শহরে বড় হওয়া,বেড়ে উঠা ফারিয়া’র পড়া লেখা বেশি দূর করা হয়নি।
তার আগ্রহ ছিলোনা তেমন,তাই।
এস এস সি তে ডাব্বা মেরে বসে আছে পাঁচ ছয় বছর ধরে।
পড়ালেখার চেয়ে গল্পগুজব, বেড়ানো,বিয়ে,গায়ে হলুদ,জন্মদিন পার্টি,বাসার আশেপাশে এসব অনুষ্ঠানাদিতে যেতেই তার বেশি পছন্দ।
আর ঐসব অনুষ্ঠানে গেলে, যদি পছন্দের কিছু হাতের কাছে পেতো,তবে তা ব্যাগে ভরে ফেলতে সে একটুও দ্বিধা বোধ করতোনা।
“নিলে কি সমস্যা!”
ভাবে পিতৃহীন ফারিহা।
“এটা আমার কাছে নেই,কিনতেও পারবোনা, এদের ঘরে অযত্নে পড়ে আছে।
আমি নিলে তো কোনো পাপ দেখছিনা। বরং, আমার কাছে আরো ভালো থাকবে।”
এই হলো তার চিন্তাধারা।
মা মাঝেমাঝে জানতে চান,
-এই গলার সেটটা কোত্থেকেরে?
-বারে,এটা তো তিন,চার বছর আগের..
-কই,আমার তো মনে পড়ছেনা। আর এতো নতুন কেনো?
-তোমার মনে কিভাবে থাকবে, আমি নিজেই ভুলে গিয়েছিলাম! আলমারিতে কাপড়ের ভাঁজে ছিলো মা।
-চুলের এই ক্লিপ কোত্থেকে?
-মিতালী দিয়েছে মা। তার বড়দা’র বিয়েতে গেলাম নাহ,তখন।
-শোন,কেউ কিছু দিলে নিসনা, তুই তো আর ছোট নেই, বাইশ বছর পার হলো!
বয়স হিসেবে বেশি অগোছালো তুই। তোর ছোট বোন তামান্না থেকে কিছু শিখ..
-ওর থেকে শিখবো কেনো?
-তো কার থেকে শিখবি? এতো বয়স হলো তোর, কিছু শিখাতে পেরেছি আমি?
না পড়ালেখা,না রান্নাবাড়া, না ঘর গুছানো।
ঘুরে বেড়ানো, পাড়া বেড়ানো, সাজগোজ এসব ছাড়া, কিছু কি তুই পারিস?
তোর প্রায় সমবয়সী কেউ কেউ এখনো পড়ছে, বেশিরভাগের তো বিয়ে হয়ে গেছে।
আর তুই…
তোর জন্য তো ভালো একটা ঘরও আসছেনা।
তোর তো চেহারাও ভালো।
স্বভাবের জন্য নিশ্চয়, আশেপাশের সবাই ভাঙানি দেয়।
মা অনেকক্ষণ চিল্লান।
-আমি কাপড়ে ফুল তুলতে পারি।
-হুম,তাই দিয়ে সংসার করিস ।
কাল থেকে তুই রাঁধাবাড়া করবি..
-না মা এতো বড় শাস্তি দিওনা।
-অবশ্যই দিবো। আর ঘর থেকে বেরুবিও না।
কে শুনে কার কথা, পরদিনই মা গোসলখানায় ঢুকলে, সে সেজেগুজে পাড়া বেড়াতে চলে যায়।
পাশের বাসার একজন, তার এক বান্ধবীর ভাইয়ের জন্য, ফারিয়া’র কথা বলে।
ছেলে গ্রামে থাকে,বিদেশ ফেরত। বয়স একটু বেশি,তবে সুদর্শন।
ছেলেদের বয়স কোনো ব্যাপার না।
মেয়ের বয়সও তো কম নয়!
তাছাড়া পড়ালেখাও তো বেশি করেনি।
ফারিয়া’র বড় ভাই ধরতে গেলে এখনো ছোট, মাত্র পঁচিশ বছর। এই বয়সেই ঘরের সব খরচ তার একজনের উপর।
ছোটবোন কলেজে পড়ে, বেশ স্মার্টও। টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ নিজেই যোগাড় করে।
বলতে গেলে, ফারিয়াই শুধু কোনো কাজের নয়।
আর প্রস্তাবও খারাপ না, একটা টাকাও যৌতুক চাইছেনা।
পাত্রপক্ষ একবার এসে দেখেও গেছে, খুব পছন্দ হয়েছে তাদের।
হবেনা কেনো,ফারিয়া’র গায়ের রঙ দুধে আলতায়, চেহারা সুরুত মাশাল্লা অনেক সুন্দর!
