আমি সোফায় বসে একনজরে মোবাইলের স্কিনের দিকে তাকিয়ে আছি। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তুলি জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার, আপনি কি কোনকিছু নিয়ে টেনশন করছেন?’ তুলি আমার স্টুডেন্ট। ওকে বাসায় গিয়ে পড়াই আমি। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে ও। ওর প্রশ্ন শুনে আঁতকে উঠলাম আমি। বললাম, ‘কই, না তো। তুমি তাড়াতাড়ি অংকগুলো করে আমাকে দেখাও।’ আমার কথায় ও আবারো অংক সমাধানে মনযোগী হলো। আমি আবারো মোবাইলের স্কিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মেসেঞ্জারে আছি আমি। তুলিদের বাসায় ঢুকার পনেরো মিনিট আগে তানহাকে মেসেজ দিয়েছিলাম। সিন করেছে তবে এখনো কোন রিপলাই দেয়নি। তানহা তুলির বড় বোন। তুলিকে আমি পড়াই ও যখন ক্লাস টুয়ে পড়তো তখন থেকে। আর সেসময় থেকেই তানহার সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আজ নাকি তানহাকে বরপক্ষ দেখতে আসার কথা। তানহা বলেছিল, ছেলে নাকি সরকারি চাকুরীজীবি। উপর নিচ মিলিয়ে মাস শেষে লাখের লাখ টাকা ইনকাম করে। ঢাকার উত্তরায় নিজস্ব বাড়িও নাকি আছে। গাড়ি তো আছেই সে আর বলতে।
পঁচিশ মিনিটের মতো অতিক্রম হয়ে যাওয়ায় কোন রিপলাই না পেয়ে অবশেষে তানহার আইডিতে ঢুকতে চেষ্টা করি। কিন্ত একি! পাসওয়ার্ড রং দেখাচ্ছে! কি হচ্ছে আমার সাথে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। যদিও কখনো তানহার বিষয়ে তুলিকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু আজ আর জিজ্ঞেস না করে পারলামনা। ওকে বললাম,
-আচ্ছা তুলি, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
আমার কথা শুনে হাতের কলমটা খাতার উপর রেখে ও বললো,
-জ্বী স্যার, বলুন!
-আজ নাকি তোমাদের বাসায় মেহমান এসেছিলেন?
-জ্বী। এসেছিলেন।
-তা, উনারা নিশ্চয় তোমার জন্য অনেক চকোলেট এনেছেন তাইনা?
-না স্যার। আমার জন্যে একটাও চকোলেট আনেনি। আমি ওদেরকে বলেছি, আমাকে চকোলেট না দিলে আমার আপুনিকে বিয়েই দিবনা। আর তাই ঐ সুন্দর লোকটা আমার আপুনিকে সাথে করে নিয়ে আমার জন্য অনেক চকোলেট আনতে গিয়েছেন।
চকোলেট তুলির অনেক প্রিয়৷ ও এক্সামে ভালো করলে আমিও ওকে চকোলেট এনে দিতাম। তুলির কথাগুলো শুনে যা মনে হলো তা যেন সত্য না হয় সেই প্রার্থনাই করছিলাম আমি। ফোনে টাকাও ছিলনা যে তানহাকে একটা কল দিব। সব চিন্তা মাথায় নিয়েই তুলিকে পড়াতে লাগলাম।
সন্ধা নামার সাথে সাথে তুলিকে আমার পড়ানোর সময় শেষ হয়ে গেছে। এখন যেতে হবে। কিন্তু তানহাদের কেউই বাসায় ফিরেনি এখনো। থাকার মধ্যে শুধু কাজের মহিলাটাই বাসায় আছে। বাসা থেকে বেরোতে যাব অমনি একটি কালো রংয়ের প্রাইভেটকার এসে ভেতরে ঢুকলো। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। একটি ছেলে নামলো গাড়ি থেকে। দেখতে মাশাআল্লাহ্ বেশ সুন্দর। পরক্ষণেই নামলো তানহা। ছেলেটি আমাকে দেখে এগিয়ে আসলো এবং হ্যান্ডশেকের জন্য তার ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
-হ্যালো ম্যান, আই এম রাসেল। ইউ আর ডেফিনেটলি সিফাত, এম আই রাইট?
সিফাত হলো তানহার ফুফাতো ভাই। ওর কথা হয়ত শুনেছে আর আমাকে দেখে সিফাত ভেবেছে ও। ওর হাতে আমিও হাত মিলিয়ে বললাম,
-ওহ সরি ম্যান, আই এম রিয়াদ। তুলি’স হোম টিচার।
-ওহ সরি। বাই দ্যা ওয়ে, উই আর গোয়িং টু গেট ম্যারিড নেক্সট মানথ্। ইউ মাস্ট বি এট দ্যা ওয়েডিং। ওকে!
-ইয়াহ শিউর এন্ড কনগ্রেচুলেশনস্।
-থ্যাংক ইউ ম্যান।
-ইটস্ মাই প্লেজার।
-সি ইউ।
-সি ইউ।
এতক্ষণে সবকিছু আমার কাছে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেছে। গেটটা পার হয়ে একটা রিকশায় চড়ে কোনরকম বাসা পর্যন্ত আসলাম। আমাকে দেয়া ওর সবকটা গিফট এক এক করে ভেঙ্গে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম আমি। ওকে নিয়ে লিখা শত কবিতার ডায়েরিটা আগুনে পুড়িয়ে দিলাম। রাতে তানহার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েও ব্যর্থ হই। অনেকগুলো মেসেজ ওকে পাঠাই। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ও আমার মেসেজগুলো শুধু সিন করে। কোন রিপলাই দেয়না। এরপর ব্লক দেয়। আমার সাথে কেন এমন করলো আর কেনইবা এই বিয়েতে হুট করে রাজি হয়ে গেল তার কোন রিজন ও আমার সাথে শেয়ার করেনি। পুরো বিষয়টা অস্পষ্ট আর রহস্যে ঘেরা থাকলেও আমাকে কোন ধরণের পাত্তা না দেয়াটা কোনভাবেই নিতে পারিনি আমি। আমি পরেরদিন সকালে গ্রামে চলে যাই। তানহার মাকে ফোন করে বলে দিই আমি পরবর্তী এক সপ্তাহ পড়াতে যেতে পারবনা।
আমার কথা শুনে উনি দ্বিমত হন৷ আমাকে বলেন, এক তারিখে তানহার বিয়ে। বিয়েতে যেভাবেই হোক আমাকে থাকতেই হবে। আমার ভার্সিটি এডমিশনের ফি থেকে শুরু করে নানান সময়ে সবরকমের সহযোগিতা উনি আমাকে করেছেন। কখনো উনি টাকা গুণে আমাকে দেননি। প্রতি চার-পাঁচদিন পরপর হাজার-পনেরো শো টাকা আমাকে দিতেনই। আর অনেক সময় তো জামাকাপড়ও কিনে দিতেন! খুব আদর করতেন আমায়। আমি উনার অনুরোধ ফেলতে পারিনি। বিয়ের আগের দিন আবার সেখানে চলে যাই।
রাতে কিছু কেনাকাটার জন্য আমাকে ফোন করে ডেকে পাঠান তানহার মা। উনার স্বামী আমেরিকায় থাকেন। একাই সব সামলান উনি। উনার দেয়া টোকেনটি নিয়ে বেরিয়ে যাব এমন সময় তুলি পেছন থেকে ডেকে ওঠে আমায়। দাঁড়িয়ে পড়ি আমি। ও এসে আমার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দেয়। দিয়ে বলে, ‘স্যার, এটি আপুনি আপনাকে দিতে বলেছেন।’ বাইরে বেরিয়ে ভাজ করা কাগজটি খুলে পড়তে শুরু করি আমি। তাতে লিখা ছিল,
‘রিয়াদ, তোমার সাথে আমার রিলেশনটা ছিল জাস্ট টাইমপাস। এর আগে কত ছেলের সাথে আমি এরকম টাইমপাস করেছি তার কোন হিসেব নেই। তুমি সবেমাত্র অনার্সে পড়ছো। তোমার ফ্যামিলিও তেমন সুবিধের নয়। মোটকথা, তোমার জন্য অপেক্ষা করে আমি আমার ফিউচারে ভালো কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। তাই রাসেলকে বিয়ে করে নিচ্ছি। ওর বাড়ি-গাড়ি সবই আছে। নিচে ওর বাড়ির এড্রেসটা দিলাম। যদি কখনো বিপদ-আপদে প্রয়োজন হয় তাহলে চলে এসো। এটুকু উপকার তোমার জন্য আমি সবসময়ই করব। ভালো থেকো।
তানহা’ লিখাটা পড়ার পর অনেক কষ্ট লেগেছিল আমার। তবে এটিই ছিল আমার লাইফের টার্নিং পয়েন্ট। শত কষ্ট হলেও নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিই। ব্যস্ত রাখি বিভিন্ন কাজে। পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করি। জবও করতে থাকি পাশাপাশি।
পাঁচ বছর পর,
ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলের ম্যানেজার হয়ে যাই আমি। এত কম সময়ে কেউ এত উপরে উঠতে না পারলেও সেটাই আমি করে দেখিয়েছি। চ্যালেঞ্জ নিয়েছি এবং সাকসেসও হয়েছি। মাস শেষে বেতন পাই নব্বই হাজার টাকা। হোটেলের অন্যাম্য ফ্যাসিলিটি মিলিয়ে টোটাল ইনকাম হয় প্রায় দেড় লাখের মতো। আল্লাহর রহমতে বেশ ভালোই চলতে থাকে সব। মেয়ে দেখা শুরু হয় আমার জন্য। মা’ই সব ঠিক করেন। বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হয়। তুলিদের বাসায় কার্ড দিতে যাই আমি। কলিং বেল বাজাতেই কাজের মহিলা দরজা খুলে দেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন তুলির মা শাওয়ার নিচ্ছেন। আমি এবার সোফায় বসি।
একটি ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমার কাছে এসে চকোলেট চায়। আমি চকোলেট এনেছিলাম তুলির জন্য। যদিও এতদিনে ও বড় হয়ে গেছে অনেক। তবুও এনেছিলাম। সেগুলো মেয়েটিকে দিয়ে দিই। কিছুক্ষণ পরই আবার কলিং বেল বেজে ওঠে। কাজের মহিলা কিচেনে থাকায় আমিই উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিই। কিন্ত দরজা খুলে যা দেখলাম তার জন্য কখনোই প্রস্তত ছিলামনা আমি। তানহা! আমাকে দেখে ও নিচের দিকে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। ওর চেহারাটা রোদে পুড়ে গেছে। সেটা অবশ্য দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ও কোন কথা না বলে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। আমি ডাক দিলাম পেছন থেকে। ও দাঁড়ালো। সোফায় বসতে বললাম। প্রথমে বসতে না চাইলেও দ্বিতীয়বার বলায় তখন বসলো। জিজ্ঞেস করলাম,
-কি হয়েছে তোমার? সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? আর তোমার এঅবস্থা কি করে হলো?
ও মাথা নিচু করে বসে রইলো। কোন জবাব দিলনা। আবার সেই একই প্রশ্ন করলাম। ও কেঁদে ফেললো। আমি বললাম, কি হয়েছে বলো আমায়!
-বিয়ের একবছরের মাথায় ঘুষ খাওয়ার অপরাধে ওকে চাকুরীচ্যুত করা হয়। এরপর ব্যবসা দেয়ার জন্য ও আমার শশুরের কাছে টাকা চাইলে উনি তার সম্পত্তি উনার চার সন্তানের মাঝে বন্টন করে দেন। কিন্ত সেই টাকায় ওর বিজনেস দাড় করানো পসিবল ছিলনা। তখনি আমার উপর প্রেসার দেয় বাবার কাছ থেকে যেন টাকা নিয়ে দিই। কিন্ত বাবা এসব শুনে সাফ জানিয়ে দেন, ‘দরকার হলে সারাজীবন তুই আমার বাড়িতে থাকবি। তবুও ওকে একটি টাকাও দিবনা।’ বাবা এককথার মানুষ। যা বলেন তাই করেন। টাকা দেননি। শুরু হয় আমার উপর অত্যাচার (এটুকু বলে ও হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে)।
তখনি চলে আসেন তানহার মা। আমাকে দেখে উনি যারপরনাই আনন্দিত হন। তানহা চলে যায় ওর রুমে। তানহার মায়ের কাছ থেকেও অনেক কাহিনী শুনি। ইতোমধ্যে অন্য একটি মেয়ের সাথে আমার বিয়ের সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। তানহার পরিণতির জন্য আমি সরাসরি ওকে দোষারোপ করবনা। তবে ওর এত তাড়াতাড়ি ডিসিশন নেয়াটা উচিৎ ছিলনা। হয়ত আরেকটু সময় নিতে পারতো ও। ভাবতে পারতো আরো। কে জানে, ও আমার সাথে এরকম না করলে হয়ত আমিও আমার আজকের জায়গায় এসে দাড়াতে পারতামনা। জীবনটা একটা রঙ্গমঞ্চ। এখানে ক্ষণে ক্ষণে জীবনের রং বদলায়। কারণে অকারণে বদলায়। স্বার্থের তরেও বদলায়। খুব কম মানুষই এই রংয়ের দুনিয়ায় নিঃস্বার্থ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে।