দেয়াল

দেয়াল

সারারাত ঘুমালাম, সারা সকাল ঘুমিয়ে পার করে দিলাম। ঘুম থেকে উঠলাম ভর দুপুরে। ভাগ্য ভাল মোবাইল বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম। নয়তো কেউ না কেউ ফোন দিয়ে ঠিকই ঘুম ভেঙ্গে দিত। ব্রাশ করতে করতে মোবাইল অন করলাম। একটু পরেই তিনটা ক্ষুদে বার্তা এলো আমার মোবাইলে।

— কুত্তা তোর ফোন বন্ধ কেন?
— হারামী ঘুমাচ্ছিস নিশ্চয়ই।
— মোবাইল অন করে ডাটা অন কর।

এভাবেই তিনটা বার্তা এসেছে অরিত্রীর নাম্বার থেকে। আমি কালবিলম্ব না করে ডাটা অন করলাম। পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় হোয়াটসঅ্যাপ থেকে নোটিফিকেশন আসলো। Oritri ( 41 Unread messages) আমি অবাক হলাম। এতগুলো বার্তা পাঠানোর কারন কি? কোন সমস্যা হয়নি তো আবার? ভয়ে ভয়ে আমি ক্লিক করলাম নোটিফিকেশনে। প্রথমে লেখা

— সারা বছর কলেজে আসবি না, আর তোর জন্য নোট জোগাড় করা লাগে আমার। তারপর বেশ কয়েকটা ছবি দেয়া। এবং সবার শেষে আরেকটা পারমানবিক বোমার সমতুল্য বার্তা। সেখানে লেখা,

— বিকেলে ভোজনবিলাসে এসে ট্রিট দিয়ে যাবি। ফ্রাইড চিকেনে বিশেষ অফার চলছে। তোর খরচ বেঁচে যাবে।

আমি এবার দৌড়ে গিয়ে নিজের পকেট চেক করি। পকেটে দুইটা একহাজার টাকার নোট দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। বাবা তাহলে হাত খরচের টাকা দিয়েই অফিসে গেছেন। আমি ফোন দিলাম অরিত্রীকে। ফোন ধরলো না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবলাম হয়তো ক্লাশে আছে। তাই আমি আর ফোন দিলাম না। মনযোগ দিয়ে ক্লাশ করুক। তাহলে আমার জন্যই ভাল। ক্লাশে না গিয়েই সবকিছু পেয়ে যাই অরিত্রীর কল্যাণে। বিকেলে ভোজনবিলাসে গিয়ে অপেক্ষা করি অরিত্রীর। সবসময় ও আগে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করলেও আজকে কেন যেন ও দেরী করছে। ফোন দিলাম। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরলো,

— অরি কই তুই কুত্তি? একঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছি তোর জন্য।

আমি অরিত্রীর ঝাঁঝালো কন্ঠ শোনার অপেক্ষায় থাকি। কিন্ত আমাকে অবাক করে দিয়ে পুরুষালী কন্ঠে কে যেন বলে উঠে,

— অরিত্রী আজকে আসতে পারবে না।

আমি প্রথমে চমকে যাই। চেষ্টা করি কন্ঠের মালিকের পরিচয় মনে করার। অরিত্রীর বাবার কন্ঠ আমি ভালমতই চিনি। উনি আমার সাথে এভাবে কথা বলবেন না। আমার কন্ঠ শুনলেই উনি প্রথমে আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। এছাড়া আর কেউ তো অরিত্রীর ফোন উঠায় না।

— কে বলছেন আপনি?
— আমি আরিফ বলছি।
— আরিফ? ওহ আরিফ ভাই কেমন আছেন?
— ভাল।

উনি আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিলেন। আমি কিছুটা অবাক হলাম। অরিত্রীর ফোন আরিফ ভাইয়ের কাছে কেন? আরিফ ভাই হচ্ছেন অরিত্রীর বয়ফ্রেন্ড। উনি আমাদের ইউনির বড়ভাই। আমার মাধ্যমেই অরিত্রীর সাথে উনার পরিচয় হয়েছিল। তারপর আমি একাই খাবারের অর্ডার দিলাম। খাবার আসার পর একটুখানি খাওয়ার পর বুঝতে পারলাম যে আমার খেতে ভাল লাগছে না। নবম শ্রেনীতে পড়ার সময় সবার প্রথম অরিত্রীর সাথে আমার পরিচয় হয়। ওর সাথে পরিচয় হওয়ার পর এই প্রথম ভোজনবিলাসে একা একা খেতে হচ্ছে। তাই হয়তো ভাল লাগছে না। তবুও বহু কষ্টে খাওয়া শেষ করলাম। খাই অথবা না খাই টাকা তো দেয়া লাগবে। ফেসবুকে লগইন করার পর নিউজফিডে প্রথমেই অরিত্রীর ছবি চলে এলো। তাও আরিফের সাথে। দিয়ে দিলাম একটা লাভ রিয়েক্ট। কমেন্ট করতে গিয়েও কেন যেন করলাম না। কিছুক্ষন পর অরিত্রী ফোন দিল। আমি খুশি হয়েই ফোন ধরলাম।

— হ্যালো অরি বল।
— সরি রে দোস্ত আসতে পারলাম না। আরিফের সাথে এক জায়গায় গিয়েছিলাম।
— তাই নাকি দোস্ত? তা কি কি করলি তোরা?
— কি কি করলাম মানে? ফাজিল ছেলে একটা। মেরে তোর হাড় গুড়ো করে দেব।
— প্রতিদিন ক্যালসিয়ামের ট্যাবলেট খাই। এত সহজে হাড় গুড়ো করতে পারবি না।
— তাই না! কালকে আয় ইউনিতে। দেখবো তোর হাড় কত শক্ত।

আরো কিছুক্ষন কথা বলে অরিত্রী ফোন রাখলো। অরির সাথে কথা বলে মনটা এখন বেশ হালকা লাগছে। পেটটাও বোধহয় খালি হয়ে এসেছে। তাই তাড়াতাড়ি বাসায় গেলাম। রাত এগারোটায় হঠাৎ মনে হলো যে অরিত্রী কি করে জিজ্ঞেস করি। তাই মেসেঞ্জারে ঢুকলাম অরিত্রীকে নক করার জন্য। কিন্তু আমি জানতাম না যে এতবড় একটা সারপ্রাইজ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। অরিত্রীর নামে ক্লিক করেই আমি বোকা বনে গেলাম। অরিত্রী আমাকে ব্লক দিয়েছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। প্রথমে ভাবলাম হয়তো অন্য কারো নামে ক্লিক হয়ে গেছে। কিন্তু নামটা তো ঠিকই আছে। তাড়াতাড়ি করে ফেসবুকে লগইন করে অরিত্রীর আইডি খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু পেলাম না। মানে ফেসবুকে পর্যন্ত আমাকে ব্লক করেছে অরিত্রী। মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল আমার। এমন কি করলাম যে আমাকে ব্লক দিল অরিত্রী? ব্যাপারটা জানতে হবে। তাই ফোন দিলাম অরিত্রীকে। কয়েকবার ফোন দেয়ার পর ফোন ধরলো।

— অরি তুই আমাকে ব্লক দিলি কেন?
— ( ওপাশ থেকে কোন কথা বললো না।)
— হ্যালো অরি শুনতে পাচ্ছিস?
— শুনছি, বল।
— ব্লক দিয়েছিস কেন আমায়?
— আরিফ তোর আর আমার ফেসবুকে কানেক্টেড থাকাটাকে ভাল চোখে দেখে না রে। তাই বাধ্য হয়ে….!
— ওহ।

আমি ফোন রেখে দিলাম। এমন কিছু একটা হবে তা আমি আগেই টের পাচ্ছিলাম। যাক এটা ব্যাপার না, ভার্চুয়ালে কানেক্টেড না থাকলে কি হয়? বাস্তবে তো কানেক্টেড আছি। কিন্তু দুইদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম যে অরি ভার্চুয়ালের সাথে সাথে বাস্তবেও আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ইউনিতে যাই, একা একা ঘুরি ফিরি। অরিত্রী আসে না আমার কাছে। আমি কথা বলার চেষ্টা করলেও দায়সারা ভাবে আমার কথার উত্তর দিয়ে ক্লাসের বাহানায় চলে যায়। কয়েকদিন ধরেই এমন চলতে থাকে। আমি বুঝতে পারি আরিফের কারণেই এমন হচ্ছে। আমি কয়েকদিন খেয়াল করেছিলাম অরি আর আমি একসাথে থাকলেই কোথা থেকে যেন আরিফ চলে আসতো। তারপর বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে অরিকে নিয়ে যেত। আমি অরিত্রীকে ফোন দিলাম। বেশ কয়েকবার ফোন দিলাম। কিন্তু ও ফোন ধরলো না। আন্টির নাম্বারেও ফোন দিলাম। আন্টির সাথে কিছুক্ষন কথা বলার পর বললাম অরিত্রীকে দেয়ার জন্য। অরিত্রী এলো না। ওর নাকি শরীর খারাপ। আমার সাথে কথা বলতে পারবে না। আমিও তখন ফোন রেখে দিলাম।

মাঝে মাঝে আমার রাতে ঘুম হয়না। আজকেও বোধহয় হবে না। ভাবতে লাগলাম অরির সাথে আমার কাটানো কিছু মজার মূহুর্তের কথা। কলেজ থেকে জাফলং গিয়েছিলাম আমরা বেশকয়েকজন। নদীর পানিতে বিশাল বড় সাইজের জোঁক ছিল। কিভাবে যেন একটা জোঁক আমি হাতের তালুতে নিয়েছিলাম। জোঁকটা আমার হাতের তালুতে আটকে ছিল। এই জোঁক নিয়ে অরিকে এমন ভয় দেখিয়েছিলাম যে ভয়ে ওর জ্বর চলে আসে। এই ঘটনার পর বেশ কয়েকদিন ও আমার সাথে কথা বলেনি। অরিকে আমার আম্মু মেয়ের মত দেখতো। ও সবসময় আমাদের বাসায় আশা যাওয়া করতো। সেদিনও অরি খুব সাঁজ দিয়ে আমাদের বাসায় আসলো। আমাকে বললো,

— আবির চল আমার এক কাজিন আফরিনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাবো।

এই প্রস্তাবে তো অনেক খুশি হলাম। কারণ অরির কাজিন অাফরিন সেই লেভেলের সুন্দরী ছিল। আমার প্রথম এবং শেষ ক্রাশ। আর অরিত্রী সেটা জানতো। তো আমি খুশিতে নাচতে নাচতে নায়ক নায়ক ভাব নিয়ে নতুন জামা কাপড় পরে স্নো, পাউডার মারতে লাগলাম। এমনভাবে বডি স্প্রে মারলাম যে ঘরার মশা সব বাপ বাপ করে পালিয়ে গেল। সবশেষে ভাব নেয়ার জন্য মুখে একটা টুথপিক ঢুকিয়ে অরিত্রীর সামনে গিয়ে বললাম,

— অরি চল আমি রেডি। অরি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমি ওর মাথায় টোকা দিয়ে বললাম,

— কিরে হা করে আছিস কেন? চল তাড়াতাড়ি যাই। তখন অরি হাই তুলতে তুলতে বললো,

— দোস্ত তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে আজকে ওর জন্মদিন না। আজকে ওর এনগেজমেন্ট। ছেলে বিসিএস ক্যাডার।

এই কথা শুনে তো আমি পুরো ছক্কার বাপ হয়ে তাকিয়ে রইলাম অরির দিকে। আর অরি ডাইনি মার্কা হাসি হাসতে লাগলো। এমন আরো অনেক মজার মূহুর্ত কাটিয়েছি আমরা। ভাবতেই অবাক লাগছে অরির সাথে এমন মূহুর্ত আর কাটাতে পারবো না। কারন শুনেছি আরিফের সাথে ওর বিয়ের কথা চলছে। রাত দুইটা। আমার ঘুম আসছিল না। কি মনে করে অরিকে ফোন দিলাম আবারো। এবার দুইবার রিং বাজার পরপরই ফোন ধরলো।

— হ্যালো অরি।
— ( কোন শব্দ নেই)
— হ্যালো অরি শুনতে পাচ্ছিস?
— ( নিশ্চুপ)
— হ্যালো অ..! পুরোটা বলতে পারলাম না। তার আগেই কানে ভেসে এলো কান্নার শব্দ। আমি অবাক হয়ে গেলাম।

— হ্যালো অরি তুই কাঁদছিস? হ্যালো, হ্যালো অরি!
— আবির তুই প্লীজ আমাকে আর ফোন দিস না। আরিফ তোকে নিয়ে আমাকে সন্দেহ করে। আজকে এতগুলো নোংরা কথা বললো। আমি অারিফকে হারাতে চাই না। আমার কথা ভেবে হলেও আমার সাথে আর যোগাযোগ করিস না।

আমি কিছু বলার আগেই অরি ফোন কেটে দিল। আমাকে আর অরিকে নিয়ে সবাই সন্দেহ করবেই। কারণ একটা ছেলে আর একটা মেয়ে প্রেমিক প্রমিকা না হয়ে ভাই বোন হতে পারে তা কেউ বিশ্বাস করে না। প্রেমিক প্রেমিকা না হয়ে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস বন্ধু হতে পারে তা কেউ বিশ্বাস করে না। কারন বর্তমানে জাস্টফ্রেন্ড নামক শব্দে বন্ধু নামক পবিত্র শব্দ কলঙ্কিত। ফোন রেখে দিয়ে আমি চোখ বন্ধ করলাম। ড্রয়ারে ফ্রিজিয়াম থাকার কথা। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না।

এরপর কয়েকদিন কেটে গেল। ইউনিতে যাই, একা একা এদিক সেদিক ঢুঁ মারি। অরিত্রীর সাথে দেখা হয়। কিন্তু যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। আমিও কথা বলার চেষ্টা করি না। আমার বন্ধুটা সুখে থাকুক এটাই আমি চাই। এখন আর ভোজনবিলাসের সামনে দিয়ে হাঁটি না। দেখলেই কেমন যেন মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই রেস্টুরেন্টের প্রতিটি চেয়ার টেবিল আমাদের চেনে। আচ্ছা ওরা কি জানে আমরা এখন আর কোনদিন একসাথে ওদের উপর বসবো না?
একমাস কেটে গেল অরিত্রীর সাথে যোগাযোগ ছাড়াই। সেদিন নদীর পাড়ে দেখলাম অারিফের সাথে হাতে হাত ধরে হাঁটছে। ওকে ভাল থাকতে দেখে আমারো ভাল লাগছিল। আজকে আমি বসে আছি রমজানের চায়ের দোকানে। বসে বসে বুড়ো চাচাদের রাজনৈতিক আলাপন শুনছিলাম। হঠাৎ অরিত্রী এসে আমার পাশে বসে পড়লো। অরিত্রীকে দেখে আমি যথেষ্ট অবাক হলাম। অরিত্রী আমার দিকে তাকিয়ে সেই ডাইনি মার্কা হাসি দিয়ে রমজানকে বললো,

— মামা আলগা পাতি দিয়ে দুইটা চা বানাও। একটা চিনি বেশি আরেকটায় তার চেয়েও বেশি। আমি তখনও তাকিয়ে আছি ওর দিকে। অরিত্রী আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

— কিরে হা করে আছিস কেন? ভাবছিস আমি এখানে কি করি?
— হ্যাঁ।
— আরিফকে লাথি মেরে জীবন থেকে বিদায় করে দিলাম। অরির জবাব শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম।

— মানে কি?
— বাচ্চা পোলাপান হয়ে মানে জানতে আসিস না। তারপরেও বলছি শোন।

তোকে ছাড়া আমার জীবনটা এলাচি ছাড়া বিরিয়ানির মত। দাঁতের নিচে পড়লে মনে হয় এই এলাচি দেয়া অর্থহীন। কিন্তু না দিলে বিরিয়ানি অপূর্ণ থেকে যায়। বিরিয়ানিতে তো মাংস অনেক থাকে কিন্তু এলাচি থাকে দুই একটা। আরিফ হচ্ছে মাংসের মত। জীবনে অনেক পাবো। কিন্তু তুই হচ্ছিস এলাচির মত। বিরিয়ানিতে না থাকলে বিরিয়ানি অপূর্ণ থেকে যায়।

— তোর কথা বুঝলাম না।
— আমি নিজেও নিজের কথা বুঝিনি। তবে এতটুকু বুঝি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি তোর পাশে থাকবো। কেউ তোর আর আমার সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ করলে তাকে জীবন থেকে সরিয়ে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করবো।
— আর যদি বিয়ের পর তোর স্বামী সন্দেহ করে?
— তাহলে তাকে খোদাহাফেজ বলবো।

অরির কথায় আমি হাসি, ও নিজেও হাসতে হাসতে ওর পেটে হাত দেয়। সাথে সাথে আমার বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। এই ইঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছে আজ আমার পকেট খালি হবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত