আগামীকাল আমার এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবে। পরীক্ষার পরের দিনগুলো বেশ মজায় কাটিয়েছি। কোন টেনশনই ছিলো না, কিন্তু আজ এই অন্তিম মূহুর্তে এসে আমার খুব ভয় করছে। কাল কি হবে, যদি অনেক ভালো রেজাল্ট করি? সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারতাম। যদি ফেল করে বসি? না না না মরেই যাবো আমি। ভাবতেই পারছিনা, অশান্তি লাগছে।
আমার এখনো মনে আছে টেষ্ট পরীক্ষার ফলাফল যেদিন স্কুল থেকে দেয়া হলো তখন আমার সব বন্ধুরা অনেক ভালো রেজাল্ট করেছিলো। অনেকের মা বাবা স্কুলে এসে স্যারদের মিষ্টি খাওয়াচ্ছিলো। স্যাররাও তাদের সন্তানদের প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছেলেন। স্পষ্ট মনে আছে স্যাররা বলিতেছিলেন যারা ফোর পয়েন্ট রীচ করেছে এবং ফাইভ রীচ করেছে একমাত্র তারাই এসএসসিতে ফাইভ, গোল্ডেন ফাইভ গেইন করতে পারবে। আমার স্কোর ছিলো টু আর থ্রি এর মাঝামাঝি। আর আমি এমন আহামরি ছাত্র’ও ছিলামনা। তারপরেও এই টেষ্ট পরীক্ষার রেজাল্টেই সব কিছু পাল্টে দিতে লাগলো।
ফ্রেন্ডরা অনেকেই আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগলো। যারা যারা টেষ্টে ভালো করেছে স্যাররা তাদের আলাদা গাইড দিতে লাগলো। তখন আমার অবস্থা আর বর্তমানে রোহিঙ্গাদের অবস্থা একই ছিলো। সব কিছু থেকে বঞ্চিত মনে হচ্ছিলো।
বাড়িতে সবাই সব আশা ভরসা ছেড়ে দিয়েছে। বড় চাচ্চু আমাকে একটা থাই গ্লাস কোম্পানিতে কাজে ঢুকিয়ে দেয়ার ফরমাল্যাটিস কমপ্লিট করে ফেলছেন। কোনো দিক থেকেও মিনিমাম ভরসাটুকু কেউ আমাকে দেয় নাই। স্কুলে সবাই রেগুলার কোচিং করা শুরু করে দিয়েছে। আমার পড়াশোনা কন্টিনিও করার কোন উপায় আর পাচ্ছিলাম না। শেষমেশ আম্মার কান্নাকাটিতে সবাই রাজি হয়েছে ফাইনাল পরীক্ষাটা দেয়ার। দুদিন কোচিংএ যাওয়ার পর যখন বুঝলাম আমি কারো লেভেলে আর নাই তখন দিলাম কোচিং ছেড়ে, যা হবার হবে। প্রতিজ্ঞা করলাম বাড়িতে বসে একা প্রস্তুতি নিবো কারো দরকার নাই আমার। সেইদিন যে দরজা লাগিয়ে পড়তে বসেছিলাম আর স্কুল মুখি হইনি।
ঘর থেকে বের হয়ে চারপাশ আর দেখিনি। আমার এই অবস্থায় আমার আম্মা ছিলেন নিরব সহযোদ্ধা। যিনি প্রতিনিয়ত আমার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। প্রতিদিন ভোরে উঠে অযুর পানি গরম করে দিতেন। চা বানিয়ে দিতেন। আমার পাশেই নামাজ পড়তেন। আর মোনাজাতে কান্নাকাটি করতেন। আম্মা কোনদিন আমার মনের বিরুদ্ধে কিচ্ছু বলে নাই। বরং রাতে তিনটার সময় মাঝে মাঝে উঠে বলতো বাবা ঘুমায় পরো আর পড়তে হবে না। আমি তাও পড়তাম। বড়জোর দু’ঘণ্টা ঘুমাইতাম আর দিনে বিকেলে একটু সময়। এভাবে জেদ করেই প্রস্তুতিটা নিয়েছিলাম। একেবারে পরীক্ষার হলে আমার যাওয়া। এর আগে এডমিট কার্ডটাও নিতে আসি নাই, সেটা চাচ্চু এসে নিয়েছিলো।
প্রতিদিন পরীক্ষা দিয়ে জাস্ট দুটো ফ্রেন্ডের সাথে বসে অবজেক্টিব মিলিয়ে আবার বাড়িতে এসে পড়তে বসে যেতাম। আমার চুল দাড়ির কথা আর কি বলবো। এটা নিয়ে রীতিমত একটা ট্রল শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমার চুলের বিবরনটা জাস্ট দেই। যখন মাথা নুয়ে লিখতাম তখন ফেইস চুলের জন্য দেখা যেতো না, খাতায় লেগে যেতো। ডিউটি স্যার মজা করে আমার চুল হাত দিয়ে তুলে ধরে রাখতেন আর সবাই হাসতো। এভাবেই একে একে সব পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষা ভালোই দিলাম, ভালো একটা রেজাল্ট তখন থেকেই আশা করছিলাম।
আগামীকাল রেজাল্ট। বিকেল হয়ে গেছে টেনশনে টেনশনে। এই মুহূর্তে আর ভালো রেজাল্ট আশা করছি না। কোনোরকম যেনো পাশ করে ফেলি এই দোয়াই করছি। তা’না হলে আর এই মুখ দেখানো সম্ভব না। মরতেও পারবো না। আমার আম্মাও তাহলে শিওর মরে যাবে। এ বোকামি করবো না। এসব ভাবতে ভাবতে একটা ফ্রেন্ডকে ফোন দিলাম। তাকে নিয়ে পরিকল্পনা করলাম বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবো, ঢাকা গিয়ে গার্মেন্টসে কাজ করবো। রেজাল্ট যদি ভালো হয় তাহলেই বাড়ি ফিরবো। ছোটবেলার চিন্তাভাবনা আরকি। এতো কি আর বুঝতাম! আরো একটা ফ্রেন্ডকে ঐ ফ্রেন্ড এড করলো। এখন হলাম তিন জন। তিন জন মিলে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম, বেশ দূরের একটা মসজিদে গিয়ে উঠলাম। হালকা কিছু খাবার কিনে সারা রাত মসজিদে থেকে নামাজ পড়ে কাটাইলাম। পরেরদিন রোজা রাখলাম।
অবশেষে এখন বাজে বেলা দুইটা। আজকে রেজাল্ট। কি হবে জানিনা এখনো, সংশয়ে বুক ধুকপুক করতেছে। এখানে ওখানে হাটতেছি। সাথের ফ্রেন্ডরা আর থাকতে না পেরে স্কুলে চলে গেছে। যদিও তারা ছিলো আমাদের স্কুলের ফার্স্ট বয়, সেকেন্ড বয়। আর আমিতো লাস্ট বয় বলতে পারেন। আধা ঘন্টা পর দুটো ফ্রেন্ডই ফোন দিয়ে জানালো তারা “জিপিএ ফাইভ” পেয়েছে। তাদের আতঙ্ক আর উৎসুক কন্ঠ শুনে আমি স্কুলের দিকে দিলাম দৌড়। হটাৎ থেমে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম আমি ক্যান দৌড়াচ্ছি “জিপিএ ফাইভ” তো পেয়েছে ঐ ফ্রেন্ডরা। এখন খুব ভয়ে আস্তে আস্তে হেটে যাচ্ছি।
স্কুল গেটে পৌছানো মাত্রই ফ্রেন্ড দুইটা দৌড়ে এসে কোলে উঠে যায়। সবাই “জিপিএ ফাইভ” পেয়েছে। বিশ্বাস করেন তখনো আমার রেজাল্ট’টা কেউই জানেনা। কারন আমার রোলটা সবার থেকে দূরে ছিলো। আমি সবাইকে রেখে অসহায়ের মতো একটা স্যারকে বললাম রেজাল্ট শিটটা দিতে। স্যার বললেন আধা ঘন্টা পরে আসো। এখন শুধু যারা যারা “এ+” পেয়েছে এদের রেজাল্ট পেয়েছি। সবটা সাবমিট হয়নি। আমিও বসে রইলাম।
আমি জানি “এ+” এর তালিকা দেখে খামোখাই কষ্ট বাড়িয়ে কি লাভ! বসে থেকে অবশেষে পেলাম রেজাল্টশিট। হুমড়ি খেয়ে সবাই দেখতেছে। আমিও পাগলের মতো রোল খুঁজতেছি পাচ্ছিনা। ভয়ে কাঁপতেছি। যে ফ্রেন্ডটা ফার্স্ট বয় সে’ই বলতেছে তর রোল দে। দিলাম রোল। তারপর অনেকক্ষণ খুঁজে করুণ একটা ভাব নিয়ে আমার কাধে হাত রাখলো। আমি ভয়ে কেঁদে ফেললাম। বুঝে গেছি আমি হয়তো ফেইল। ঠিক তখনই চিৎকার দিয়ে বললো শালা তুইও “এ+” পেয়ে বসে আছিস। আমি কিছুক্ষণের জন্য হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। সেদিন চিল্লায়া কাঁদছিলাম। সেটা শুধুমাত্র রেজাল্ট ছিলো না, আমার একমাত্র ফসল ছিলো। আমার স্মরণীয় দিন। সবকিছুর জন্য আমার উপরওয়ালা আর আম্মাই ছিলো ভরসা, সব ক্রেডিট আমার আম্মার প্রাপ্ত, উনার জোরেই আমার পরীক্ষাতে বসতে পারা। আসলেই মায়ের ঋণ কোনদিন পরিশোধ করা যায়না।
পুনশ্চঃ দেশের প্রত্যেকটি এসএসসি পরীক্ষার্থী ভাই বোনদের জন্য অসংখ্য দোয়া রইলো। যেন সবাই তার আশানুরূপ ফলাফল অর্জন করতে পারো। আর একটা কথা; তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টার পরই কিন্তু কাঙ্খিত ফল আসবে, এটা মানতে হবে। তাও যদি আশানুরূপ না হয় ভেঙে পরার কিছু নেই। জীবনে আরো অনেক বড় বড় চান্স পরে আছে, আমরা এটা এখন বুঝি। কখনো শুধুমাত্র এই ফলাফল দিয়ে নিজের জীবনকে বিচার করবে না, উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত নিবে না যে যাই বলুক। কানে তুলা ঢুকিয়ে রাখবা। তোমার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না তুমি তোমার বেষ্ট ফাইট’টাই করেছো। ইনশাআল্লাহ্ ভালো করবে সবাই, এটাই প্রত্যাশা।