চিরকুটের বাক্স

চিরকুটের বাক্স

বৌ এর রাগ ভাঙাতে যাচ্ছিলাম শ্বশুরবাড়ি ৷ পরক্ষণেই পিছু হটলাম৷ আমার অতীত অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়লো হুট করে৷ “শীতের একটা সকালে তুমুল ঝগড়া বেধেছিল মিতুর সাথে৷ বিকেলে ঘরে ফিরতেই দেখলাম, তালা ঝুলানো৷ দারোয়ান চাচাকে চাবি দিয়ে যায়নি মেয়েটা৷ সেই হিসেবে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া আমার৷ শ্বশুর আমার রসিক মানুষ৷ ঘন্টাখানেক জমিয়ে আড্ডা দিলাম আসা মাত্রই৷

পরিবেশটা একটু ঠান্ডা হল৷ শ্বশুরবাড়িতে তেমন হৈ চৈ নেই বললেই চলে৷ আমি টুপ করে মিতুর রুমে ঢুকে পরলাম৷ মিনিটখানেক ভালোবাসা দেখালাম৷ শক্তমনা মিতুর মন গলছে না কিছুতেই৷ ভেতরে ভেতরে মেজাজ খারাপ হলেও চেপে রাখলাম৷ বৌ না হয়ে প্রেমিকা হলে ততক্ষণে চড়-থাপ্পর দিয়ে গাল লাল করে ফেলতাম৷ অত্যাধিক ন্যাকামো আমার একদমই ভালো লাগে না৷

বৌ এর রাগ ভাঙাতে না পেরে বিকেলে বেরোলাম শালাবাবুর সাথে৷ দু’একটা আইডিয়া চেয়ে বসলাম৷ আমার মানিব্যাগের স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো নেই৷ মাসের শেষের দিকে যা হয় আরকি৷ তা দেখে শালাবাবু আর আইডিয়া দেয়নি আমার৷ পাড়ার ছোটভাই হলে এতক্ষণে কানে ধরে উঠবস করাতাম আমি৷ নেহাতই শালাবাবু বলে ছেড়ে দিয়েছিলাম৷ বছরখানেক আগে শালাবাবুকে একটা চড় দিয়েছিলাম৷ শেষে তার বোনকে গিয়ে বলেছে, আমি নাকি তাকে নিয়ে ফুটবল খেলেছি৷ জবাবে আমি টু শব্দটা পর্যন্ত করতে পারিনি৷  সন্ধ্যা পেরোতেই হতাশ মন নিয়ে বৌ এর রুমে ফিরলাম৷ বৌ আমার এখনো গোঁ ধরে বসে আছে৷ হুট করে আমার মাথায় সুবুদ্ধির উদয় হলো৷

আমাদের অতীতের চিরকুট দেয়া প্রেমপ্রেম সময়গুলো চোখে ভাসে আমার৷ ছোট্ট কাগজ কেটে লিখলাম “কী করলে রাগ ভাঙবে বলো?” চিরকুট পেয়েই বৌ এর মুখটা উজ্জল হলো একটু৷ আমি ভাবলাম, কাজ সেরেছে৷ নিজেই নিজেকে বাহবা দিলাম একবার৷ বৌ আমার চাবি দিয়ে তার ব্যক্তিগত ড্রয়ারটা খুললো৷ ছোট্ট দু’টো বাক্স৷ বাক্স খুলতেই গাদা গাদা চিরকুট চোখে পরলো৷ আমার চোখগুলো টলমল করে উঠলো৷ আহা বৌ আমার কত্ত ভালোবাসে এই ভেবে৷ বাক্স দু’টো নিচের দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম আমি৷ মার্কার পেন দিয়ে একটার নিচে লিখা “প্রেমের আগে” আরেক বাক্সের নিচে লিখা “প্রেমের পরে”৷ হতভম্ব আমি মিতুর দিকে তাকালাম৷ মিতুর মুখে মুচকি হাসি ঝুলছে৷ যে হাসিকে অনুবাদ করলে আমি দেখতে পাই “সোনাচাঁদ তোমাকে পেয়েছি আজ”৷ আমি মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলাম,

-প্রেমের আগে আর পরে মানে কী?”
-এগুলো প্রেমের আগে৷ মানে আমাকে পটানোর জন্য লিখা চিরকুট৷ আর বাকিগুলো প্রেমের পরের৷”

জবাব দিলো মিতু৷ প্রেমের পরে লিখা বাক্সের চিরকুটগুলৌ আবারো ড্রয়ার এ ঢুকালো মিতু৷ এবার প্রেমের আগে লিখা চিরকুটের বাক্সটা খুললো৷ মেলায় কেনা দু’টাকার লটারির বাক্সের মতো ঝাঁকালো কিছুক্ষণ৷ তারপর বলল,

-এখান থেকে একটা চিরকুট তুলো!”

আমি ঢোক গিললাম একবার৷ গলাটা শুকিয়ে আসছে৷ প্রেমের আগে প্রত্যেকটা চিরকুট এ আমি চাপা মেরেছি৷ এতদিন পরে এসে রিএক্শন করবে ভাবিনি৷ দোয়া দরুদ পড়ে প্রথম চিরকুট তুললাম৷ কাঁপা কাঁপা হাতে খুললাম৷ চিরকুটে লিখেছিলাম “ওহে প্রিয়তমা! তোমার মুখের এক চিলতে হাসির জন্য আমি সাত সমুদ্র পাড়ি দিতে রাজি!” পড়া শেষে মিতুর দিকে তাকালাম৷ মুখে রাজ্য জয়ের হাসি৷ আমার ভেতরটা কাঁপছে৷ ছোটবেলায় সাঁতার শিখতে পুকুরের অর্ধেক পানি সম্ভবত আমার পেটেই ঢুকেছিল৷ অতীত মনে পরতেই শিউরে উঠছি৷ এই মেয়ে আবার সাত সমুদ্র না পাড়ি দিতে বলে৷” আমি অসহায় মুখে মিতুর দিকে তাকালাম৷

-শুনো৷ আমি অতো নিষ্ঠুর না৷ তুমি শুধু আমাদের পুকুরটা পাড়ি দিবে চলো!”

বলল মিতু৷” আমি ঘোরতর আপত্তি জানালাম৷ ঠিকলো না৷ কনকনে শীতে ব্যাচেলর থাকতে আমি সপ্তাহে একদিন গোসল করলাম৷ সেই আমিই বৌ এর জন্য শীতের সন্ধ্যায় পুকুর পাড়ি দিয়েছি সেদিন৷ তারপরের দু’দিন আমি চোখে আলো দেখিনি৷ বৌ এর সেবা-শ্রুষুষা পেয়ে সপ্তাহখানেকের মধ্যে সুস্থ হয়ে গেলাম৷

তার দিন পনেরো পর আবার বাজলো ঝগড়া৷ আমি চুপ করে শুনে যাই৷ আর বৌ ইচ্ছেমতো ঝাড়ে৷ এরই নাম ঝগড়া৷ আবারো গেলাম বীরপুরুষের মতো রাগ ভাঙাতে৷ আবারো সেই চিরকুটের বাক্স৷ সেই প্রেমের আগের চিরকুট৷ আবারো সেই মেলার লটারির টেকনিক৷

২য় বারেরটা প্রথম বারের চেয়ে ভয়ানক৷ এই চিরকুটে লিখা ছিল “প্রিয়তমা! চাঁদনি রাতে তোমাকে পেয়ারা চুরি করে খাওয়াবো পাশের বাড়ির পেয়ারা গাছ থেকে!” এই চিরকুটটা আমি লিখেছিলাম, মিতুদের পাশের বাসার পেয়ারা গাছটা দেখে৷ আমি কী তখন জানতাম, পেয়ারা গাছের মালিক এতো খচ্ছর হবে৷ ২য় শর্ত পূরণ করতে গিয়ে চোর বলে প্যাদিয়েছে ইচ্ছে মতো৷ যেমন তেমন মার নয় কিন্তু৷ গায়ের উপর নকশি কঁাথা চাপিয়ে পেটানো হয়েছিল৷ শেষে বৌ আর শ্বশুর মিলে বাঁচিয়ে এনেছিল আমায়৷ আমি হারিয়েছিলাম আমার মূল্যবান দু’টো দাঁত৷ অমাবস্যার রাতে এখনো আমার ব্যাথা উঠে শরীরে৷ সেই পেটানোর দৃশ্যটা আমি দুঃস্বপ্ন দেখি আজো৷”

ফোনের শব্দে আমার ভাবনার ইতি ঘটে৷ শ্বশুর আব্বা ফোন দিয়েছে৷ আমি ধরবোনা৷ আমি যতবার শ্বশুরবাড়িমুখো হয়েছি৷ ততবার বেরোতে যাওয়ার আগেই “প্রেমের আগে” নামক চিরকুট বাক্সের কথা মনে পরলো৷ হালকা পাতলা লেভেলের চাপাবাজি মার্কা চিরকুটের অত্যাচারে আমি অর্ধেক মরে গিয়েছি আগের দু’বারে৷ এরপরের চিরকুটগুলোতে চরম আকারের চাপাবাজি করেছিলাম আমি৷ ভাবতেই গা শিউরে উঠলো আমার৷ আমি পিছু হটলাম৷ কিন্তু মিতু কিছুতেই ফিরবেনা৷ দু’চারদিন বাদে আমারই যেতে হবে৷ আবারো একটা চিরকুট কিছু মাথায় আসছেনা আমার৷ পরের চিরকুটের গল্প অন্য আরেকদিন হবে৷”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত