‘এই মামা, এই লুঙ্গিটা কত?’ বলে দোকানদারের দিকে তাকালাম। দোকানদার তখন অন্য কাস্টমার নিয়ে ব্যস্ত। একটু পরে সে আমার দিকে তাকিয়ে বললঃ
– ‘মামা, কোনটা?’ আমি হাতের লুঙ্গিটা ওর হাতে দিয়ে বললামঃ ‘এইটা।’
– ‘একদাম ছয়শ টাকা পড়বে।’ ‘কি বলেন? প্রতিবার-ই তো আপনার কাছ থেকে নিয়ে যাই তিনশ টাকা করে।’
– ‘প্যাঁচালা থামান মিয়া। এখন গরমকাল। মানুষ গরমের যন্ত্রনা থেকে বাঁচার জন্য লুঙ্গি পরে। প্রয়োজনের সময় একশ টাকার জিনিস এক হাজার টাকা দিয়ে বিক্রি করলে ও সমস্যা নেই। একদান পাঁচশ পঞ্চাশ। নিলে নেন, নাহয় যান।’ ‘আপনি কিন্তু, মানুষের দুর্বলতা নিয়ে খেলা করছেন। ভাল হচ্ছেনা কিন্তু! আমি তিনশ পঞ্চাশ টাকা দিচ্ছি। লুঙ্গিটা দেন।’
– ‘পারব না। আপনি যেতে পারেন।’
অবস্থা দেখে বুঝলাম এই দোকানদার হার মানবে না। অনেক দামাদামি করার পর চারশ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে লুঙ্গিটা নিয়ে ফুরফুরা মনে বাসায় যাওয়ার জন্য রিএক্সা নিলাম। রিক্সায় উঠে মনে হল প্যান্ট খুলে লুঙ্গিটা পরে নিই। তবে, রাস্তাঘাটে যে হারে লোকজন, আমার কান্ড দেখে আবার পাগল না ভেবে বসে। বাসায় এসে তাড়াতাড়ি করে লুঙ্গিটা পরে নিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করলাম অন্য এক আমিকে। লুঙ্গিতে যে আমাকে এত ভাল লাগে তা আগে জানলে ছোট বেলা থেকেই লুঙ্গি পরে আসতাম।
নিশির সাথে দেখা করার কথা এগারটায়। এই সময়কার সূর্যটা খুবই হিংস্র। মানুষকে জ্বালিয়ে সে শান্তি পায়। নিশি মেয়েটা ও অদ্ভুত। দেখা করবে ভাল কথা, বিকেলে দেখা করা যায়, একেবারে ভোরে ও তো পারা যায়! কিন্তু, এই ভরদুপুরে কেন?
ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতলটা বের করে পানি দিয়ে মাথা ভিজিয়ে নিলাম। তারপর, বোতলটা হাতে নিয়ে লুঙ্গি পরা অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। লক্ষ্য, ওই দূরের বাগানটা। যেখানে নিশির সাথে প্রতিদিন দেখা করি।
সবুজ গাছপালায় ঘেরা ছোট্ট, সুন্দর বাগান। বিভিন্ন গাছের সমারোহ। সূর্যের আলো বিশাল বটগাছটা ভেদ করে নিচে আসতে পারেনা। তার নিচেই ছোট্ট একটি বৈঠকখানা। হয়তো, কোনো সুহৃদয়বান ব্যক্তি আমাদের মত প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্যই এই স্থানটি বানিয়ে দিয়েছেন। মাঝেমাঝে মন থেকে তাকে খুব ধন্যবাদ দিই।
সে বটগাছের নিচের বৈঠকখানায় নিশি বসে আছে। সে বারবার ঘেমে যাচ্ছে। হাতে থাকা রুমাল দিয়ে বারবার ঘাম মুছার চেষ্টা করছে। কিন্তু, সে পারছে না। এদিকে মুছলে ওইদিকে আবারো ঘাম জমে। একসময় ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে হার মানতে বাধ্য হয়।
আমাকে দেখে নিশি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। গুরুজন দেখার মত নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এই গরমে লুঙ্গি পরে নিজেকে খুব বেশি সুখী মনে হচ্ছে। নিশির শোচনীয় অবস্থা অর্থাৎ গরমের মধ্যে তার কষ্টটা দেখে মনে মনে কষ্ট হচ্ছে আবার খুশি ও লাগছে। হঠাৎ করে, অগ্নিশিখার মত দু’টো চোখ আমার দিকে তুলে নিশি হুংকার দিয়ে উঠলঃ
– ‘সাইফ, তুমি কি আসলে কোনোদিন শুদ্ধ হবেনা?’ ‘কি করলাম আবার?’
– ‘তুমি কি গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে আসছ নাকি গরু চরাতে?’
‘তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড নাকি গরু? যদি গার্লফ্রেন্ড হও তবে দেখা করতে আসছি। যদি গরু হও তাহলে চরাতে আসছি।’
– ‘বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু! লুঙ্গি পরে আসছ, তার উপর বড় বড় কথা।’ ‘এই গরমের দিনে লুঙ্গি পরাটা ও এক ধরণের আর্ট।’
– ‘আমি গেলাম। তুমি থাক তোমার লুঙ্গি নিয়ে।’ হাতে থাকা ঠান্ডা পানির বোতলটা নিশির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললামঃ ‘বাবু, পানি খাও।’
– ‘তুই খা তোর পানি।’ বলে মুখ কালো করে হনহন করে হেঁটে যেতে লাগল নিশি।
আমি ও হাঁটতে লাগলাম বড় রাস্তা বেয়ে। ইতোমধ্যে তিনবার লুঙ্গিটা ঠিক করে নিয়েছি। কিছুদূর যেতেই নিচের দিকটা খুবই হালকা মনে হতে লাগল। নিচে তাকিয়ে দেখলাম লুঙ্গি নেই। মাটিতে খুবই নির্বিকারভাবে পড়ে আছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি এলাকার ছোট ভাই মকবুল দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই সে চেহারা লুকানোর চেষ্টা করল। কাঁদো কাঁদো গলায় বললঃ
– ‘ভাই, সরি। আমি আপনাকে রহিম মনে করছি। তাই, এই কাজ করলাম।’
বুঝলাম সে কোন কাজ করল। লুঙ্গি তাহলে আপনা আপনি খুলেনি। মকবুলই এই কাজ করছে। সে যেহেতু ক্ষমা চায়ছে তাই তাকে অভয় দিয়ে চলে যেতে বললাম। ততক্ষণে, রাস্তার পাশে খেলছিল এমন কিছু ছেলেমেয়ে মকবুলের কাজটা দেখে ফেলেছিল। এই কাজটা খুবই আনন্দের একটা খেলা মনে হয়েছে তাদের। তারা ও সেই আনন্দ উপভোগ করতে এসে পড়ল আমার সামনে। তারপর সেই খেলা। লুঙ্গির চারদিক থেকে চারজন মিলে টানতে লাগল। আমি কোনোমতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌঁড়াতে লাগলাম।
বাসায় এসে হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রিজ থেকে আরেকটা বোতল বের করে শরীরটা ভিজিয়ে নিলাম। তারপর বোতলে মুখ লাগিয়ে দিয়ে হুরহুর করে পানি পান করতে লাগলাম। এই গরমের সকল অশান্তির মাঝে একমাত্র শান্তি এই ফ্রিজের ঠান্ডা পানিতেই বিদ্যমান।