তবুও ফারিয়া’র পরিবারকে, ধার দেনা করে, বিয়ে দিতে হয়।
কিছু না করলেও বিয়ে বলে কথা! এক দেড়শত মানুষ, কিভাবে যেন হয়ে যায়।
কেউ একবারও ফারিয়াকে জিজ্ঞেস করেনি,
“ফারিয়া,তোর কি এই বিয়েতে মত আছে? ছেলে কি তোর পছন্দ হয়েছে?”
তবুও ফারিয়া,জোর গলায় প্রতিবাদও করতে পারেনা।
তার মনে কি, সে নিজেও জানেনা!
ফারিয়া’র মনেও তো বিয়ের স্বপ্ন।
কিন্তু কেনো যে তার জন্য তেমন কোনো প্রস্তাব আসেনি!
তবুও বান্ধবীদের সাথে তাল মিলিয়ে, তাদের সাথে সেও কতো কতো গাল গল্প করে বলেছে,
-জানিস, ডাক্তার ছেলে প্রস্তাব এসেছে আমার জন্য। এক জমিদারের ছেলের জন্যও চেয়েছে আমাকে।
-তো বিয়ে হয়নি কেনো?
-ধুর ডাক্তারটা পড়তে পড়তে বুড়ো হয়ে গেছে… পঁয়ত্রিশের বেশি! আর জমিদারের ছেলে মদ খায় তো,তাই।
বান্ধবীরা বুঝতো হয়তো,হাসতো তারা।
ফারিয়া, কতো বান্ধবীর বিয়ে যে সে খেয়েছে!
তাদের বাচ্চার জন্মদিনেও সে যায়।
কখনো দাওয়াত নিজে থেকেই নিয়েছে।
এসবে যেতে যে, তার কোনোই আপত্তি নেই কখনো।
আর আজ বিয়ে হচ্ছে, তাও পঁয়ত্রিশ ঊর্ধ্ব একজনের সাথে।
সব বান্ধবীকে বলাও হয়নি বিয়েতে।
বিয়ের সাজে খুব সুন্দর দেখায় ফারিয়াকে।একেবারে পরী।
কিন্তু বিদায়ের সময় এতো কান্না পাচ্ছিলো..
এই পরিচিত মহল ছেড়ে, একেবারে অপরিচিত জায়গা,অপরিচিত পরিবেশে যাচ্ছে সে।
কিভাবে, কেমন করে সে মানিয়ে নেবে,পারবে তো?
বিয়ে হয়ে যায়। গ্রামের বাড়ি,বেড়ার ঘর।
এমন পরিবেশে এই প্রথম সে।
এতো এতো মানুষ, রুমের দরজা,জানালা আটকে তাকে ঘিরে দেখছে, মন্তব্য করছে।
যেন সে খাঁচায় বন্দি, আর সবাই দর্শনার্থী!
কেউ সুন্দরের প্রশংসা..
কেউ বলে,কচি মেয়ে না,বয়স হয়েছে।
কেউ বলেন, খালি হাতে ঢনঢন করে চলে এসেছে…
নানাবিধ কথা।
আর ফারিয়া চোখ ঘুরে ঘুরে ঘর দেখে।
বেড়ার ঘর,ফাঁক ফোকর দিয়ে আলো ঢুকছে।
আর তা বাধা দেবার জন্য আটা দিয়ে, নিউজপেপার আটকিয়ে দেয়া হয়েছে বেড়াতে।
তার উপর কিছু দৃশ্যাবলীর ছবি আটকানো।
সোকেস বেডরুমের ভেতর। তার মধ্যে কোনো সোপিস নেই,সব কাঁচের থালা বাসন পেয়ালা।
কাঠের আলমারি একটা। আর সে বসেছে ঐ খাটটি, এই হলো ফার্নিচার।
ফারিয়া’র তখনই ইচ্ছে করে,থালা বাসন সব সরিয়ে ওখানে বান্ধবী মারুফা’র ঘরের মতো, সোপিস এনে সাজায়। কি সুন্দর ছিলো তা!
আস্তেধীরে দর্শনার্থী সবাই চলে যায়। ঘরে কিছু মেহমান থাকে শুধু।
খুব ভোরে বর তাকে ডেকে দেয়,
-এ্যাই, উঠো, একটু পর আলো ফুটবে।
আসো,পুকুর দেখিয়ে দিচ্ছি, গোসল করে নেবে।
-কি বলেন,এতো রাতে!
-রাত কই? ভোর চারটা। কিছুক্ষণ পর আজান দিবে,সবাই উঠে যাবে। তাড়াতাড়ি করো।
অনিচ্ছায় ফারিয়া উঠে পড়ে।
উঠার সময় বরের পেট ফোলা মানিব্যাগ চোখে পড়ে,বালিশের পাশে।
ফারিয়াকে, বাথরুম সেরে, ঐ বদনা দিয়েই পানি তুলে গোসল সারতে হয়।
সে পুকুরে কোনোদিন গোসল করেনি,সাঁতারও পারেনা। ভয়ে ডুব মেরে গোসল করা হয়না তার।
যদি পায়ের নিচে মাছ টাছ কিছু পড়ে!
বর আরমানটা পুকুরে দেখিয়েই চলে গেছে, বউয়ের পাশে দাঁড়াতে লজ্জা করছে মনে হয়।
রুমের ভেতর উদোম বউ লজ্জা করেনি,হামলে পড়েছে,আর পুকুর ঘাটে ভেজা কাপড়ে দেখতেই লজ্জা!
হঠাৎ আরমানের উপর রাগ উঠে ফারিয়া’র।
খুব ছোট্ট করে জ্বালিয়ে রাখা ল্যাম্পের আলো আঁধারে সে গোসল করে।
কখনো দিনের আলোয় গোসলের সুযোগ পেলে অবশ্যই ডুব দিয়ে করার আগ্রহ জন্মে তার মনে।
ঘরে ঢুকে দরজার শিটকিনি লাগিয়ে রুমে এসে দেখে,আরমান ঘুমের ঘোরে নাক ডাকছে।
সে তাড়াতাড়ি অন্ধকারেই মানিব্যাগ থেকে হাতড়িয়ে কিছু টাকা বেডের নিচে লুকিয়ে ফেলে।
আরমানের মনে হয়,স্বপ্ন দেখছে কিছু। তারমধ্যে কাগজের কচকচে শব্দ শুনছে সে।
সকাল হয়, নতুন বউয়ের ডাক পড়ে রান্নাঘরে।
আরমান খেয়েদেয়ে বাজারে যায়।
ব্যাগ খুলতেই টাকা কম! সাথে কিছু জরুরি কাগজও নেই।
ঘরে এসে খুঁজতে থাকে,বালিশের নিচে,খাটের নিচে,শেষে ফারিয়া’র দিকে বেডের নিচে মিলে এলোমেলো টাকা আর কাগজ।
রুমে ফারিয়া’র ডাক পড়ে।
আর আরমানের মনে পড়ে স্বপ্নের কচকচে শব্দের কথা!
অস্বীকার করলে খসে এক থাপ্পড় দেয় আরমান।
তারপর স্বীকার করে ফারিয়া।
প্রথম দিনেই মার খেয়ে ফারিয়া স্তব্ধ.. আর আরমান নতুন বউয়ের প্রতি খুবই অসন্তুষ্ট!
দিন যায় এভাবেই। ফারিয়া মারের কথা ভুলে যায়,সুযোগ পেলেই ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে দেয়।
আর আরমান নিত্য নতুন জায়গায় টাকা লুকাতে থাকে। কি করবে,তার স্বভাব যে বদলাতে পারছেনা। গালিতেও না,মারেও না।
ফারিয়া ঐ চুরির টাকা দিয়ে শখের এটা ওটা জিনিষ কেনে,যা আরমানকে বললেও কিনে দিতো। কিন্তু স্বভাব! তা যে যাবার নয়।
জা,শ্বাশুড়ি, ননদ সবার জিনিষও তার নিজের মনে করে ব্যবহার করতে গিয়ে বারবার ঝগড়া হয় ঘরে।
কাজকর্ম কম পারে,তা নিয়েও ঝগড়া।
কিন্তু ফারিয়া একদিনও কারো সাথে কথা না বলে থাকতে পারেনা।
ঝগড়া করার বারো ঘণ্টার ভেতর সে আবার যেচে কথা বলতে যায়।
কেউ ফারিয়াকে পাগল বলে,কেউ চোর।
কিন্তু ফারিয়া যেমন তাই থেকে যায়।
সে তার নিজের মতো করেই ভালো থাকে।।