসে হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলি। তখন নাদিয়ার চোখ নিচের দিকে করে ফেলে লজ্জায়। আমি আমার বোনকে বললাম একটা রিকশা ঠিক করতে। তখন বোনটা চলে যায়। তারপর নাদিয়া আমায় বলে, “স্যরি। আমি বুঝতে পারিনি।” আমি ‘হুম’ বলে জিজ্ঞেস করি, “এখানে কেন?” সে বলে, “বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করতে।” “মানে?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি। সে বলে, “মানে হলো, আমার ভালোবাসাকে নিয়ে একটা ভালোবাসার বন্ধনে বন্দি হতে চাই।” আমি আবারো অবাক হই। জিজ্ঞেস করি, “কিন্তু তোমার বাবা?” সে হাসে আমার কথায়।

এই হাসিটার জন্য আমার মন অন্য দিকে যেতে চায়না। একরকম নেশাযুক্ত হাসি। চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকতে হয়। নাদিয়া বলে, “তুমি যে আমার বাবাকে বলেছিলে উনার চিন্তানুযায়ী কাজ না করে প্রথমে আমাকে বুঝতে, আমার অনুভূতি কি চায়। তাই উনি সেটাই করেন। সেজন্য আজ আমি তোমার সামনে দাড়িয়ে।” এগুলো শুনে আমার অনুভূতি স্তব্ধ হয়ে যায়। বুক ধুরু ধুরু করে, কে জানে হয়তো অনুভূতিগুলো লাফাচ্ছে খুশিতে। নাদিয়া আমার চোখে তাকায়। আমার অপূর্ণতার হাসিকে বিদায় দিয়ে পূর্ণতার হাসি এসে ভরে যায় আমার দুগালে। সেদিকে নাদিয়া তাকিয়ে থাকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত