শুকনো পাতা

শুকনো পাতা

বেস্ট ফ্রেন্ডকে বিয়ে করে খাল কেঁটে কুমির এনেছি। নিজের স্বাধীনতা, মানইজ্জত সব শেষ। অবশ্য বিয়েটাও হয়েছিলো অদ্ভুত ভাবে। জান্নাত মানে আমার বর্তমান বউ একমসয় যিনি আমার বেস্টু ছিলো। জান্নাত আমাকে ভালোবাসতো আমি জানতাম, আর সেটা ওর ডায়রি থেকে জেনেছি। একদিন ওর পার্সোনাল ডায়রি খুলে দেখি প্রথম পাতায় আমার ছবি আঠা দিয়ে লাগানো। অদ্ভুত বিষয় হলো আমার ছবির পাশে একটা টিকটিকির ছবিও লাগানো ছিলো। আর নিচে লেখা ছিলো…..

‘এই যে দুইটা ছবি দেখছেন এরা একই। এদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। একটা অর্জিনাল টিকটিকি আরেকটা বহুরূপী, এর নাম টিকটিকি, চিকা, ইঁন্দুর আবার তেলাপোকাও বলা চলে। টিকটিকি যেমন দেয়ালের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকে তেমনি আমিও এই ইঁন্দুরের সাথে সারাজীবন আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকতে চাই। কিন্তু বুদ্ধু টা আমার ভালোবাসা বুঝেও না বোঝার ভান করে। যাইহোক আর না পচাই, এত্তগুলা কিল দিয়া ভালোবাসি আমার রুবুটাকে (রুবেল না বলে রুবু ডাকে)।’ সেদিন ডায়রি পড়ে কতক্ষণ হেসেছিলাম জানিনা। সারাটা দিন কেমন যেন আনন্দের মধ্য দিয়ে কেঁটে ছিলো। অনেক চিন্তাভাবনা করে বাসায় এসে মাকে বলেছিলাম…..

-আচ্ছা মা জান্নাত মেয়ে হিসেবে কেমন?
–ভালো, অনেক ভালো। তোর মতন শয়তানকে শায়েস্তা করার জন্য উপযুক্ত মেয়ে।
-হুর, বলোনা কেমন মেয়ে?
–ভালোইতো লাগে, বউ হিসেবে বেশ লাগবে।
-আচ্ছা জান্নাতকে বিয়ে করলে কেমন হয় বলোতো?

এই প্রশ্নের জবাবে আম্মা কিচ্ছু বলেনি। হা করে তাকিয়ে ছিলো। আমাকে কিচ্ছু না বলে সেদিন-ই জান্নাতদের বাসায় বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে গেছিলো। মনেরর সুখে জীবনের প্রথমই সেদিন লুঙ্গী ড্যান্স দিয়ে ইউটিউবে আপলোড করেছিলাম। জীবন মানে যে বিয়ে সেদিন না আসলে বুঝতামই না। যাইহোক তারপর দুই পরিবারের মতামতে আমাদের বিয়ে হয়। বাসর ঘরে গিয়ে পুরো আবুল হয়ে যাই। দেখি জান্নাত মাথা ঘোমটা দিয়ে ইউটিউব দেখছে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য ওর কাছে গেলাম। দেখি আমারই লুঙ্গী ড্যান্স দেখছে। ছিঃ…এভাবে বাসর ঘরে নব বধু এমন কাজ করবে জানলে লুঙ্গী ড্যান্স দিতামনা। গলা খাঁকড়ি দিয়ে জান্নাতকে বললাম….

-বাসর ঘরে মানসম্মানের বিষয় না টানলে হয়না? জান্নাত মাথা উচু করে বলল..
–তুই এত সুন্দর নাঁচতে পারিস জানতাম নাতো। জানলে আমি নিজে নোবেল পুরুস্কার চুরে করে এনে তোকে দিতাম।
-এভাবে কথা বলছিস কেন? সম্মানে লাগে, হাজার হলেও এখন আমি তোর স্বামী।
–তো মুই কিত্তাম? আপনি ভিডিও আপলোড দিলি কেন?হোয়াট দা ভাষা? জান্নাত দেখছি আপনি, তুই বলা শুরু করছে। আমি কিছু বলতে যাব জান্নাত বলল…

–সরিরে, আম্মা বলেছে বিয়ের পর যাতে আমরা তুই করে কথা না বলি। লোকে খারাপ ভাববে। তাই সেটার প্রাক্টিস করছি। তুই কিছু মনে করোনা।

মনে মনে বললাম এমন বারোমিশালি ভাষার মায়রে নানি। সেদিন বাসর রাতে জান্নাতের একটাই চাওয়া ছিলো আমি ওর সামনে আবার লুঙ্গী পরে নাচবো। কি আর করার তাই করলাম। জান্নাতও হাসতে হাসতে খুন। মন চাইছিলো বাসর রাতেই উদুম কেলাই। ভাগ্যিস বিয়ে করা বউছিলো। এরপর থেকে শুরু আমার জীবনের ঝড়। সকালে নাক ডেকে বেঘোরে ঘুমোচ্ছি। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম কে যেন পিটাচ্ছে। চোখ খুলে দেখি জান্নাত কোল বালিশ দিয়ে পিটাচ্ছে। ব্যাথা তেমন পাচ্ছি না তবে বুকে ঝাকি লাগছে , বললাম…..

–কি সমস্যা?
-নট সমস্যা, তোরে পিডাই।
–আজবতো…
-কিসের আজব তুই আমার স্বামী না?
–তাই বলে পিডাবি?
-তুমি এত বেলা করে ঘুমাচ্ছিস যে?
–আগে যেকোনো একভাবে কথা বল, পাঁচ মেশালি কথা বলবিনা।
-আমি পারবনা আমার যেমন ইচ্ছে আমি ডাকব। আপনার সমস্যা হলে বাসা থেকে বেড়িয়ে যা।

লও ঠ্যালা! আমাদের বাসায় এসে আমাকেই বলে বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে। সাহস দেখে মাথায় উড়াধুরা ঠুয়া মারতে ইচ্ছে করছে। ঠুয়া মারার ইচ্ছে টাকে মাটিচাপা দিয়ে বললাম….

–কাহিনী কি, পিডাইলি কেন?
-বললাম তো এত বেলা করে ঘুমাচ্ছিস তাই।
–তাই বলে পিডাবি? আদর করে বাবু বাবু বলে উঠাতি। তারপর আমার কপালে ছোট করে চুমো দিয়ে বলতি উলে উলে বাবু ঘুম তেকে উতোনা। জান্নাত আমার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। তারপর খিলখিল করে হাসলো। মনে হচ্ছে আমি জোকার আর ও দর্শক। জান্নাত হাসতে হাসতে বলল…

–হিহি তুই বাবু? বুইড়া বেডা।
-হুররর আদর করে বাবু ডাকতি। আমিও তোকে বউমনি ডাকবো।
–এহহ এহহ আইছে, চিকার আন্ডা জানি কোথাকার। মা ডাকছে খেয়ে অফিসে যান, বুদ্ধুরাম। অ্যাঁ….বিল্লি।

ভেংচি কেঁটেই জান্নাত হনহন করে চলে গেলো। আমি ভাবতে লাগলাম, আমি কিভাবে চিকার আন্ডা হলাম। হাউ লজিক? মাথায় আসলনা। বিছানা থেকে নেমে ফ্রেস হয়ে খাইতে গেলাম। অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি। ‘আজকে অফিসে না গেলে হয়না?’ হুট করে জান্নাতে এমন কথা শুনে পিছনে তাকালাম। বললাম….

-নিজেইতো অফিসে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে তুললি।
–তো কি করব? এত ঘুমোলে দিনদিন আলসে হয়ে যাবি।
-এখন তাহলে অফিসে যেতে নিষেধ কেন?
–জানিনা। (মন খারাপ করে)
-ধুর পাগলি, আচ্ছা মন খারাপ করিস না। আজকে তাড়াতাড়ি ফিরব।
–প্রতিদিন তো একই কথা বলস, কখনো আসিস?
-বস এক্সট্রা কাজ দেয় মাঝেমাঝে
–আজকে দেরি হলে তোকে আর তোর বসের নাক ফাঁটাবো।
-হাহা আচ্ছা ফাঁটাস আমি চলি।
–কিছু বলার নাই?
-ভালোবাসি বউমনি।
–হইছে হইছে এবার যাও বাবু হি হি হি ভালোবাসি।

আমি চলে আসলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি জান্নাত দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি যতক্ষণ না চোখের আঁড়াল হচ্ছি ততক্ষণ এভাবেই তাকিয়ে থাকবে। ভালোবাসা জিনিসটা আসলেই অদ্ভুত। সন্ধ্যায় অফিস ছুটি হওয়ার পর বাসার দিকে রওনা দিলাম। রাস্তায় বাঁধলো আরেক বিপত্তি। হুট করে সিয়ামের সাথে দেখা। সিয়াম আমার ভার্সিটিরর ফ্রেন্ড। একসাথেই লেখাপড়া করেছি। এখন জীবিকার টানে যার যার মতন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। দেখা হওয়ার পর অনেক কথা বললাম। সিয়াম এখনো বিয়ে করেনি। কয়েকদিন হলো চাকরির সুবাদে এখানে আসা। নিজে একা একটা রুম ভাড়া নিয়েছে। না বলা সত্যেও এক প্রকার জোর করেই সিয়াম ওর রুমে নিয়ে গেলো। ওর সাথে আড্ডা দিতেই অনেক সময় চলে গেলো।

ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত ১১ টা। আজকে যে কপালে শনি আছে সেটা বুঝতে আর বাকি রইলনা। পকেট থেকে মোবাইল বের করলাম। অবাক হয়ে গেলাম….জান্নাত অনেক বার কল দিয়েছিলো। ফোন যে সাইলেন্ট মুডে ছিলো মনেই নেই। অনেক গুলো মেসেজ দিয়েছে’এই কল ধরস না কেন?”কি সমস্যা বিজি নাকি? অন্তত একটা মেসেজ দে।’ ‘ঐ চামচিকা ফোন ধর প্লিজ।’ শেষের একটা মেসেজ দেখে বেশ খারাপ লাগলো। মেসেজ টা….’এই রুবেল টেনশন হচ্ছে বলনা তুই কই? আচ্ছা আমি অধিকার খাটাই জন্য ফোন ধরস না? আমি ডিস্টার্ব করি তোকে? আমার কান্না পাচ্ছে খুব। প্লিজ রুবু ফোনটা ধরনা। আমি মরে যাব। ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি।’ কেনো জানি মেসেজ টা পরে চোখের কোনে পানি জমা হলো। জান্নাতকে ফোন দিলাম। রিং হওয়ার সাথে সাথেই ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলো জান্নাত। আমি বললাম….

–এই জান্নাত কি হয়েছে কাঁদছিস কেন?
-(কেঁদেই যাচ্ছে)
–আরে পাগলি ফোন সাইলেন্ট ছিলো সরিরে….প্লিজ বউমনি রাগিস না।

সাথেসাথেই জান্নাত ফোন কেঁটে দিলো। এইরে সেরেছে, মেয়েটি প্রচণ্ড অভিমান করেছে। আর এক মুহূর্ত দেরি করলাম না। এক প্রকার তাড়াহুড়ো করেই চলে গেলাম বাসায়। কলিংবেল বাঁজাতেই আম্মা দরজা খুলে ঝাড়ি শুরু করলো….

-কই ছিলি তুই? এত রাতে কেন ফিরলি? আর যেখানেই ছিলি একটা ফোন কি করা যেতনা? মেয়েটা কেঁদেকেটে শেষ। যা এবার অভিমান ভাঙ্গা পাগলিটার।
–আরে সিয়ামের সাথে দেখা হওয়াতে এত দেরি।
-হইছে এবার আপনার বউমনির রাগ ভাঙ্গান।

বলেই আম্মা মুচকি হেসে চলে গেলেন। একটু লজ্জা পেলাম। রুমে গিয়ে দেখি পাগলিটা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আস্তে করে গলা খাঁকড়ি দিলাম। কোন সারাশব্দ নেই। বললাম….

–বউমনি? এই….
-(নীরব)

আমি জান্নাতের কাছে গেলাম। কাঁধে হাত রাখলাম। জান্নাত হাত সরিয়ে দিলো। অভিমান একটু বেশিই করেছে। আমি জান্নাতকে ঘুরিয়ে আলতো করে ওর গালদুটো চেপে ধরে কপালে আমার ঠোঁটের পরশ একে দিলাম। কি হলো জানিনা, মেয়েটা হুহু করে কেঁদে দিয়ে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পরলো।

আমি জান্নাতের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আর ও আমার শার্ট দু’হাতে খামছে ধরে কেঁদেই চলছে….মাঝেমাঝে মানুষকে কাঁদতে দেওয়া উচিৎ। ভালোবাসা অন্যরকম একটা অনুভূতি অনুভব করা যায়। আমি কিছু বলছিনা। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশে আজকে চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদটা উকি দিচ্ছে আমার ঘরে। একসময় ইচ্ছে করতো চাঁদে যাওয়ার, চাঁদ কে কাছ থেকে একটু ছুয়ে দেখার। কিন্তু এখন আর ইচ্ছে করেনা। কারণ চাঁদ এখন আমার ঘরে, আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে আছে। বড্ড ভালোবাসি এই চাঁদটাকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত