“চলোনা আজই আমরা বিয়ে করে ফেলি।” তমা কথাটি বলে নাবিলের দিকে তাকালো ওর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।
নাবিলের মুখ থেকে ফিক করে পানি ছিটকে পড়লো তমার মুখে। তারপর হাসতে হাসতে ব্যাঞ্চ থেকে পড়ে গিয়ে হাতে থাকা বোতলের পানি ওর প্যান্টের জিপার বরাবর পড়ে গেলো। তমা তখন রাগান্বিত হয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছছিল। নাবিলের এই অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে “আব্দুল হাই” কাকুর ন্যায় দুই হাত উপরে তুলে বললঃ আল্লাহ! তোমার কাছে বিচার দিলাম। কিন্তু ন্যায় বিচার এত তাড়াতাড়ি আশা করিনাই।
নাবিল নিজেকে কন্ট্রোল করে ব্যঞ্চে বসতে বসতে তমার মাথায় টোকা দিয়ে বললঃ কন্ট্রোল মে আজা মেরে জাংলি বিল্লি। দেখ বাকী সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। তমা সত্যিটা দেখে কিছুটা বিব্রত হয়ে আবারো ব্যাঞ্চে বসলো। এবার নাবিল তমার মাথায় আরো একটি টোকা দিয়ে বললঃ এই ছেমরি তোর দেড় কুত্তার বয়স হইছে? আবার বিয়ের কথা কস! জানিসনা বাংলাদেশে মেয়েদের দেড় কুত্তার বয়স হওয়ার আগে বিয়ে হওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ।
তমাঃ দেড় কুত্তার বয়স মানে?
নাবিলঃ ইশ! মনে হয় জানেনা, ঢঙ যত?
তমাঃ সত্যি জানিনা।
নাবিলঃ ওওওওও তাইলে শোন। আচ্ছা বলতো কুকুরের গড় আয়ু কত?
তমাঃ আমি কি করে বলবো?
নাবিলঃ ১২ বছর। তাইলে দেড় কুকুরে কয় বছর হয়?
তমাঃ ১৮ বছর!
নাবিলঃ এক্সাক্টলি। তোর ১৮ বছর হইছে?
তমাঃ তুমি আমারে কুকুরের সাথে তুলোন করলা?
আমি কুত্তা? ঐ শয়তান তুই কুত্তা। তোর ১৪ গোষ্ঠী কুত্তা।
নাবিলঃ হুম। আর তুই, তোর ১৮ গোষ্ঠী কুত্তি।
তমা ঃ কি?
নাবিলঃ এখন জ্বলে তাইনা? তমা গোমড়ামুখ করে বসে রইলো।
নাবিলঃ আমি কিন্তু তোরে প্রথমে কুকুরের সাথে তুলোনা করি নাই। জাস্ট তোমার বয়স বুঝানোর জন্য বলছি।আর যদি বলতে চাইতাম ।তবে “কুত্তী” বলতাম।
তমাঃ হ হ বুঝছি আর বুঝাতে হবেনা (কিছুটা অভিমানের সুরে) নাবিল এবার তমার চুলে হাত চালাতে চালাতে বললঃ সিধি! আমি কি তোমায় কুকুরের সাথে তুলনা করতে পারি? আচ্ছা ধর, তুই কুত্তাই, তাইলে আমি কি? আমাদের বাচ্চাকাচ্চা কি হবে?
তমাঃ হইছে আর আহ্লাদী আদর দেখাতে হবেনা। নাবিল এবার তমার নাকটিপে ধরে বললঃ এবার তোর শ্বাস-প্রশ্বাস মুখ দিয়ে বের হবে। আর মুখও যদি চেপে ধরি, তবে তুই শেষ। তেমনি তুই ছাড়া আমার নাক-মুখও বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর তমার ওড়না দিয়ে ওর মাথায় ঘোমটা টেনে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললঃ একদিন তোরে ঠিক এইভাবে আমার বৌ করে নিয়ে যাবো। তমা নাবিলকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললঃ পাগল নাকি?
নাবিলঃ কেন?
তমাঃ পার্কে আরো মানুষ আছে। তারা দেখলে কি ভাববে?
নাবিল ঃ কি ভাবতো? তুই আর আমিই তো! আমরা তো আধা জামাই বৌ। নাকি?
তমাঃ আচ্ছা তুমি কি ক্ষেত?
নাবিলঃ কেন?
তমাঃ এইযে আমারে “তুইতোকারি” করে বলো, আবার বলো “আধা জামাই-বৌ!”
নাবিলঃ থাম।
আমি জানি ওটাকে “হবু স্বামী-স্ত্রী” বলে,আর মাঝেমাঝেতো তুমি করেই বলি, নাকি?কিন্তু যখন তোরে বেশি ভালোবাসি তখন তুইতোকারি করে বলি। আর যখন ভালোবাসাটা স্লো মোশনে চলে যায়, তখন তুমি, “তার মানে আমার জন্য তোমার মনে ভালোবাসা শেয়ারবাজারের মত উঠানামা করে?” নাবিলের কান ধরে বলল তমা। নাবিল তমার হাত কান থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললঃ নারে পাগলি। দুষ্টুমিও বুঝিসনা? আচ্ছা তোর ১৮ বছর হতে আর কতদিন বাকী?
তমাঃ তুমি আমার জন্মদিনও ভুলে গেছো? আল্লাহ গো এ কেমন প্রেমিক দিলা আমারে?
নাবিলঃ ভুলি নাইরে হাগলনি।জিগাইছি। একটা হিসেব-নিকেষের ব্যাপার স্যাপার আছে না। প্লীজ বলনা।
তমাঃ ৫ মাস ১৩ দিন।
নাবিল ঃ তার মানে সামনের বছরের ২১শে ফেব্রুআরিতে তোর ১৮ বছর পূর্ণ হবে। আর আমি চাকরি পাইছি তিন মাস হলো, সামনে আরো ৫ মাস আছে। মোট আট মাস। তিন মাসে যা জমিয়েছি আর বাকি ৫ মাসে যা জমাবো সব মিলিয়ে ২.৫ লাখ টাকার মত হবে। খাট, বিছানা, ড্রেসিং টেবিল, হাড়ি পাতিল এসবে প্রায় ১.৫ লাখ টাকা চলে যাবে। আর ১ লাখ টাকায় তোর জন্য শাড়ী-কানের দুল,নাক ফুল হবেতো?
তমাঃ আমার শাড়ী-গহনা কিচ্ছু চাইনা। শুধু তোমায় পেলেই হবে।
“শুধু তোমায় পেলেই হবে ” মুখ ভেংচিয়ে বলল নাবিল। সব কিনে দিবো। জীবনে প্রথমবারের মত বিয়ে করতে যাচ্ছি। বৌটারে একটু ভালোমতো সাঁজিয়ে নিতে হবেনা? দেখি, ম্যানেজ হয়ে যাবে।
তমাঃ ম্যানেজের কথা বাদ দাও। ১ম বার বিয়ে মানে? তুমি কি ২য় বার বিয়ে করতে যাবে নাকি?
নাবিলঃ করলে তোমার ক্ষতি কি? আর যদি করিও তোমার জন্যই করবো।
তমাঃ আমার জন্য মানে?
নাবিলঃ তুমি একা ঘরের কাজ সামলাতে না পারলে তোমারে সাহায্য করার জন্য আরেকটা বৌ আনা কি দোষের?
তমাঃ আইছে আমার দুঃখ লাঘব করতে। শোন, তুই যদি অন্য মেয়ের দিকে তাকাস, তাইলে তোর চোখ গেলে দিবো। আর যদি মনে মনে অন্য কাউরে ভাবোস তাইলে তোরে জবাই করে দিমু।
নাবিলঃ এবার ক্ষেতটা কে? তমা হেসে উঠলো, সাথে নাবিলও।
৫ মাস ১২ দিন পর অর্থাৎ ২০শে ফেব্রুআরি
আর মাত্র ১ দিন পর তুই আমার হয়ে যাবি। আজ সারা রাত তোর জন্মদিনের পার্টি হবে, আর সকালে কাজী অফিস খোলার পর পরই তুই আমার হয়ে যাবি। সারা জীবনের জন্য, তমার কাঁধে হাত রেখে বলল নাবিল। “কিন্তু জনাব কালতো আমি বিয়ে করছিনা” বলল তমা।
নাবিলঃ কেন? (অবাক ভঙ্গিতে)
তমাঃ কাল যেমন আমার জন্মদিন, তেমনি আমাদের মাতৃভাষা দিবসও। আর আমি একারণেই আমার বার্থডে পার্টি করিনা। অন্যান্য বছরের মতই কাল কিছু জামা-কাপড় আর খাবার নিয়ে একটি এতিমখানায় যাবো। আর ওদের সাথেই আমাদের ভাষা শহীদদের স্মরণ করবো এবং আমাদের ভবিষ্যতের জন্য দু’আ চাইবো। তারপরদিন বিয়ে।
নাবিলঃ ডান। গুড আইডিয়া মিসেস নাবিল।
তমাঃ জনাব আরো একদিন বাকী আছে। এত তাড়া কিসের?
নাবিলঃ ধুর! মুডটাই অফ কইরা দিলা! ভাল্লাগেনা।
তমা এবার নাবিলের কপালে চুমু খেয়ে বললঃ সরি স্যার! অনেক বড় ক্ষমা হয়ে গেছে, একটু ভুল করে দেন।
নাবিল হেসে উঠে বললঃ কত্ত বড় বান্দরের বান্দর! এক নিমিষেই মন ভালো করে দিতে পারে! আচ্ছা চলো যাওয়া যাক। সন্ধ্যে নেমে এলো প্রায়।
তমাঃ ঠিক আছে। তবে কাল সকাল ছয়টায় আমার হোস্টেলের সামনে ফুল নিয়ে উপস্থিত থাকতে হবে।
নাবিলঃ কেন?
তমাঃ বারে! আগে শহীদ মিনারে যেতে হবেনা?
নাবিলঃ যথা আজ্ঞা মহারাণী।
তমাকে রিকশায় তুলে দিয়ে নাবিল নিজের বাসার দিকে রওয়ানা দিয়ে ভাবতে লাগলো “মাত্র ১১ মাস আগে পরিচয় হলো, অথচ এখন এক নজর না দেখে থাকা যায়না। মনে হয় কত জনম ধরে চেনা। মেয়েটার কেউ নেই, এতীম খানায় থেকে বড় হলো। পড়াশোনাও মাশা-আল্লাহ। আর আমার বাড়ীতেও সৎমা। দুজনের জীবনটাই দুঃখে ঘেরা। যাই হোক, আমি আমার তমারে রাজরানীর মত করে রাখবো।”
২১শে ফেব্রুআরি ২০১৯ ভোর ছয়টা
তমা রেডি হচ্ছে শহীদ মিনারে যাওয়ার জন্য। কিন্তু জানালা খুলে নিচে নাবিলকে না দেখে ফোন হাতে নিলো ওরে ফোন করার জন্য। কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ওর ইনবক্স ভর্তি এসএমএস। সে এসএমএস গুলো চেক করতে লাগলো। সবগুলাই তার জন্মদিন উইশ করা। সর্বশেষ এসএমএস নাবিলের, 12.00 am এ করা “শুভ জন্মদিন মিসেস নাবিল। দেড় কুত্তার বয়সএর সমান আপনার বয়স হওয়ায় মুবারকবাদ” তমা হাসতে হাসতে নাবিলের নাম্বারে ডায়াল করলো। কিন্তু লাইনকেটে নীলুর ফোন আসলো। তমা ফোন রিসিভ করে বললঃ কিরে রাতেইতো উইশ করলি! এখন আবার কেন?
নীলুঃ তার জন্য নয়?
তমাঃ তাইলে কেন?
নীলুঃ আচ্ছা দোস্ত নাবিল ভাই কি চকবাজার থাকেনা?
তমাঃ হুম। থাকেতো। তো?
নীলু ঃতুই আজকের খবর জানিস?
তমাঃ না তো!
“টিভি অন কর” বলেই লাইন কেটে দিলো। তমা টিভি অন করে হেডলাইনে চোখ দিলো “চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। এখন পর্যন্ত ৫০ জনের মত মারা গেছেন, দমকল বাহিনী আগুন নিয়ন্ত্রের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে” তমা এবার দৌড়ে গেলো মোবাইলের কাছে। নাবিল কে ফোন দিলো, ওর ফোন বন্ধ। “চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় মৃত হওয়া কয়েকজনের পরিচয় জানা গেছে,” (সংবাদ পাঠকের কথায় হুশ ফিরে টিভির দিকে নজর দিলো তমা। তমা দেখলো ছবি সহ মৃতদের পরিচয় তুলে ধরা হচ্ছে।) “এরা হলেন অনিক (বরিশাল) জান্নাতুন নাইম (ফেনী) আবুল হোসেন (মুন্সিগঞ্জ) রহিমা খাতুন (টাঙ্গাইল) এবং নাবিল ইবনে বাশার (কুমিল্ল)।” তমার হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেলো, সাথে সাথে সে কাঁত হয়ে পড়ে গেলো।
১৮ বছর ১ মাস পর
তমা ফুল নিয়ে এসে দাঁড়ালো নাবিলের কবরের পাশে, শিয়রের পাশে বসে বললঃ হ্যাপি এনিভার্সারি ডে নাবিল। তারপর চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলোঃ এই নাবিল এখন আমার তিন কুত্তার বয়স হইছে। এখনো কি আমায় বিয়ে করতে তোমার সমস্যা আছে? আর কত অপেক্ষা করবো,? কিছু বলছোনা কেন? এমন সময় চারজন মহিলা এসে তমাকে টেনে হিছড়ে নিয়ে গেলো একটি গাড়ীর ভিতরে। ভিতরে ঢুকিয়েই দরজা বন্ধ। ড্রাইভার গাড়ী স্টার্ট করে চলল পাগলা গারদের দিকে।